গুয়ানতানামোয় যুক্তরাষ্ট্রের বানানো বন্দিশালা বন্ধের দাবিতে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ
গুয়ানতানামোয় যুক্তরাষ্ট্রের বানানো বন্দিশালা বন্ধের দাবিতে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ

মতামত

গুয়ানতানামো কারাগারে কাটানো আমার ১৪ বছর

২০০১ সালের শরৎকালে আফগানিস্তানে সফরে গিয়েছিলাম। আচমকা সেখানকার স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতারা আমাকে অপহরণ করল। তারা আমাকে ‘সিনিয়র মিসরীয় আল–কায়েদা নেতা’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘বেচে দিল’। তখন আমার বয়স ১৮ বছর। ২০০২ সালে আমাকে গুয়ানতানামো কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

অন্য অনেক কয়েদির মতো আমিও প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না আমাকে কোথায় আনা হয়েছে, কেন তারা আমাকে বিরতিহীনভাবে মারছে, কেন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে। আমি যা বলছিলাম, তার কিছুই তারা বিশ্বাস করছিল না। টানা ১৪ বছর কয়েদখানায় থাকতে থাকতে সেটিই আমার বেড়ে ওঠার জগৎ হয়ে উঠেছিল। আমি কারাগারে যে অবস্থায়ই থেকেছি, সব সময় আমি নৈতিকতা ও সদাচরণবিষয়ক আমাদের নবী (সা.)–এর সেই হাদিসের কথা মনে রেখেছিলাম। আমাদের কারাগারের এক সেল থেকে আরেক সেলে নেওয়া হতো, মাঝেমধ্যে নির্জন কারাকক্ষে পাঠানো হতো। এর মধ্য দিয়ে এক কয়েদির সঙ্গে আরেক কয়েদির দেখা হতো, পরিচয় হতো। শিগগিরই আমাদের মধ্যে আন্তরিক বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। একসময় এটিকে আমাদের সবার পরিবার বলে মনে হতো।

২০১০ সালে আমাদের ৬ নম্বর ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। সেখানে ক্যাম্প রুল বেশ শিথিল ছিল এবং একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি স্বাধীনতা পেতাম। ক্যাম্পের স্টাফদের সঙ্গেও আমাদের কথাবার্তা হতো। আগে নির্জন কক্ষে আলাদাভাবে নামাজ পড়তে হতো। এবার আমরা মসজিদের মতো করে জামাতে নামাজ পড়ার সুযোগ পেলাম। আগে নিজের প্রকোষ্ঠে একা একা খাবার খেতে হতো, এবার আমরা পরিবারের মতোই একসঙ্গে খেতে বসার সুযোগ পেলাম। মাঝেমধ্যে এখানে আমাদের ফুটবল খেলার সুযোগও দেওয়া হতো। আগে কারাকক্ষে সঙ্গী কয়েদির সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, এবার অনেকে একসঙ্গে বসে আলাপ–আলোচনার সুযোগ পেলাম। আমাদের কিছুই ছিল না, কিন্তু আমরা একজন আরেকজনের জন্য ছিলাম ভাইস্বরূপ। কয়েদিরা একজন আরেকজনকে ‘আমাদের আফগান ভাইয়েরা’, ‘আমাদের ইয়েমেনি ভাইয়েরা’—এভাবে সম্বোধন করতেন। আমরা একজনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আরেকজন পরিচিত হচ্ছিলাম। আমরা পরস্পরের ঐতিহ্যগত আচরণ রপ্ত করার চেষ্টা করছিলাম। একপর্যায়ে দেখা গেল, আরবরা আফগানদের মতো এবং আফগানরা আরবদের মতো আচরণ শুরু করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা প্রায়ই আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করত। একদিন জিজ্ঞাসাবাদকারীরা আমাকে মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ করার জন্য আফগান ব্লকে পাঠিয়ে দিল। তারা ভেবেছিল, সেখানে যেহেতু কোনো আরব নেই, সেহেতু আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারব না। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, এটিই আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। একে তো আমি বয়সে ছোট ছিলাম, তার ওপর তাদের মতো আফগান নই। আমি যেহেতু আরব, সেহেতু তারা আমাকে অতিথির মর্যাদা দিল এবং বাড়তি আদর যত্ন করতে লাগল। একসময় তারা আমাকে পরিবারের সদস্যের মতো গ্রহণ করল। এই সময়টাতে আমি আফগান বন্দীদের আরবি ভাষা শেখাতে লাগলাম। সেখানে একজন আফগান কবি ও সংগীতশিল্পী ছিলেন। ষাটের কোঠার ওই ভদ্রলোক কারাগারে বসে পশতু ভাষায় অনেক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি খুব মিষ্টি করে স্বরচিত কবিতায় সুর লাগিয়ে গাইতেন। অন্যদের মতো আমিও তঁার গীতিকবিতা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

