হঠাৎ করে ঢাকা পরিণত হয়েছে গুজবের শহরে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশই গুজবের কারখানায় পরিণত হয়েছে। গুজব বন্ধের উপায় হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে থাকা মূলধারার গণমাধ্যমকে আরও স্বাধীনতা দেওয়ার বদলে সরকার নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি, সরকারের কট্টর সমর্থক টিভি চ্যানেলও বাদ যায়নি। জনমনে ‘আতঙ্ক এবং জনবিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা’ তৈরির অভিযোগ করা হয়েছে দুটি চ্যানেলের বিরুদ্ধে। সরাসরি সম্প্রচারে উত্তেজনা ছড়ানো সম্প্রচার নীতিমালার পরিপন্থী বলে হুঁশিয়ার করা হয়েছে অন্যদের।
মূলধারার গণমাধ্যমে খবর না পেলে বিকল্প পথে গুজব যে আরও ফুলে ফেঁপে উঠবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। সরকার যখন কী কী ঘটেনি বলে ঘোষণা দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী কী ঘটেছে। গুজবের কারণে সরকার এখন ২৪ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেটে, বিশেষত মোবাইল নেটওয়ার্কে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। সরকারের বহুল বিজ্ঞাপিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে অ্যানালগ যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় বিস্মিত মানুষের মনে যদি প্রশ্ন জাগে, সরকার কিছু গোপন করতে চায় কি না, তাহলে কি সেটা অন্যায় হবে? সাংবাদিকদের ওপর হামলা তো তথ্যপ্রবাহ বন্ধের চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।
সপ্তাহখানেক ধরে ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’-এর চেষ্টা চালাচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। মন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশ-র্যাব এবং শাসনকাজের সঙ্গে যুক্ত সবাই বলে চলেছেন যে বাচ্চারা তাঁদেরকে ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছে এবং সরকার তাদের দাবিমতো ব্যবস্থা নেবে। সরকারের কথায় শিক্ষার্থীরা কেন আস্থা রাখতে পারছে না, সেদিকটিতে নজর না দিয়ে এখন এই আন্দোলনে রাজনীতি খোঁজা শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পাল্টা হিসেবে পরিবহনের মালিকেরা আন্তজেলা গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। কিন্তু গোয়েন্দারা এখন ব্যস্ত বিরোধী দলের রাজনীতিক ও সমালোচকদের টেলিফোনে আড়িপাতায়। কর্মীদের মাঠে নামার নির্দেশ দেওয়ার ওই টেলিফোনকে ষড়যন্ত্র হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ভর করেছে। আন্দোলনকে তারা সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
এ ধরনের জনমুখী আন্দোলনে কোনো রাজনৈতিক দল যদি সমর্থন না দিতে পারে, তাহলে সেই দলের আর রাজনীতি করার প্রয়োজন কী? জনগোষ্ঠীর যেকোনো অংশের যৌক্তিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে না পারলে তাদের বরং অবসরে যাওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময়ে এ রকম বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর আন্দোলনে কী ভূমিকা নিয়েছিল, তা সবাই ভুলে গেছে বলে কি তাঁদের ধারণা? আর, ওই সব আন্দোলন যে তাঁদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কাজে লাগেনি, তা-ও নয়। বরং বলা চলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সামরিক শাসক জিয়ার আমলে যে অরাজনৈতিক নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেটিকে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ লাভবান হয়েছে। দিনাজপুরে পুলিশের দ্বারা ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা, শামসুন্নাহার হলে পুলিশি অভিযান, এনজিও জোটের শাপলা চত্বরের সমাবেশকেন্দ্রিক ট্রাম্প কার্ডের ঘোষণা কিংবা ব্রিটিশ কোম্পানিকে ফুলবাড়ী কয়লাখনির লাইসেন্স দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন—এগুলোর কোনটিতে আওয়ামী লীগ যোগ দেয়নি? যদি সেকালে মোবাইল ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়টি তখনকার শাসকদের জানা থাকত, তাহলে আমরা যে আরও কত নেতার কত ধরনের টেলিফোনের রেকর্ডিং শুনতাম, কে জানে।
