আর্থিক বছরের শুরুতে সবারই চাওয়া থাকে প্রথম মাস ভালো যাক। কিন্তু গত তিন সপ্তাহে আর্থিক খাতের অন্যতম প্রধান বাজারে অস্থিরতা ও আতঙ্ক বিরাজমান। পুঁজিবাজার হু হু করে দরপতন ঘটেছে, যদিও একটা সাময়িক স্থিতি দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার পর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মাত্র ১৫ কার্যদিবসে বিনিয়োগকারীদের প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। শেয়ারের মূল্যমান কমে যাওয়ায় প্রায় চার লাখ কোটি টাকা থেকে ডিএসইর বাজার মূলধন নেমে এসেছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকায়।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের বড় রকমের পতনের কারণেই এই ঘটনাগুলো ঘটেছে। পতনের মৌলিক কারণ নির্দিষ্টকরণ জরুরি। প্রথমত, এই পতনের সঙ্গে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কোনো সম্পর্ক আছে কি না? দ্বিতীয়ত, এই পতনের কারণগুলো জানা ছিল কি এবং জানা থাকলে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের যথাযথ নিয়মকানুন বলবতের মধ্যে এই পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টা করেছে কি না? মৌলিকভাবে এই পরিস্থিতি অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তি বা বনিয়াদে প্রভাব ফেলবে কি?
শেয়ারবাজার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ধসের জন্য দায়ী তিনটি কারণের প্রথম কারণ অসাধু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, দ্বিতীয় কারণ মুষ্টিমেয় স্বার্থের প্রতাপ এবং তৃতীয় কারণ প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা ও জবাবদিহির অভাব।
১. অসাধু রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিফলন
আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহে সবচেয়ে বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ২৩ কোম্পানির মধ্যে ৯টির দামই ফেসভ্যালুর নিচে নেমে গেছে। আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ বাজার মূলধনের বড় অংশীদার। তাদের বাড়া-কমায় বাজারের অগ্রগতি বা নিম্নগতি নির্ধারিত হয়। এই গোষ্ঠীতন্ত্র আপনা-আপনিতে বহাল নেই। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা শেয়ারবাজারে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর মালিকানায় এমন ব্যক্তিদের থাকতে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে তিনি বা তাঁরা একের পর এক অনিয়মের মাধ্যমে আর্থিক খাত অথবা শেয়ারবাজারে নৈরাজ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলেছেন। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ আমানতকারী, সাধারণ বিনিয়োগকারী এবং লাভবান হন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে বলতে হবে, অসাধু রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণেই এমনটি ঘটেছে।
যেমন: যে প্রতিষ্ঠানের দরপতন সবচেয়ে বেশি হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠজন ৭০৩ কোটি টাকা নিয়েছেন। ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম আট দিনে প্রায় অর্ধেক বা ৪৫ শতাংশের বেশি কমে নেমে এসেছে—২ টাকা ৯০ পয়সায়। ২০১৩ সালের পর থেকে কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দিচ্ছে না। এ কারণে ২০০৬ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি এখন জেড শ্রেণিভুক্ত। ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ।
যে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়িত হলো, তা থেকে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ পরিচালক। তাঁদের কাছেই ছিল কোম্পানিটির ৬২ দশমিক ৫২ শতাংশ শেয়ার। এ বছরের মার্চের শেষে প্রতিষ্ঠানটির হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও মাত্র ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার মতো সম্পদ নেই। কিন্তু যাঁদের কারণে এটি ঘটল, তাঁদের আর দায় নিতে হচ্ছে না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যেমন ব্যাংক প্রতিষ্ঠানে পরিচালকদের নয়ছয়ের কারণে বিপর্যয়ে ফেলেছে, একই কায়দায় অব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানও রসাতলে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কেবল ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন না, বারংবার একই রকম অপকর্ম করেও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন।
২. পুঁজিবাজারে মুষ্টিমেয় স্বার্থের প্রতাপ
শেয়ারবাজারের পুরোটাই হলো গুটিকতক লোকের কুক্ষিগত। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার যেন বৈষম্যমূলক বাংলাদেশেরই এক প্রতিচ্ছবি। যদিও সর্বস্তরে সাম্য ও বৈষম্যহীনতার কথা বলা হয়; গুটিকতেক কোম্পানির হাতে শতকরা ৮০ ভাগ বাজার মূলধন রয়েছে। পুরো বাজারে তাদের পুঁজিই ৮০ ভাগ। বড় লেনদেনের ৮০ ভাগও করেন তাঁরাই। এ জন্য তাঁরা নিজেদের অনুকূলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। আবার বিনিয়োগকারীদের হিসাবেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের পরিমাণ খুবই কম। এর কারণে তাঁরা মুষ্টিমেয়র কাছে বন্দী। বাজারের ওঠানামায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা নেই বললেই চলে।
এখানে বৈষম্য প্রকট এবং এই কাঠামোগত সমস্যাকে জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টা সর্বভাবে বিরাজমান। যেমন: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক এক সাম্প্রতিক সার্কুলারে জানাচ্ছে, স্বতন্ত্র পরিচালক ব্যতীত সব পরিচালকের জনপ্রতি পরিশোধিত মূলধনের ২ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এই শর্ত থাকতেই পারে। কাজির গরুর গোয়ালে থাকার সুযোগ ছিল, কিন্তু এখন প্রবিধানের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারী যাতে কখনোই পরিচালন পরিষদে না যেতে পারেন, তার ব্যবস্থা পোক্ত করা হয়েছে। যেমন পাবলিক প্রতিনিধি হতে হলে প্রচুর অর্থ দরকার হয়।
