১০ বছরে সপ্তমবারের মতো গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সরকার। ঠিক যখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কমেছে শতকরা ৫০ ভাগ, যখন ভারত তাদের ভোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম কমিয়েছে ১০১ রুপি, তখন আমরা অবিশ্বাস্য হারে (গড়ে ৪৬.৭৫ শতাংশ) দাম বাড়াচ্ছি। গ্যাসের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) বিদ্যুৎ, সার, শিল্প, চা–বাগান, ক্যাপটিভ পাওয়ারসহ সব শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতের গ্যাস ব্যবহার, সিএনজি এবং গৃহস্থালি পর্যায় মিলে সব ধরনের গ্যাস ব্যবহারকে অতি উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির আওতায় এনেছে। গড় হিসাবে প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়ছে। এক অর্থবছরেই প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করা বিদ্যুৎ খাতের গ্যাসের দাম বাড়বে ৪১ শতাংশ, আর ক্যাপটিভ পাওয়ারের গ্যাসে দাম বাড়বে ৪৪ শতাংশ। দেশের কৃষক যেখানে উচ্চ উৎপাদন খরচের বিপরীতে অসহনীয় মূল্য বিপর্যয়ে পড়ছেন, সেখানে সার উৎপাদনের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ। এ কারণেই ভারতের কৃষক ধান চাষ করে লাভবান হন, আর আমাদের কৃষক হন ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি শিল্প খাতের গ্যাসে দাম বেড়েছে ৩৮ শতাংশ। বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্প—এই তিন খাতের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি বলে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক, শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ মূল্য থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রায় সর্বত্র।
বিশ্বে কিন্তু গ্যাসের দরপতন হচ্ছে। ভারতও তাদের ভোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম ব্যাপক হারে কমিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ার নতুন নতুন উৎপাদন এবং ব্যাপকভিত্তিক এলএনজি রপ্তানির প্রকল্প হাতে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় ধরনের দরপতন চলছে। গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরের তুলনায় বর্তমানে এশিয়ার বাজারসহ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য শতকরা হারে ৫০ ভাগেরও কম। এশিয়ার এলএনজি বেঞ্চমার্ক জাপান-কোরিয়া বাজারের মূল্যসূচক অর্ধেকের বেশি নিচে নেমেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ভর্তুকিযুক্ত এবং ভর্তুকিমুক্ত উভয় ধরনের গ্যাসের দাম কমানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক দরপতনের ঠিক বিপরীতে চলছে বাংলাদেশ। নতুন অর্থবছরের শুরুতেই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি গ্যাসের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়বে, তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন খরচ বাড়বে, পরিবহন ব্যয় বাড়বে, গৃহস্থালির রান্নাও খরুচে হবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারের দরপতনের সুবিধা হরণ করে ভোক্তা অধিকারকেও এতে খর্ব করা হলো।
দাম বাড়ানোর যুক্তি হলো, উচ্চ দামে যে এলপিজি বা তরল গ্যাস আমদানি করা হয়, তাতে ভর্তুকির ভার লাঘব করা হবে। এটা অযৌক্তিক এ কারণে যে বিশ্ববাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বিগত ছয় মাসে বাড়েনি, বরং অর্ধেকে নেমে এসেছে। সুতরাং যৌক্তিক হলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশেও গ্যাসের দামও কমাতে হবে। অন্তত এলএনজিভিত্তিক সরবরাহের যে খাতগুলো আছে, সেখানে দাম কমানো হবে। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে যেখানে এলএনজি ব্যবহৃত হয়, সেখানে তো গ্যাসের দাম কমার কথা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সার উৎপাদনের গ্যাসেই সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।
এটা অগ্রহণযোগ্য এ জন্য যে গ্যাস খাতের দুর্নীতিযুক্ত ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে, নতুন উৎপাদনে না গিয়ে, সরবরাহ ও বিতরণব্যবস্থা (পাইপ লাইন) ঠিক না করে, গ্যাস চুরির সমস্যা সমাধান না করে শুধু দাম বাড়িয়ে এই খাত টেকসই করা যাবে না। ২০১৫ ও ২০১৭ সালেও বিভিন্ন স্তরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল, তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিমূল্য কমার পরেও চুরি, সিস্টেম লস, ভর্তুকি কমছে না। মূলত, দুর্নীতিপরায়ণতা, ব্যবস্থাপনায় অদূরদর্শিতা, বিতরণে নৈরাজ্য, গ্যাস চুরি ও অবৈধ সংযোগ, সরবরাহ লাইন থেকেই অবৈধ বিতরণ, ১২ শতাংশ সিস্টেম লস, অন্যায্য মিটারিং, এলএনজি আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেখানো, এলএনজি ও গ্যাস পাইপ লাইনের প্রকল্পে ধীরতা। এসবের দায় কেন জনগণ নেবে? এমনকি মীমাংসিত সামুদ্রিক ব্লক ও স্থলভাগে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও নতুন উত্তোলন চুক্তিতে ব্যর্থতার কারণেই গ্যাস খাতে ভর্তুকি টানতে হচ্ছে।