যেসব ক্যাম্পে আরব কয়েদিরা বেশি ছিল, সেসব ক্যাম্পে নির্যাতন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ বেশি হতো। গোড়ার দিকে বেশির ভাগ আফগান ও অন্য জাতীয়তার লোকজন তাদের সঙ্গে শামিল হতো না। এটিকে কারা কর্তৃপক্ষ সুযোগ হিসেবে নিয়ে একজনের নামে আরেকজনকে খেপিয়ে তুলতে চাইত।

জিজ্ঞাসাবাদকারীরা আসলে আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধের বিষয়টি বুঝতেই পারছিল না। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা যখন আমাদের কোনো এক ভাইকে নির্যাতন করত, তখন আমাদের বেশির ভাগ কয়েদিই নিরাপত্তা প্রহরীসহ অন্য স্টাফদের সঙ্গে কথা বলত না।

কয়েক দিন মন খারাপ করে থাকত। অথচ আমরা কিন্তু পূর্বপরিকল্পিতভাবে কারারক্ষীদের সঙ্গে কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমাদের কোনো এক ভাইকে নির্যাতন করছে, এটা জানার পর এমনিই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমরা কথা বলা বন্ধ করে দিতাম।

কখনো কখনো আমরা আনন্দ উদ্‌্‌যাপনও করতাম। বিশেষ করে যখন কারও ছেলে বা মেয়ের বিয়ে হয়েছে বা কারও নাতি বা নাতনি হয়েছে বলে খবর আসত, তখন খুব উৎসবমুখর মনোভাবে থাকতাম। শুক্রবার সবাই জুমার নামাজ পড়তাম। রমজানে রোজা রাখতাম এবং ঈদের দিন কোলাকুলি করতাম। যখন কোনো কয়েদিকে গুয়ানতানামো থেকে মুক্তি দেওয়া হতো, তখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ করতাম।

আমাদের এ ধরনের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আচরণ দেখে ক্যাম্পের রক্ষীরা এবং অন্য স্টাফরা ধাক্কা খেত। এ কারাগারে দায়িত্ব পালনের জন্য যখন কাউকে পাঠানো হতো, তখন তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হতো—তারা এমন সব ভয়ংকর খুনি, দানব ও সন্ত্রাসীদের পাহারা দিতে যাচ্ছে, যারা একমুহূর্তের মধ্যে তাদের ঘাড় মটকে ফেলার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু সেই রক্ষীরা যখন আমাদের কাছে আসে এবং কথা বলতে শুরু করে, তখন তাদের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল পায় না। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে গার্ডদের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এমনকি গার্ডদের অনেকেই কয়েদিদের এ অদ্ভুত সদাচার দেখে মুসলমান হয়ে গেছে।

এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল। পরস্পরের প্রতি ভাইসুলভ যে মনোভঙ্গি, তার শক্তি যে সীমাহীন, তা আজ আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

মনসুর আদাইফি ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত একজন লেখক, শিল্পী, অধিকারকর্মী এবং গুয়ানতানামো কারাগারে বিনা বিচারে ১৪ বছর আটক থাকা একজন প্রাক্তন কয়েদি। ২০১৬ সালে আদাইফিকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং সেখানে তিনি তাঁর নামের সঙ্গে অলিখিতভাবে যুক্ত হয়ে যাওয়া ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’ তকমা মুছে ফেলার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। সামাজিক ন্যায়বিচারসংক্রান্ত সাংবাদিতা নিয়ে লেখা নন ফিকশনের জন্য ২০১৯ সালে আদাইফি রিচার্ড জে মার্গোলিস পুরস্কার পান। গুয়ানতানামো কারাগারের বন্দিজীবন নিয়ে স্মৃতিচারণামূলক বই ডোন্ট ফরগেট আস এবং ফাউন্ড অ্যাট গুয়ানতানামো—এই দুটি বই ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়।