র্যাগ–ডে ও র্যাগিং। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিচিত দুটি শব্দ। শব্দ দুটির ব্যবহার আলাদা। যদিও অনেকেই গুলিয়ে ফেলি। এর একটি আনন্দের। অন্যটি বেদনার। যেখানে আনন্দের র্যাগ–ডে সাধারণত শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শেষে পালন করেন, সেখানে র্যাগিং শুরু বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতে। শ্রেণিকক্ষে, ক্যাম্পাসের আনাচকানাচে বা হলের অতিথিকক্ষে পরিচয়ের নামে, আদবকায়দার নামে নবীন শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় র্যাগ। র্যাগিং নামে ডাকা এ অপসংস্কৃতি বাস্তবে মানসিক ও শারীরিক এক নির্যাতনের নাম।
যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিংয়ের কথা শোনা যায়, তার মধ্যে ভয়ংকরতম ঘটনাগুলো ঘটে ছাত্রাবাসের (হল) অতিথিকক্ষে। যা ‘গেস্টরুম কালচার’ নামে ডাকা হয়। মূলত রাজনৈতিক আদবকায়দা শেখানোর নামে শারীরিকভাবে নির্যাতন চালানো হয় সেখানে। ‘বড় ভাইদের’ কক্ষে ডেকেও এ ধরনের আদবকায়দা শেখানো হয়। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যায়, বেশির ভাগ র্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত থাকেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। হয়তো গ্রাম থেকে উঠে আসা সহজ-সরল ছেলেরা (মেয়েরাও) তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। এর ফলও বেশ দেখা যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের যতসংখ্যক নেতা-কর্মী থাকেন, ঠিক তার কয়েক গুণ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায় তাঁদের কর্মসূচিগুলোতে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এত সমর্থক আসে কোথা থেকে? মূলত গেস্টরুম কালচার, র্যাগিং, বড় ভাই সংস্কৃতির মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বশে রাখেন ক্ষমতাসীনেরা। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাঁরা কক্ষ বরাদ্দের নামে শিক্ষার্থীদের বশে রাখেন। বশে রাখেন ভয়ভীতি-হামলা-মামলার মাধ্যমে।
র্যাগিংয়ে যা করা হয়
র্যাগিংয়ে নবীনদের শেখানো হয় কীভাবে নিজেদের পরিচয় দিতে হয়, বড়দের সালাম-সম্মান দিতে হয়, দাঁড়াতে হয়, হাসতে হয় ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে এসব ভালো শোনা গেলেও বাস্তবে ভিন্নতাই বেশি। এক পায়ে দাঁড় করানো, জানালার সঙ্গে ঝুলে থাকা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে কক্ষ পরিমাপ, চায়ের চামচ দিয়ে পানিভর্তি বালতি খালি করা, এক হাতে বৈদ্যুতিক বাতি আর অন্য হাতে পানির ট্যাপ ঘোরানোর মতো করে নৃত্য করা—এগুলো ‘র্যাগারদের’ কাছে র্যাগিংয়ের সাধারণ ও সেকেলে ঘটনা। শারীরিক চর্চার পাশাপাশি শেখানো হয় বিভিন্ন ধরনের বুলি। এর মধ্যে বিভিন্ন বর্গীয় শব্দ দিয়ে নামতা বলানো অন্যতম। এ ছাড়া অভিনয়ের নামে অসমর্থনযোগ্য অঙ্গভঙ্গিও করানো হয় উপস্থিত শিক্ষার্থী ও ‘বড় ভাইদের’ সামনে। এ তো গেল সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীকে দিয়ে স্বনির্যাতনের ঘটনা। এর বাইরে ‘বড় ভাইয়েরা’ নিজেরাও আদব শিখিয়ে থাকেন। এর মধ্যে চড়থাপ্পড়, লাঠি-রড পেটার ঘটনাও ঘটে। শীতকালে কক্ষের বাইরে রাতযাপন আর পানিতে নামিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের যতসংখ্যক নেতা-কর্মী থাকেন, ঠিক তার কয়েক গুণ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি দেখা যায় তাঁদের কর্মসূচিগুলোতে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এত সমর্থক আসে কোথা থেকে? মূলত গেস্টরুম কালচার, র্যাগিং, বড় ভাই সংস্কৃতির মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বশে রাখেন ক্ষমতাসীনেরা। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলো ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
গেস্টরুম কালচারের সময়