তবে, হ্যাঁ, যদি কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা কেউ করে, তবে অবশ্যই সেই ষড়যন্ত্রের বিচার হওয়া উচিত। ফাঁস হওয়া কোনো টেলিফোনে এ রকম কোনো ষড়যন্ত্রের কিছু কি পাওয়া গেছে? সহিংসতার ঘটনা যেগুলো ঘটেছে সেগুলোতে বরং ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অংশগ্রহণের আলামত মিলছে। হঠাৎ করে হেলমেটধারী যুবকেরা হাজির হচ্ছেন এবং শিক্ষার্থীদের মারধর করছেন। এগুলো ঘটছে পুলিশের উপস্থিতিতেই। কোথাও কোথাও শুরু করছেন হেলমেটধারীরা আর শেষ করছে পুলিশ। এসব হামলাকারীকে বিএনপি-জামায়াত হিসেবে অভিহিত করা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে যে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি শেষ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার পর রাস্তায় রাস্তায় হঠাৎ করে হাজির হওয়া তরুণদের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাগুলো স্পষ্টতই নাশকতা। এসব নাশকতাকে আন্দোলন দমনের যৌক্তিকতায় ব্যবহারের চেষ্টা হবে, জানার পর নিশ্চয়ই আন্দোলনকারীরা এ ধরনের হাঙ্গামায় জড়াবে না?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে কয়েক দিন ধরে এমন সব বক্তব্যযুক্ত পোস্টার ছড়ানো হয়েছে যেগুলোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হেয় করা, তারা যাতে আর মানুষের সহানুভূতি না পায় সেই চেষ্টা করা। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরত যাওয়ার কথা বোঝানোর দায়িত্ব ছাত্রলীগকে দেওয়া যে ভিন্ন বার্তা দেয়, সেটা তো আর কারও বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কোটা সংস্কারের আন্দোলন এবং ডাকসু নির্বাচনের আন্দোলনে ছাত্রলীগের ঠ্যাঙ্গাড়ে ভূমিকার কথা সবাই এত দ্রুত ভুলে যাবে কীভাবে?
শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরানোর সহজ পথ ছিল পরিবহন খাতে সব নষ্টের মূলে যাঁরা, তাঁদের মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দেওয়া। মন্ত্রিসভায় থাকার জন্য একটি দৈনিক পত্রিকার মালিক সম্পাদক যদি তাঁর পদ ছাড়তে পারেন, তাহলে শ্রমিক ফেডারেশন এবং মালিক সমিতির সভাপতির পদধারীরা কীভাবে মন্ত্রিসভায় থাকেন? সড়কের নিরাপত্তার জন্য গত জুনে প্রধানমন্ত্রী যেসব নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেগুলো বাস্তবায়নে গত ছয় সপ্তাহে একটি পদক্ষেপও নিতে না পারার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে তো আইন প্রণয়নের প্রয়োজন নেই। ফিটনেসবিহীন এবং মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িগুলো বন্ধের অভিযান শুরু করতেও কি দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়? বেআইনিভাবে কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়া কেউ যানবাহন বন্ধ রাখলে তার রুট পারমিট বাতিলের মতো ব্যবস্থা নেওয়া তো বিদ্যমান আইনে কঠিন কিছু নয়। দুজন সহপাঠীর হত্যার বিচার সময়সাপেক্ষ এবং আইন তৈরির প্রক্রিয়াও রাতারাতি যে শেষ হবে না, সেটা শিক্ষার্থীরা যে বোঝে না, তা নয়। কিন্তু যেসব ব্যবস্থা নিলে আস্থার ঘাটতি এখনই দূর হতে পারে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সরকার যে দলীয় সংকীর্ণতায় ভুগছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ, বাস্তবতা হচ্ছে, মন্ত্রী, সাংসদ, পদস্থ আমলা, পুলিশসহ বিভিন্ন স্তরের ক্ষমতাধর লোকজনের গাড়ির কাগজপত্রে অনিয়ম দেখার পর এসব শিক্ষার্থী সরকারের মুখের কথায় আস্থা রাখবে, এমন চিন্তা অযৌক্তিক। তা ছাড়া, সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের বড়ভাইদের পরিণতির কথা তারা ভুলবে কীভাবে?
আমরা ন্যায়বিচার চাই (উই ওয়ান্ট জাস্টিস) স্লোগানের বিস্তৃতি কিন্তু অনেক ব্যাপক। সম্ভবত সে কারণেই তাদের পোস্টারে লেখা হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের সংস্কার চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত। সময়ক্ষেপণের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়গুলোর কথা মনে পড়তে থাকে, ক্ষোভেরও বিস্তৃতি ঘটে। দেশের অন্যতম প্রাচীন এই দলটির এসব কথা না জানার কথা নয়। ক্ষমতার চৌহদ্দির ভেতরে বসে এসব কথা ভুলে যাওয়া সহজ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক।
কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।