মতামত

গৌরবের ক্রোড়পত্র

ক্রোড়পত্রের জন্য বাণী দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
ক্রোড়পত্রের জন্য বাণী দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু


২২ মার্চ এলেই আমার স্মৃতিতে ফিরে আসে ১৯৭১ সালের এই দিন। এই দিনেই আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বাংলার স্বাধিকার শীর্ষক একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করতে পেরেছিলাম।

১৯৭১ সালের ৯ মার্চ আমি করাচির কর্মস্থলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। উদ্দেশ্য ছিল একটি নতুন বিজ্ঞাপনী সংস্থা স্থাপন করা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা সম্ভব ছিল না। ঢাকায় এসেই দেখি, অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ। তখনো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অনুরণন চারদিকে। বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার বন্ধুবর রেজা আলী ও আমার ভায়রা শিল্পী আবদুল মুক্তাদিরের আহ্বানে বিটপীতে কপিরাইটার হিসেবে যোগ দিই। অসহযোগ আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা তৈরি করতে শুরু করলাম নতুন নতুন বিজ্ঞাপন। সব বিজ্ঞাপনেই ফুটে উঠেছিল বাঙালির স্বাধিকারের আকুতি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন।

২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। সাধারণত ওই দিন সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। আমরা তার আগের দিন ২২ মার্চ বাংলার স্বাধিকার শীর্ষক একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করি, যাতে পরের দিন কোনো ক্রোড়পত্র প্রকাশিত না হয়।

ঢাকার প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে ২২ মার্চ প্রকাশিত ওই ক্রোড়পত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এগুলোর লেখক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধুর অন্যতম অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রেহমান সোবহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব কামরুজ্জামান। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোর চেতনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের ভাষা ও চিত্রায়ণ সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। এ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলোয় বিজ্ঞাপনদাতাদের উদ্দীপনা বিশেষ লক্ষণীয়।

ক্রোড়পত্রের জন্য বঙ্গবন্ধুর একটি বাণী নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রতিক বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে আমি বাণীর একটি খসড়া তৈরি করি। আমার হাতে লেখা বাণীটি বঙ্গবন্ধুর কাছে ১৯ মার্চ নিয়ে যাওয়া হলে তিনি তাতে সম্মতি দেন এবং স্বাক্ষর করেন।

ক্রোড়পত্রের প্রথম পাতায় আমার হাতে লেখা বাণীটি ব্লক করে বঙ্গবন্ধুর তিন কলামব্যাপী ছবির সঙ্গে প্রকাশ করা হয়। বাণীটি ছিল নিম্নরূপ:
‘বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে আমাদের আজকের এই সংগ্রাম। অধিকার বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। বুলেট, বন্দুক, বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে আর স্তব্ধ করা যাবে না। কেননা জনতা আজ ঐক্যবদ্ধ।
লক্ষ্য অর্জনের জন্যে যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধের দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায়সংগত। তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।

বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন দৃঢ়তর করার অন্যতম প্রচেষ্টা হিসেবে সংবাদপত্রসমূহের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্যোগকে আমি অভিনন্দন জানাই। জয় বাংলা।’

প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা হামিদুল হক চৌধুরীর মালিকানাধীন অবজারভার গ্রুপের পত্রিকাসমূহ বাংলার স্বাধিকার শিরোনামে ক্রোড়পত্রটি প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরদিন অবশ্য শিরোনামটি বদলে ‘বাংলাদেশ’ করে ক্রোড়পত্রটি প্রকাশ করে।

আমার অর্ধশতাব্দীর পেশাগত জীবনে অনেক ক্রোড়পত্র প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু ১৯৭১ সালের এই প্রতিবাদের ক্রোড়পত্রটি ছিল সবচেয়ে গৌরবের।

জন্মশতবর্ষে এ মহামানবের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

রামেন্দু মজুমদার নাট্য ব্যক্তিত্ব