বারবার সিকিউরিটি কমিশন থেকে বলা হয়েছে, যাঁরা বাজারে দখলিস্বত্ব কায়েম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কমিটি করা হলেও কোনো ব্যবস্থা কখনোই নেওয়া হয়নি। এবারও দুই হাজার বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে খোঁজখবরের কথা বলা হয়েছে।
এত বেশি জিডিপির দেশে পুঁজিবাজার এত ছোট হবে কেন? পৃথিবীর সব পুঁজিবাজারেই সব ধরনের কোম্পানির তালিকাভুক্তির চেষ্টা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করা হয় না। করা হলে এটা সর্বজনের মুক্তবাজার হতে পারত। পরিণামে তথাকথিত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সঙ্গে পুঁজিবাজারের আকারের মিল থাকত।
অধিকন্তু, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য যে তহবিল করা হয়েছিল, সেই তহবিলের ছাড়প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা বাজারে কোনো প্রভাব ফেলেনি। একইভাবে বাজেটে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে খুব একটা কাজে লাগেনি।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা ও জবাবদিহির অভাব
একের পর এক শেয়ারবাজারে কেলেঙ্কারি চলছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কারণগুলো চিহ্নিত করা হয়, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের কেলেঙ্কারি বহুল আলোচিত। এই দুই কেলেঙ্কারির পর জনমতের চাপে ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারের উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যথারীতি তদন্ত প্রতিবেদন জমা করা হয় এবং অনেক নামীদামি ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়। প্রথম আলো জানাচ্ছে, দুই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় ১৫টি আর ২০১০ সালের ঘটনায় দুটি মামলা। ১৭টি মামলার মধ্যে সাজা হয়েছে কেবল ১৯৯৬ সালের একটি মামলায়। আর বিচার চলমান আছে অপর একটি মামলার। বাকি ১৫টি মামলার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। এসব মামলার বিচারিক কার্যক্রমের ওপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির ঘটনায় গঠিত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে অনিয়ম ও অপরাধের বেশ কিছু তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরলেও মাত্র দুটি মামলা হয়েছে।
কোনো রকম সাজা না হওয়ায় এভাবে কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জানেন, অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়। ফলে, ভয়ভীতি সঞ্চারের বদলে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পুঁজি পাচারেও শশব্যস্ত থাকেন। বিচারহীনতা বজায় থাকায় এবং জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার অনুপস্থিতিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও একধরনের আস্থাহীনতা বজায় থাকে।
পুঁজির দুটি উৎসেরই দম বন্ধ হয়ে আসছে
বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় আমানত কমে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে নেওয়া ধার বাড়ছে। এতে তাদের ঋণ বিতরণ ও লিজ অর্থায়নের পরিমাণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেই এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের দরপতনকে দীর্ঘ মেয়াদে দেখারও কোনো দৃষ্টি লক্ষণীয় নয়। বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় স্থবির রয়েছে। কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য কমানোর জন্য প্রয়োজন উৎপাদন সক্ষমতার বৃদ্ধি। উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে এবং রপ্তানি-বাণিজ্যের বহুমুখীকরণের জন্য পুঁজির দরকার হয়। মূলধন পুঁজি সাধারণত পুঁজিবাজার থেকে আসার কথা। আর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা চলতি মূলধন আসে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। পুঁজি তৈরির এবং পুঁজি সরবরাহের দুটি উৎসই আজ মারাত্মক নড়বড়ে এবং খাদের কিনারে। এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত উত্তরণ না ঘটলে আমাদের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ শুধু সুদূরপরাহতই হবে না, বর্তমান সন্তুষ্টিও কর্পূরের মতো উবে যেতে বাধ্য।
পুঁজি তৈরি ও সরবরাহে মারাত্মক বিভ্রাটের পাশাপাশি তুমুল গতিতে পুঁজি পাচার হচ্ছে। এ জন্যই প্রবৃদ্ধি চললেও তা কর্মসংস্থানহীন সৃষ্টি করছে না। মূল সমস্যা হলো পুঁজির দুটি উৎসেরই শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।
এ অবস্থাকে নিছক অনিয়ম-দুর্নীতির সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। এটা স্পষ্টত গোষ্ঠীতান্ত্রিক সুবিধাভোগীদের পরিকল্পিত কাজ; আর প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতার অনিবার্য ফল। এর মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কুফল পরিমাপ করে এই অধোগতি থামানোর কোনো কার্যকর চেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে না।
এদিকে কর্মসংস্থান নেই, দারিদ্র্য কমার হার কমে গেছে, প্রতিষ্ঠান ভেঙে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে না যদি পুঁজি সরবরাহ বজায় না থাকে। এতে করে অর্থনীতির মৌলভিত্তি বা বনিয়াদই ঝুঁকিতে থাকবে। গোষ্ঠীতন্ত্র অর্থনীতির বনিয়াদকেই যেভাবে ঝুঁকিতে ফেলছে, তাতে করে ভবিষ্যৎ নিয়ে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারপারসন, উন্নয়ন অন্বেষণ।
আগামীকাল সকালে দেখুন: উচ্চ প্রবৃদ্ধি: কেতাবে আছে গোয়ালে কই?