সম্প্রতি ধর্মীয় বক্তা আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ নিখোঁজ হয়েছিলেন। সরকারি ভাষ্যমতে, স্ত্রীদের সঙ্গে মনোমালিন্যের জের ধরে দুই বন্ধু ও ভাড়া করা গাড়ির চালকসহ এক বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন ত্ব-হা। তাঁর অনেক ভক্ত ও অনুসারী আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ত্ব-হা ফিরে আসেন। শুধু ত্ব-হাই না, তাঁর মতো অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন। কয়েকজন ফিরে এসে আর কথা বলছেন না। তবে বড় একটি অংশই আর ফিরে আসেনি। কয়েকজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এর কোনো সুরাহা করতে পারেনি। এক ভয়ংকর অজানা গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে কিছু লোকজন। সরকারও গুমের হাত থেকে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। সবার মধ্যেই চাপা আতঙ্ক, কে কখন হারিয়ে যায়।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কেউ জানে না। দেশে গুম নিয়ে বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার গুমের রাজনীতি থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার গত শতক গুমের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। দুই মহাদেশে মূলত রাষ্ট্রই নাগরিকদের গুম করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারগুলো ডিপ স্টেটকে গুমের কাজে ব্যবহার করেছে। এরা ছিল সরকারের ভেতরে অথবা বাইরে একটি ছায়া সরকার। ডিপ স্টেটে সরকারি ও বেসরকারি লোকজন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেও ডিপ স্টেটের কথা শোনা যায়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্বৈরতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে ডিপ স্টেটের ভূমিকা ও শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
লাতিনের ফ্যাসিস্ট, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো জনগণের রোষ ও বিক্ষোভের দাবানল রুখতে ডিপ স্টেটকে নির্মমভাবে ব্যবহার করেছে। সামরিক বাহিনীর সদস্য, গোয়েন্দা সংস্থা, কূটনৈতিক, আমলা, বড় বড় ব্যবসায়ীদের দিয়ে রাষ্ট্রের ভেতরে ডিপ স্টেট তৈরি হয়েছিল। সরকারগুলো মূলত ডিপ স্টেটের সদস্যদের দিয়েই গুমের অভিযান পরিচালনা করত।
গত শতকের ৬০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতে ডিপ স্টেটের ব্যাপক উত্থান পরিলক্ষিত হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব ডিপ স্টেট সৃষ্টি করা হয়েছিল। অনেকগুলো উদ্দেশ্য নিয়ে এসব ডিপ স্টেট তৈরি করা হয়েছিল। সাধারণভাবে মনে হবে সরকার বিরোধী জনমতকে দমনের জন্য এসব ডিপ স্টেট তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকারকেও নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিপ স্টেটকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় সিআইএ ব্যবহার করেছে।
ওই সময় গণহারে ডিপ স্টেট গুমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তবে গুমের শুরুটা হয়েছিল জার্মানিতে হিটলারের সময়। ১৯৪১ সালে জারি করা নাইট অ্যান্ড ফগ ডিক্রি জারি করে ইহুদিদের ধরে নিয়ে নাৎসি বাহিনী গুম করে দিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিচার শুরু হলে হত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও গুমের অভিযোগে নাৎসিদের বিচার শুরু হলে গুমের কৌশল পরিবর্তন করে সিআইএ। ডিপ স্টেটের মাধ্যমে গুম শুরু করে। কারণ, ইহুদিদের নাৎসিরা সামরিক পোশাকে ধরে নিয়ে যেত। যে কারণে পরে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সাদাপোশাকের ডিপ স্টেটের সদস্যদের গুমের অভিযোগে চিহ্নিত করা কঠিন।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কেউ জানে না। দেশে গুম নিয়ে বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার গুমের রাজনীতি থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার গত শতক গুমের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। দুই মহাদেশে মূলত রাষ্ট্রই নাগরিকদের গুম করেছে।
