বাঘা তেঁতুল

গাধা ও গণহত্যার গল্প

খুশির খবর। চীন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাকিস্তানকে পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার ওয়াদা করেছে। এই অর্থটা পাকিস্তানে বিনিয়োগ করার উদ্দেশ্য হলো গাধার প্রজনন ও উৎপাদন বাড়ানো। পাকিস্তান গাধার দেশ, কিন্তু আরও বেশি গাধা উৎপাদন করতে চাইছে দাতা ও গ্রহীতা—চীন ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউন–এর সংবাদে বলা হয়েছে, পাকিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গাধার সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। চীনের অর্থায়নে তাদের গাধা প্রজনন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।

পাকিস্তানে গাধার সংখ্যা বাড়াতে যাচ্ছে চীন তার নিজের স্বার্থেই। চৈনিকদের গাধা খুব পছন্দ। গাধার শরীর থেকে তারা সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় জিলাটিন। চীনে বহুল প্রচলিত ইজিয়াও নামক ওষুধের প্রধান উপাদান হচ্ছে গাধার চামড়ার নিচে থাকা বিশেষ ধরনের আঠা জিলাটিন। ওষুধটি অ্যাজমা থেকে অনিদ্রা প্রভৃতি নানা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

চীনের মতো প্রকাণ্ড দেশে একসময় সব প্রাণীর মতো গাধাও ছিল প্রচুর। কিন্তু আধুনিক শিল্পায়নের ফলে প্রথাগত পশুপালন থেকে সরে এসেছে চীন। তাই গাধার সংখ্যা কমে গেছে। চাহিদা পূরণে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ যেমন কেনিয়া, নাইজার, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশ থেকে গাধা আমদানি করছিল। নাইজার চীনে গাধা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গাধার চাহিদা এখন পূরণ করতে হবে পাকিস্তানকে। পাকিস্তানের বলতে গেলে সবখানেই গাধা আছে, তবে বিশেষভাবে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ গাধার জন্য বিখ্যাত। চীনের অর্থ সাহায্য পেয়ে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রাদেশিক সরকার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে গাধা উৎপাদন প্রকল্পের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে।

এই সময় পাকিস্তানে গাধার সংখ্যা আরও বাড়ানোর খবরটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো। মাসখানেক আগে যখন আলোচনা চলছিল যে পাকিস্তানিরা মনে করে, একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের বাহিনী গণহত্যা বলে কিছু করেনি, এ কথা শুনে এক ভদ্রলোক বললেন, বলে কী, গাধা নাকি? সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কতজন নিরস্ত্র মানুষ বর্বরোচিতভাবে নিহত হলে তাকে গণহত্যা বলা যায়, সেই জ্ঞান গাধার দেশ পাকিস্তানের মানুষের নেই। গণহত্যা বা জেনোসাইড সংজ্ঞায়িত করার জন্য খুব বড় একটা সংখ্যার প্রয়োজন হয় না। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত্র দশজনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হত্যা করলে সেটাও গণহত্যা।

নয় মাসব্যাপী হত্যাযজ্ঞ ও হাজার হাজার বাড়িঘর জ্বালিয়ে ছারখার করার প্রয়োজন ছিল না। শুধু পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তর ও ঠাটারীবাজারে যে নরহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী—মানুষের ইতিহাসে তার তুলনা বিরল এবং ওই রাতের নরহত্যাই গণহত্যা বলে আখ্যায়িত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অটোমান শাসকেরা আর্মেনিয়ানদের কচুকাটা করেছে। তা তুর্কি সরকার স্বীকার করুক বা না করুক পৃথিবীর মানুষ জানে। গণহত্যা হয়েছে রুয়ান্ডায়, বসনিয়ায়, কম্বোডিয়ায়, লাওসে—আরও অনেক দেশে। সেগুলোর অলিখিত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে। বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই। চরম অবিচার। আমাদের সরকার স্বীকৃতি আদায়ের সেভাবে চেষ্টাও করেনি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে। ওই সনদে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছি। পঁচিশে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস করতে পারিনি। বাস্তবতা হলো, জাতিসংঘ দুটো দিনকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করবে না। সুতরাং আমাদের উচিত পঁচিশে মার্চ রাতকে ‘গণহত্যার রাত’ ঘোষণা করা। গণহত্যার দিবসও পালিত হোক, গণহত্যার রাতও পালিত হোক।

পাকিস্তানের নেতারা বাংলাদেশে তাঁদের বাহিনীর গণহত্যার কথা স্বীকার করেন না। কোরিয়া ও চীনে জাপানি বাহিনীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের কথা বর্তমান জাপানি নেতারা অস্বীকার করেন না। অস্বীকার করে গাধার দেশের মানুষদের কী লাভ হচ্ছে তা তারা ছাড়া আর কেউ জানে না।

পাকিস্তানে এখন যেসব মানুষ বেঁচে আছে, তাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা ছাড়া আর কেউই একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেনি। তারা কেন একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় অস্বীকার করে নিজেদের মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করবে? তারা বরং ক্ষমা চাইলে তাদের বিবেক আছে সেটা প্রমাণিত হবে।

অবশ্য পাকিস্তানিরা বাংলাদেশের গণহত্যার কথা অস্বীকার করতেই পারে। চীন পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি অকারণে করেনি। বাংলায় গাধার আরেক নাম গর্দভ। পৃথিবীতে গাধাও দুই রকম। চার পা-বিশিষ্ট গাধা ও দুই পা-বিশিষ্ট গর্দভ।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।