গ্যাস উন্নয়ন ও গ্যাস নিরাপত্তা তহবিলে পাঁচ হাজার কোটি টাকা করে জমিয়ে ভর্তুকির চাহিদা জারি রেখেছে, কিন্তু এই তহবিল বহারে স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নেই। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) দুর্নীতির কারণে গ্যাস উন্নয়ন ও গ্যাস নিরাপত্তা তহবিল বিলুপ্ত করার প্রস্তাব দিয়ে ব্যবস্থাপনা নৈরাজ্য দূর করার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছে। যেখানে বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত, সেখানে রান্নার গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজির প্রাপ্তি ও মূল্যকে যৌক্তিক করা হয়নি এখনো। যেখানে কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে সারের সরবরাহ বৃদ্ধি করা জরুরি, যেখানে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম দিনে দিনে কমছে, সেখানে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান না করে বাজারের সঙ্গে সম্পর্কহীন এমন অতি উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।
এমনিতেই বাজেট ঘোষণার পর ভ্যাটের একটা চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, মৌলিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়লেও প্রাক্কলিত মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে কীভাবে? এক অর্থবছরেই বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্পের ব্যবহৃত গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে কীভাবে প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে আটকে রাখার চ্যালেঞ্জ উতরানো যাবে? জ্বালানির এই যে বিশাল ধাপের মূল্যবৃদ্ধি, তা কি দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? এক অর্থবছরেই জ্বালানি কৃষি ও শিল্পের ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির হার যদি বাজেটের প্রাক্কলিত অন্য সংখ্যাগুলোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ থেকে যায় অথবা উৎপাদন অর্থনীতির গাণিতিক হিসাবে অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে থেকে যায়, আমরা কি ধরে নিতে পারি না যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের হিসাবে বড়সড় গরমিল আছে! প্রাথমিক ও মৌলিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়িয়ে কীভাবে জনজীবন ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা হবে?
বিশ্বের দুর্নীতিমুক্ত দেশগুলোর আদলে যেকোনো প্রাথমিক জ্বালানির দাম নির্ধারণের স্থায়ী গাণিতিক মডেল দাঁড়া করাতে হবে। তবেই তা টেকসই ও বোধগম্য হবে। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিতে হবে দেশীয় চাহিদা, আন্তর্জাতিক দর, বার্ষিক রাজস্ব প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন, মূল্যস্ফীতি, বিকল্প সবুজ জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহদান কিংবা সহযোগী অন্য জ্বালানির দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার ব্যবস্থা। যেখানে দেশে পরবর্তী অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ এবং রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ, সেখানে বিদ্যুৎ, কৃষি ও শিল্পের প্রাথমিক জ্বালানি গ্যাসের দাম গড়ে ৪৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে কোন যুক্তিতে, কোন সমীকরণে? এই সমীকরণ না মিললে এটাই প্রতীয়মান হয় যে সরকার তহবিল–ঘাটতি মেটাতে ব্যবসা, উৎপাদন থেকে শুরু করে জনগণের পকেটেও হাত দিতে চাইছে। অর্থবছরের শুরুতেই গ্যাসের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি কি তাহলে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ঘাটতি বাজেটের ঘাটতি কমানোর চেষ্টা?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: ইনফ্রাস্ট্রাকচার রাইটার ও সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাকটিভিস্ট।
প্রকৌশলী, ইইই, বুয়েট। সিনিয়র সফটওয়্যার সলিউশন আর্কিটেক্ট, ভোডাফোন নেদারল্যান্ডস।
faiz.taiyeb@gmail.com