ডিপ স্টেট দিয়ে গুম পরিচালনার আরেকটি কারণ হচ্ছে মানবাধিকার সংস্থা বা জাতিসংঘের চোখকে ফাঁকি দেওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি নির্মমতার পর সারা বিশ্বেই মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাষ্ট্রীয় নির্যাতন, জেল, জুলুম ও হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছিল। ওই সময় সিআইএর সহায়তায় বিভিন্ন রাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়াতে ব্যাপক হারে ডিপ স্টেটকে দিয়ে গুম শুরু করে। ৬০-এর দশকে গুয়াতেমালায় শুরু। এরপর এল সালভাদর, চিলি, উরুগুয়ে, হন্ডুরাস, কলম্বিয়া, নিকারাগুয়া ও আর্জেন্টিনাতে গুমের ঘটনা বাড়তে থাকে। কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কোনো হদিস মিলছিল না। আলজেরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরব দেশগুলোতেও একই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এসব দেশে ডিপ স্টেটের সদস্যরা কত মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করছে, তার কোনো হিসাব জাতিসংঘসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো দিতে পারেনি।
সন্দেহ করা হয় ওই সব দেশের সামরিক বাহিনী ডিপ স্টেট হিসেবে গণহারে গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল। তবে ডিপ স্টেটের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি আর্জেন্টিনার গণতন্ত্রে উত্তরণের পর পরিষ্কারভাবে জানা যায়।
১৯৮৩ সালে আর্জেন্টিনায় সামরিক শাসনের অবসানের পর সামরিক বাহিনীর ফাইনাল ডকুমেন্ট অন দ্য স্ট্রাগল অ্যাগেইনস্ট সাবভারসন অ্যান্ড টেররিজমে গুমের বিষয়গুলো স্বীকার করা হয়। ওই রিপোর্টে বলা হয়, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা ও বিশেষ সদস্যরা গুমের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং সামরিক বাহিনী কৌশলগত কারণে এটা করতে বাধ্য হয়েছে।
স্বৈরাচারের পতনের পর সামরিক বাহিনী ও সিভিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সব সময় এই ধরনেরই মন্তব্য করে থাকে। লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ স্বৈরশাসক ডিপ স্টেট ও গুমের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এসব দেশে বেশির ভাগ গুমের শিকার হয়েছেন বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা। অথচ বামপন্থী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই গুমের অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে বলে ওই সময়ের বিভিন্ন সরকারি প্রতিবেদন বলা হয়েছে।
নাৎসিরাও একই কথা বলেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। নাৎসিদের বিচার হয়েছে। আর্জেন্টিনা, চিলি, গুয়াতেমালাতেও গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ৮০ দশকের শুরুতে আর্জেন্টিনায় স্কুলশিক্ষককে গুমের সঙ্গে জড়িত এক সামরিক কর্মকর্তা জার্মানি পালিয়ে এসেছিলেন। পরিচয় বদলে জার্মানির নাগরিকত্বও পেয়েছেন। এখন তাঁকে আর্জেন্টিনায় ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ওই সামরিক কর্মকর্তার বিচার করতে চায় আর্জেন্টিনার সরকার। প্রায় ৪০ বছর পর ওই স্কুলশিক্ষকের বোন ভাইকে গুম করার অভিযোগে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। সামরিক বাহিনীর নথি অনুসন্ধান করে ওই সামরিক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
দেখা যাচ্ছে ডিপ স্টেট, গুম, নির্যাতন করে সাময়িকভাবে জনসাধারণকে দমন করা যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার পাওয়া যায় না। যতই সতর্কতার সঙ্গে কঠোরভাবে গুম করা হোক না কেন, তথ্য একসময় প্রকাশ্যে আসবেই। এমনকি দলিল-দস্তাবেজ পুড়িয়ে দিলেও এর দায় থেকে রেহাই পাওয়া যায় না।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক