গুজবের রাজনৈতিক অধ্যয়ন কেন জরুরি

শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার সেই চিলকে এখনো আমরা ধাওয়া করে চলেছি। ধর্ম, ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা—এসব কারণে আমরা গুজব বা মিথ্যা রটিয়ে বেড়াই। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে গুজবের গুরুত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে বৈজ্ঞানিকভাবে গুজব নিয়ে গবেষণা করতে হচ্ছে।

গুজবের অন্যতম প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, যখন ছড়ানো হয়, যিনি বা যাঁরা ছড়ান, সব সময়ই দাবি করেন, তিনি যা বলছেন, তা গল্প নয়, ‘তথ্য’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গুজবকে কি আমরা তথ্য বলতে পারি? অবশ্যই না। কারণ, তথ্যের সংজ্ঞায় কেমব্রিজ অভিধান বলছে, ফ্যাক্ট বা প্রকৃত অবস্থা, মানে যেকোনো ব্যক্তি, ঘটনা এবং অবস্থা সম্পর্কে প্রকৃত ধারণাই হলো তথ্য।

আবার ফ্যাক্ট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেমোক্রেটিক সিনেট সদস্য এবং সমাজবিদ ডানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান বলছেন, মতামত নিজস্ব হতেই পারে, কিন্তু ফ্যাক্ট নিজস্ব হতে পারে না। মানে যেকোনো বিষয়ে আপনার নিজের মত থাকতেই পারে, কিন্তু নিজের মতো করে সত্য থাকতে পারে না।

রাজনীতিতে তথ্য ও ঘটনার নিয়ন্ত্রণ এবং এদের ওপর ইচ্ছেমতো প্রভাব বিস্তারের সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পার্সিয়ান রাজা দারিয়ুসের পুত্র জেরক্সেস প্রাচীন গ্রিস জয় করতে অভিযান শুরু করেন। বেশ কিছু যুদ্ধে তিনি জয়লাভও করেন। গ্রিকদের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখন এথেনিয়ান নৌবাহিনীর প্রধান থেমিস্টোক্লেস বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো শুরু করেন। একটি গুজব ছিল দখল করা গ্রিক এলাকার সৈনিকদের জেরক্সেসের বিশ্বাস করা উচিত না।

কারণ, জেরক্সেসের সেনাবাহিনীতে নাম লেখালেও আসল সময়ে এরা ঠিকই বিদ্রোহ করে তাঁকে হারিয়ে দেবে। খুব অল্প সময়েই তাঁর কানে এ গুজব পৌঁছে যায়। কারণ, গুজবের তথ্যসূত্র হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল তাঁরই নির্ভরযোগ্য এক ব্যক্তির নাম। গুজবে কান দিয়ে সালামিজের যুদ্ধে হেরে যান জেরক্সেস। ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর সংঘটিত সেই যুদ্ধ বদলে দেয় পৃথিবীর ইতিহাস। সামান্য গুজবের কাছে যুদ্ধবাজ পেশিশক্তি হেরে যায়।

প্রশ্ন হলো জেরক্সেস কেন গুজবে বিশ্বাস করলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে মিউটেশনস অব দ্য মাইন্ড, আ হিস্টোরি অব প্রোপাগান্ডা ফ্রম দ্য অ্যানসিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড টু দ্য প্রেজেন্ট ডে-তে ফিলিপ টেইলর লিখেছেন, অধিকৃত অঞ্চলের সেনাদের ওপর ভরসা করে যুদ্ধে হারার অনেক ঘটনাই সে সময় ঘটেছিল। জেরক্সেস তাই সেই গুজবে বিশ্বাস করেছিলেন।

ঐতিহাসিক এ ঘটনা থেকে একটা কথা স্পষ্ট। কী ধরনের গুজব তৈরি হবে বা হতে পারে, তা নির্ভর করে নির্দিষ্ট একটি সময়ে ঘটে চলা ঘটনার ওপর। তার মানে, গুজব তৈরিরও একটা ক্ষেত্র প্রয়োজন।

