ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা শাকিল উজ্জামানকে এ বছরের ২৬ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেইরি গেট থেকে র্যাব পরিচয়ে কয়েকজন ধরে নিয়ে যায়। এরপর তিন দিন শাকিল নিখোঁজ ছিলেন। শাকিলের পরিবার, স্বজনেরা, থানা-পুলিশের কাছে জানানোর পরও শাকিলের সন্ধান পাননি। পরে শাকিল জানিয়েছিলেন, ওই সময় অপহরণকারীরা গামছা দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ও জম টুপি পরিয়ে প্রতি রাতে গাড়িতে করে ঘোরানো হয়েছে রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত। তাঁর ভাষ্যমতে, আটকের তিন দিন পর তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র্যাব। ইউটিউবে প্রচারিত একটি ভিডিওতে শাকিল এসব অভিযোগ করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, অজ্ঞাত স্থানে বন্দী অবস্থায় তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে মারধর করা হয়। ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। বুট দিয়ে তাঁর পা পিষে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের হাতে হস্তান্তর করার আগে যে তিন দিন শাকিল ‘অজ্ঞাতবাসে’ ছিলেন তাঁকে তিনি ‘গুম’ বলে অভিযোগ করেছেন।
শাকিল নিকট অতীতে ‘গুম’ হওয়া অনেকের একজন মাত্র। গত শতক বিশ্বে গুমের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। আর আমাদের দেশে গত দশক গুমের ভয়াবহতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। শাকিলের মতো গুম হওয়া অজস্র মানুষ হারিয়ে গেছেন চিরতরে। শাকিলের ভাগ্য ভালো। শেষ পর্যন্ত জেলের ঘানি টেনে তিনি ফিরে এসেছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা হঠাৎ নিখোঁজ হওয়া ৮৬ জন আর ফিরে আসেননি বলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সম্প্রতি জানিয়েছে।
স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর হিসাবে এ সংখ্যা আরও বেশি। তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে, ১৫৩ জন এখনো নিখোঁজ। ওই সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৬৯ জন ফিরে এসেছেন। আর মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ৮১ জনকে। অধিকার র্যাবের বিরুদ্ধে ১৮৯ জনকে গুম করার অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, আনসার পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুমের সঙ্গে জড়িত বলেও অধিকার অভিযোগ করে আসছে। যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। শাকিলের অভিযোগ বা অধিকারের প্রতিবেদন ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেই অভিযোগের তির নিক্ষেপ করছেন কমবেশি সবাই।
শাসকেরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজ দেশের নাগরিকদের যেমন গুম করে, আবার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতেও গুমের মতো নির্মম পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কখনোই আর খোঁজ পাওয়া না গেলেও ছায়া হয়ে সবাইকেই তাড়া করে ফেরে।
জনমনে প্রতিষ্ঠিত ধারণা, রাষ্ট্রজুড়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করতে নাগরিকদের গুম করে দেওয়ার অতি পুরোনো কৌশল অবলম্বন করছে দেশের বিভিন্ন বাহিনী। আইনগত জটিলতা এড়ানোর জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের গুম করা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গুম, যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে নুরেমবার্গ ট্রায়ালসহ মানবাধিকারবিষয়ক একাধিক কনভেনশন ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো আন্তর্জাতিক আদালতে সাজার ভয়ে নাগরিকদের আটক করে নির্যাতন বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পথ থেকে সরে আসে। কিন্তু এতে রাষ্ট্রের অত্যাচারী চরিত্রের খুব বেশি বদল হয়নি। বরং ভিন্নমত ও চিন্তাকে দমনের নতুন কৌশল অবলম্বন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গুমের মতো ভয়াবহ কৌশল বাস্তবায়নের পথিকৃৎ হিসেবে ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা হয়। আলজেরিয়ার স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী গণহারে গুমের কৌশল অবলম্বন করে। আর ওদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাম বিপ্লবীদের দমাতে লাতিন সরকারগুলোকে ফরাসি সরকারের গুমের ধারণা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। মানবতাবিরোধী ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অপরাধের এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুসারে ৯১টি দেশের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ রয়েছে।
শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করে রাখার অপরাজনীতির ফলাফল হচ্ছে রাষ্ট্রীয় গুম বা বলপূর্বক নিখোঁজ করা। শাসকেরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য নিজ দেশের নাগরিকদের যেমন গুম করে, আবার আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধিতেও গুমের মতো নির্মম পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়। গুম হওয়া ব্যক্তিদের কখনোই আর খোঁজ পাওয়া না গেলেও ছায়া হয়ে সবাইকেই তাড়া করে ফেরে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজন, পরিজনের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘায়িত হতেই থাকে। চিরদিনের মতো ছবি হয়ে যান নিখোঁজ ব্যক্তিরা। আমাদের দেশেও রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, অধিকারকর্মীদের গুম করার অসংখ্য নজির আছে।
গুমের মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রভাব আরও ভয়াবহ। দেশে গুম হওয়া ব্যক্তির স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা পরিবারের সদস্যরা অর্জন করতে পারছেন না। কারণ, ওই ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা না করায় স্ত্রী, স্বামী ও সন্তানেরা উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারেন না। আবার তাঁদের মৃতও ঘোষণা করা হয় না। ফলে সম্পত্তি নিয়ে নানা ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাও হস্তান্তর করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রেই সম্পত্তি বেহাত হওয়ার শঙ্কা থাকে। সব মিলিয়ে গুমের যন্ত্রণা ছাড়াও সহায়-সম্পত্তি নিয়ে এক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবারগুলো।
যে কোনো শাসকেরই উচিত গুমের মতো ঘটনা ঘটানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং নির্মম ও মানবতাবিরোধী এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসা। কারণ, সময় ও পরিস্থিতি সব সময় এক থাকে না এবং পরিস্থিতির বদল হলে গোপন অনেক কিছুই প্রকাশিত হয়ে যায়।
তবে গুম, নির্যাতন করেও শেষ রক্ষা হয় না শাসকদের। গত শতকে গুম বা বলপূর্বক নিখোঁজ করার সঙ্গে জড়িত শাসকদের কমবেশি সবাই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনাই প্রথম সামরিক জান্তা জেনারেল হোর্হে ভিদালের বিচার শুরু করে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত বামপন্থী কর্মী, বিরোধী মত ও সাধারণ নাগরিককে হত্যা-নির্যাতন ও গুমের অভিযোগে। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে আদালত সামরিক কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে। জেনারেল ভিদালেকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত। তবে পরবর্তী দুই প্রেসিডেন্ট তাঁর সাজা বাতিল করেন এবং সামরিক কর্মকর্তাদের বিচার থেকে অব্যাহতি দেয়। ২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট নেস্টর ক্রিসনার আর্জেন্টিনার সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পরিবর্তন করে নতুন বিচারক নিয়োগ দেন। ২০০৫ সালে অপরাধীদের সাজা মওকুফ বাতিল করেন আদালত। ২০০৭ সালে পুনরায় বিচার শুরুর আদেশ দেন বিচারকেরা। ২০১২ সালে ভিদালেকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতার সন্তান অপহরণ ও গুমের দায়ে ৫০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। ২০১২ সালে কারাগারে মারা যান ভিদালে।