সাধারণত গেস্টরুম কালচার ও বড় বড় র্যাগিংয়ের ঘটনা শুরু হয় একটু রাত বা মধ্যরাতে। চলে ভোররাত পর্যন্ত। চারপাশ যখন নিস্তব্ধ, তখন শুরু হয় এই ‘মহাকর্ম’। নির্যাতিতের মর্মে কিংবা চর্মে কী হয়, তা চারপাশের কেউ জানতে পারে না। আবার কেউ টের পেলেও টুঁ শব্দ করার সাহস থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলগুলো পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। প্রাধ্যক্ষের নেতৃত্বে এই দলে হাউস টিউটর ও ওয়ার্ডেনরা থাকেন। কিন্তু রাজনৈতিক চর্চা রয়েছে এমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাস্তবে তাঁদের কার্যক্রম দেখা যায় না। হলের খবরদারি প্রাধ্যক্ষ পর্ষদ না করে, করে থাকেন ক্ষমতাসীনেরা। এই শিক্ষকেরা গেস্টরুম কালচার সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলেও থাকেন নিশ্চুপ। কারণ, বর্তমানে এ ধরনের পদগুলোতেও দলীয় বৃত্তের শিক্ষকদের দেওয়া হয়। যাঁদের অনেককেই ক্ষমতাসীনদের অপকর্মের বৈধতা দিতে দেখা যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কখনো কখনো অভিযোগ দিলেও তাঁদের ইনিয়েবিনিয়ে বিষয়টি হালকা করতে দেখা যায়।
রুটিন দায়িত্বের অংশ হিসেবে নবীন শিক্ষার্থীদের হলের গণরুমে দেখতে আসেন শিক্ষকেরা। কিন্তু নবীন শিক্ষার্থীদের সাহস হয় না একটু আগে তাঁদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হয়েছে, তা বলার। শিক্ষকেরা আসার আগেই এসব শিক্ষার্থীকে ক্ষমতাবানেরা সতর্ক করে দেন কোনো ধরনের অভিযোগ না করতে। এর পর কার কলিজার এত পাটা যে ‘ভাইদের’ বিষয়ে কোনো অভিযোগ দেয়? সাধারণত কখনো দু-চারটি সংবাদ প্রকাশিত হয় সংবাদকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী ও ক্ষমতাসীনদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কল্যাণে। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ থেকেই র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির কথা বলা হয়। শিক্ষক সমিতিগুলোও এসবের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকে। তারপরও কেন যেন কাজির গরু কেতাবেই থাকে, গোয়ালে থাকে না।
র্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা
সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে র্যাগিংয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ভর্তি পরীক্ষার আগের দিন অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা একজন ছেলের সঙ্গে করা পরিচয় হওয়ার নামে সেই উগ্র আচরণ আজীবন মনে থাকারই কথা। র্যাগ-দাতাদের নাম–চেহারা মনে আছে এক যুগ পরও। দ্বিতীয় র্যাগিংয়ের সঙ্গে পরিচয় ঘটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘গণরুমে’ থাকতে গিয়ে। ক্ষমতাসীনদের দলের নেতাকর্মীরা রাতে এসে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সাজেশন পেপার জোর করে কিনতে বাধ্য করত। ১০ পৃষ্ঠার, পাঁচ পৃষ্ঠার চোথা কিনতে হয়েছে কয়েক শ টাকা দিয়ে। কেউ কিনতে না চাইলে গালিগালাজ করতো, সঙ্গে রাজনৈতিক অপবাদ দেওয়ার হুমকি। ভীতিকর সেই অভিজ্ঞতাও কখনো ভুলতে পারি না, র্যাগ–দাতাদের নামও।
শাহজালালে এক মাস ছাত্র থাকার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা হয়। সেখানেও পরিচয় ঘটে এই অপসংস্কৃতির সঙ্গে। শুধু র্যাগিংয়ের ভয়ে প্রথম কয়েক মাস বোনের বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে যাতায়াত করতে হয়েছে। পরে প্রথম বর্ষেই একটি জাতীয় দৈনিকের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করি। হয়তো এ কারণে ক্ষমতাসীনেরা একটু পরোয়া করেই চলতেন। তবে অনেক বন্ধুর সঙ্গে ভয়াবহ রকমের ঘটনা ঘটেছে। দিন শেষে অনেকেই এমন আচরণকে ‘সম্প্রীতির সেতু’ বলে আখ্যা দিতে চাইলেও, তা কখনোই সম্প্রীতির নিয়ামক হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরা। তাঁদের আচরণ ও শব্দচয়নে সাবলীলতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এর বিপরীত সবকিছুই অগ্রহণযোগ্য। নিজের পরিচিত অনেক গেস্টরুম র্যাগারকে এখন বিসিএস অ্যাডমিন, পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির পেশায় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাঁদের অনেকে আজও আচরণ পাল্টাতে পারেননি। আবার অনেকেই পরবর্তী সময় নিজেদের শুধরে নিয়েছেন।