এ ক্ষেত্রে বড় একটি উপাদান হতে পারে বিশ্বাস। একটা উদাহরণ দিই। বিশ্বময় একটা জরিপে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষকে শয়তানে বিশ্বাস বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। শয়তানে বিশ্বাসী প্রথম পাঁচটি দেশ হলো মাল্টা (৮৪.৫ শতাংশ), উত্তর আয়ারল্যান্ড (৭৫.৬ শতাংশ), যুক্তরাষ্ট্র (৬৯.১ শতাংশ), আয়ারল্যান্ড (৫৫.৩ শতাংশ) ও কানাডা (৪২.৯ শতাংশ)। শয়তানে অবিশ্বাসী প্রথম পাঁচটি দেশ হলো লাটভিয়া (৯.১ শতাংশ), বুলগেরিয়া (৯.৬ শতাংশ), ডেনমার্ক (১০.৪ শতাংশ), সুইডেন (১২.০ শতাংশ) ও চেক রিপাবলিক (১২.৮ শতাংশ)।

শয়তানের অস্তিত্বের মতো একটি বিষয়ে মানুষের মধ্যে বিশ্বাসের এত পার্থক্য কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে থিংক লাইক আ ফ্রিক বইয়ে লেভিট ও ডুবনার বলেছেন, হয় লাটভিয়ানরা, নয়তো মাল্টিজরা খুব সাধারণভাবেই জানে না, তারা আসলে কী জানে।

এবার আপনি প্রশ্ন করুন, টুইন টাওয়ারে কারা হামলা করেছিল? সহজ প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা সোজা নয়। মিডিয়া ও গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে,এক দল আরব এ হামলার জন্য দায়ী। কিন্তু এ তথ্যে বিশ্বাসীদের সংখ্যা কিন্তু স্থানভেদে ভিন্ন। ইন্দোনেশিয়ার শতকরা ২০ ভাগ মানুষ, কুয়েতের ১১ ভাগ এবং পাকিস্তানের মাত্র ৪ ভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন যে টুইন টাওয়ার এক দল আরব হামলা চালিয়ে ধ্বংস করেছিল।

অর্থাৎ সাধারণভাবে আমরা যা জানি, তা খুব সহজেই রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বদলে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে এমন হাজার হাজার ভুল তথ্যের উদগাতা। অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড গ্লেইসার বলেছেন, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় নেতা ও ব্যবসায়ীরা তখনই সমাজে কোনো বিশ্বাসের জোগান দেন, যখন সেই বিশ্বাস তাঁদের রাজনৈতিক ও আর্থিক লাভের নিশ্চয়তা দেয়।

আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এত সহজেই মানুষ কেন গুজব ‘বিশ্বাস’ করে, কেনইবা ছড়ায়? সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় ভাইরাল কেন করে? প্রথম উত্তরটা সবার জানা। ক্লিক। একটা সহজ ক্লিক বা একটা শেয়ারই সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজবের আগুনে ঘি ঢালে। একটা ক্লিক করতে তো কোনো পরিশ্রম লাগে না। তাহলে কী করতে পরিশ্রম করতে হয়? গবেষণা করতে পরিশ্রম করতে হয়।

২০০৬ সালে এক গবেষণাপত্রে টেবার ও লজ লিখেছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ বিজ্ঞানভিত্তিক আবিষ্কার বা তথ্য বুঝতে পারে না। এ বুঝতে না–পারা হয় তাদের যেকোনো বিষয় উপেক্ষা বা এড়িয়ে চলতে উৎসাহী করে, না হলে একদমই অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক কোনো কার্যক্রমে জড়িয়ে ফেলে।

অনেক পণ্ডিত মনে করেন, এই হুজুগে হওয়ার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা। কিন্তু গবেষণা বলছে, এটা সহজ কর্ম নয়। কারণ, মানুষ সাধারণত যেকোনো কিছুতে বিশ্বাসের আগে দেখে নেয়, বিশ্বাসীদের দল ভারী, না অবিশ্বাসীদের? সোশ্যাল মিডিয়ার যেকোনো পোস্ট শেয়ার, কমেন্ট কিংবা লাইক করার আগে সে দেখে, তার আগে কজন লোক এই পোস্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম ঠিক করে দেয়, একজন মানুষ ঠিক কী কী তথ্য দেখবে।

এ ক্ষেত্রে ‘মোটিভেটেড রিজনিং থিওরি’ বা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যুক্তিতত্ত্ব’র কথা বলা যেতে পারে। এই মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে মানুষ আবেগকে গুরুত্ব দেয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে ‘এ রকম অবস্থায় সাধারণত এমনটাই তো হয়’ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো রকম ফ্যাক্ট, যুক্তি বা সত্যের ধার সে ধারে না।

যেমন, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মুখ চাঁদে দেখতে পাওয়া। ১৯৭৮ সালের নভেম্বর মাস। ইরানের ইসলামিক বিপ্লব তখন তুঙ্গে। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে চাঁদে খোমেনির মুখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে শুধু বিশ্বাসীরাই তাঁর মুখ দেখতে পাবে।

বৈজ্ঞানিকভাবে এই গুজব আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। চাঁদের নিজস্ব আলো নেই। সূর্যের আলো চাঁদের গায়ে লেগে প্রতিফলিত হয়। অলৌকিক কিছু যদি হয়েই থাকে, তবে খোমেনির চেহারা সূর্যের বুকে দেখতে পাওয়াটাই বরং অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা চেহারা দেখা খুবই কষ্টকর, চোখের জন্যও তা ক্ষতিকর। সমানভাবে চাঁদের নিজস্ব আলো নেই—এই তত্ত্বও অনেক মানুষকে বোঝানো কঠিন। তাই রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ধর্মীয় বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে এমন গুজব তৈরি করাটা সহজ এবং ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যুক্তিতত্ত্ব’র খপ্পরে পড়ে উদ্ভট তথ্যে বিশ্বাস স্থাপনও সহজ।

গুজবের আরেকটি সরেস উপাদান হচ্ছে ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ বা কন্সপিরেসি থিওরি। গুজবের সঙ্গে প্রায়ই কন্সপিরেসি থিওরি জুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা এখানেও প্রায়ই যুক্তির প্রয়োগে ভুল করি। কারণ, ষড়যন্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই ষড়যন্ত্র, যতক্ষণ পর্যন্ত তা গোপন থাকে। লোকজানাজানি হয়ে গেলে তো ষড়যন্ত্রের মর্যাদাহানি ঘটে।

গুজব থেকে মুক্তির উপায় তবে কী? জটিল প্রশ্ন, উত্তরও জটিল। তবে গুজব এড়ানোর আপাত সহজ একটা উপায় আছে। যেকোনো তথ্যে বিশ্বাস করা বা তা ছড়িয়ে দেওয়ার আগে নিজের আত্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ বা সন্দেহ করুন। দেখবেন সে তথ্যে বিশ্বাস বা তথ্যটি ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কমে আসতে শুরু করেছে।

তথ্য ও চিন্তাসূত্র: কিওনইয়ং পার্ক ও হাইজুন রিমের গবেষণা, লেভিট ও ডুবনারের থিংক লাইক আ ফ্রিক এবং ফিলিপ টেইলরের মিউটেশনস অব দ্য মাইন্ড, আ হিস্টোরি অব প্রোপাগান্ডা ফরম দ্য অ্যানসায়েন্ট ওয়ার্ল্ড টু দ্য প্রেজেন্ট ডে

রিনভী তুষার: লেখক, রাজনীতি গবেষক এবং যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী
tushar.rinve@gmail.com