চিলির জেনারেল আউগুস্তে পিনোশে নির্বিচারে বিরোধী কর্মীদের গুম করা কুখ্যাত শাসকদের একজন। পিনোশেও বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু মামলার রায় হাওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৯৮ সালে পিনোশে ব্রিটেন সফরে গেলে স্পেন সরকারের অনুরোধে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার আটক করে। পিনোশের বিরুদ্ধে স্পেনের নাগরিকদের চিলিতে নির্যাতনের অভিযোগ করে স্পেনের সরকার। পরে ব্রিটিশ আদালত তাঁকে শারীরিকভাবে অক্ষম চিহ্নিত করে বিচারের অযোগ্য ঘোষণা করেন। ২০০০ সালে তিনি দেশে ফেরার অনুমতি পান। পিনোশে আটক হওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র পিনোশের আমলের গুম ও নিখোঁজসংক্রান্ত গোপন দলিল প্রকাশ শুরু করে। ওই সব দলিলে অপারেশন কনডোরের বিস্তারিত তথ্য ছিল।
ওদিকে চিলিতেও তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু ২০০০ সালে দেশে ফিরে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচার থেকে অব্যাহতি পান। ২০০২ সালে চিলির সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। পিনোশে আজীবনের জন্য সিনেটরের আসন থেকে পদত্যাগ করেন। তবে ২০০৪ সালে ঘটনার মোড় আবার ঘুরে যায়। চিলির ন্যাশনাল কমিশন অব পলিটিক্যাল ইমপ্রিজনমেন্ট অ্যান্ড টর্চার এক প্রতিবেদনে জানায়, পিনোশের আমলে ৩৫ হাজার মানুষকে হত্যা, গুম ও নির্যাতন করা হয়েছে। চিলির সুপ্রিম কোর্ট সর্বসম্মতভাবে পিনোশের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও বিচারবহির্ভূতভাবে নাগরিকদের গুম করে দেওয়ার অভিযোগ গঠন করেন। আদালত একই সঙ্গে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সুস্থ হিসেবেও ঘোষণা করেন। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগেই ২০০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন পিনোশে।
২০০০ সালে পেরুর প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফুজিমরি জাপানে থাকা অবস্থাতেই পদত্যাগ করেন সম্ভাব্য বিচারের ভয়ে। কিন্তু ফুজিমরিকে ২০০৫ সালে চিলিতে আটক করা হয়। এর দুই বছর পর পেরুতে ফেরত পাঠানো হয়। ২০০৯ সালে পেরুর আদালতে ২৫ বছরের জেল দেওয়া হয় বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও গুমের অভিযোগে।
গুয়াতেমালার সাবেক প্রেসিডেন্ট এফরেইন রিউস মনট্টকে দেশটির একটি আদালত ২০১৩ সালে ৮০ বছরের কারাদণ্ড দেন গুম ও খুনের দায়ে। ২০১২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। মনট্টকে ১৯৮২ সালে ২০১ গ্রামবাসীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে আদালত ৮৬ বছরের সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুনঃ শুনানির আদেশ দেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, উল্লিখিত শাসকদের সহকর্মীদের যাঁরা গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরাই পরবর্তী সময়ে সাক্ষী হিসেবে আবির্ভূত হন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা ফোর্সের পরিচালক মাসুদ মাহমুদ হত্যা ও গুমের সাক্ষী দিয়েছিলেন। পিনোশের কথাও উল্লেখ করা যায়। ধারণা করা হয়, অপারেশন কনডোর পরিচালনা করে সালভাদর আয়েন্দের সমর্থকদের দমনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পিনোশেকে গুমের যাবতীয় প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা সরবরাহ করেছিল। কিন্তু পিনোশে গুম ও নির্যাতনের অভিযোগ আটক হলে যুক্তরাষ্ট্রই সব গোপন নথি প্রকাশ করে দেয়।
এসব দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিলে যে কোনো শাসকেরই উচিত গুমের মতো ঘটনা ঘটানোর ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং নির্মম ও মানবতাবিরোধী এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসা। কারণ, সময় ও পরিস্থিতি সব সময় এক থাকে না এবং পরিস্থিতির বদল হলে গোপন অনেক কিছুই প্রকাশিত হয়ে যায়। বরং মাসুদ মাহমুদের মতো সাক্ষী কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। অথবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো সব ফাঁস করে দেয়। নাগরিকের আস্থা ও শক্তিকে পাশ কাটিয়ে, গুম করে, ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে সাময়িকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা যায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচারের কাঠগড়া এড়ানো যায় না।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গুমের রাজনীতি ও খাসোগি গ্রন্থের লেখক