র্যাগিংয়ের কারণে যে ক্ষতি হয়
র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হতে পারে কি না, তা জানতে মনোচিকিৎসক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলালের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি জানান, র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হওয়া ব্যক্তিরা তিন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। এক. তাঁরা উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতায় ভোগেন এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। দুই. ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যতে তাঁদের সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। তিন. যাঁরা র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হন, ভবিষ্যতে তাঁরাও অন্যকে র্যাগ দিয়ে থাকেন—তা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে। তাঁদের মধ্যে একটি ‘নিপীড়ক’ তৈরি হয়। আহমেদ হেলাল জানান, তিনটি ঘটনাই একই ব্যক্তির মধ্যে ঘটবে না। কারও কারও মধ্যে ঘটবে।
র্যাগিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তন করার ঢের উদাহরণ রয়েছে। এমনকি মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে জোরালো। যেমনটি উঠেছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লার মৃত্যুর পর। ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার পূর্ব শ্যামপুর গ্রামের অটোরিকশাচালক বাবার এ সন্তানের নিউমোনিয়া ও টাইফয়েড ধরা পড়ে। পরিবারের অভিযোগ, শীতের মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের বারান্দায় থাকা এবং প্রায় রাতে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজুর ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
র্যাগিংয়ের কারণে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা প্রতিবছরই কমবেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে আসছে। সর্বশেষ আলোচনায় রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আকতারুল ইসলামের নিপীড়নের ঘটনা। অভিযোগ, অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগের কিছু কর্মী অতিথিকক্ষে নিয়ে তাঁকে বাতির দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করেন। এতে তিনি জ্ঞান হারান।
র্যাগিং বন্ধে যা করা যায়
র্যাগিংয়ের দায়ে প্রতিবছরই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে সাময়িক বহিষ্কারের কথা শোনা যায়। এ কাতারে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও রয়েছেন। অর্থাৎ র্যাগ শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও দিয়ে থাকেন। সেই হিসেবে এটিকে লিঙ্গনিরপেক্ষ অপরাধই বলা যায়।
এ পচন ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়—সবার উদ্যোগ জরুরি। কোনো শিক্ষার্থী এমন অপরাধ করলে তাঁকে দ্রুত শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শুধু নামকাওয়াস্তে হল থেকে বহিষ্কারে র্যাগিং কখনো বন্ধ হবে না। তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে কঠোর শাস্তি না হলে পরিস্থিতি কখনো বদলাবে না। মানসিকভাবে কাউন্সেলিং করাও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল রয়েছে। তেমনি স্বতন্ত্র কাঠামোয় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংবিরোধী সেল গঠন করা যেতে পারে।
তবে এ অপসংস্কৃতি অপসারণ করতে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। সেটি করতে না পারলে র্যাগিং বন্ধে যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, তা মাঠে মারা যেতে বাধ্য।
মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক