মতামত

গল্পগুলো আইনুন নিশাত স্যারের কাছ থেকে শোনা

অধ্যাপক আইনুন নিশাত
অধ্যাপক আইনুন নিশাত

আইনুন নিশাত স্যারকে অনেক দিন পরে ব্র্যাকের ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে দেখলাম। আইনুন নিশাত স্যার আমাদের পড়াতেন ‘ওয়াটার’। ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং। আজ হঠাৎ করেই মনে হলো, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্লাসে কত অঙ্কই তো স্যাররা করিয়েছিলেন, সেসবের কোনো প্রয়োগ তো আমার জীবনে নেই, এমনকি যাঁরা প্রকৌশলী হিসেবেই পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন, সেই অঙ্কগুলো তাঁদের কজনেরই–বা বাস্তব জীবনে কাজে লাগছে! কিন্তু আইনুন নিশাত স্যার শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে যে গল্পগুলো বলতেন, সেসব তো প্রায় তিন যুগ পরে স্পষ্টই মনে আছে।

আইনুন নিশাত স্যারের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল, এ মাসেই তাঁর ৭৪ পূর্ণ হবে। বিখ্যাত আইনজ্ঞ গাজী শামসুর রহমানের ছেলে অধ্যাপক আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ছেড়েছেন ১৯৯৮ সালে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন; বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু থেকে শুরু করে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা—বাংলাদেশের গড়ে ওঠার পেছনের বহু কাজে নিশাত স্যারের অবদান ও অংশগ্রহণ আছে। যেমনটা আছে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের।

বাংলাদেশের স্থানীয় সমস্যার সমাধানে স্থানীয় মানুষদের জ্ঞানকে আমলে নিতে হবে। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান কোনো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ পুরোপুরি দিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আমাদের দেশের স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং সমাধান অন্বেষণ করতে কাজে লাগানো হয়!

আইনুন নিশাত স্যারের বিয়ে নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। স্যার বুয়েট থেকে পাস করে বুয়েটের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী। আইনুন নিশাতকে এক কন্যার পিতা জামাতা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এই জন্য যে তিনি মেয়েকে কোনো দুর্নীতিবাজের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। স্যার শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আমরা বুয়েটে ছিলাম ১৯৮৩-৮৪ ব্যাচ। ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় অডিটরিয়ামে ছাত্র-শিক্ষক প্রীতি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হলো। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে আইনুন নিশাত ছিলেন একজন বক্তা। স্যার একটা কৌতুক বলেছিলেন। ৩৭ বছর আগে শোনা সেই কৌতুক আমার আজও মনে আছে।

প্রেক্ষাপট ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন বৈঠক। বাংলাদেশ দলে প্রকৌশলীর সংখ্যা বেশি। ভারতীয়রা চান রাজনীতিবিদ আর আমলাদের। স্যার তখন এই কৌতুকটা শুনিয়েছিলেন। একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী আর একজন রাজনীতিবিদের মধ্যে বাহাস হচ্ছে। কার পেশা বেশি অভিজাত? চিকিৎসক বললেন, আদম (আ.) যখন পৃথিবীতে এলেন, হাওয়া (আ.) এলেন, তখন থেকেই তো ডাক্তারি পেশার শুরু। প্রকৌশলী বললেন, মহাজগৎ আগে ছিল বিশৃঙ্খল। স্রষ্টা সেই বিশৃঙ্খল অবস্থাকে সুবিন্যস্ত করলেন, সুশৃঙ্খল করলেন। তখন থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং পেশার শুরু। শুনে রাজনীতিবিদ মিটমিট করে হাসছেন। ‘আপনি হাসছেন কেন?’ রাজনীতিবিদ বললেন, ‘আপনারা বলছেন, বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে স্রষ্টা শৃঙ্খলা বিধান করলেন। তা এই বিশৃঙ্খলাটা সৃষ্টি করেছিল কে?’

আরেকটা গল্প নিশাত স্যার করেছিলেন ক্লাসরুমে। বাঁধের প্রধান শত্রু ইঁদুর। ইঁদুরের গর্ত দিয়ে বন্যার পানি ঢুকছে নদী থেকে জনপদের দিকে। বাঁধ ভেঙে যাবে। এই রকম ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা বাঁধের স্থলভাগের দিকে আরেকটা বাঁধ বানান। রিংবাঁধ। তারপর সেই রিংয়ের মধ্যে পানি ঢেলে দিয়ে নদী আর রিংয়ের ভেতরের পানির তল সমান করে দেন। এর ফলে আর নদীর পানি বাঁধের ছিদ্র দিয়ে বাইরে আসে না। একবার এক নেতা সেই বাঁধ দেখে বলেছিলেন, নদীর পানির পরিমাণ অনেক বেশি, রিংয়ের পানির পরিমাণ অনেক কম। কীভাবে এই অল্প পানি এই বেশি পানির চাপ সামলাবে? তখন তাঁকে বোঝানো হলো, এটা পানির পরিমাণের ব্যাপার নয়, এটা হলো উভয় জলাধারের পানির তলের উচ্চতার ব্যাপার। দুই জলাধারের পানির উচ্চতা সমান হলেই হলো।

আরেকটা গল্প আইনুন নিশাত স্যার বলেছিলেন আমাদেরকে। মোগল এক শাহজাদা এসেছে বঙ্গদেশে। সমুদ্র এলাকার নদীবক্ষে বোটে অবস্থান করছে। সারা রাত নাচ–গান ভালোই হলো। সকালবেলা মোগল শাহজাদা বলল, একি কাণ্ড! রাতে দেখলাম কচুরিপানা ভেসে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, সকালে দেখি পানা সব যাচ্ছে উত্তর দিকে। এ তো আজব দেশ। এই দেশে তো আর থাকা যাবে না। আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলে যে জোয়ার-ভাটা হয়, তার রূপ মোগল শাহজাদা তো আগে দেখেননি। তিনি অবিলম্বে বাংলা ত্যাগ করেন।

একবার ভারত-বাংলাদেশ বৈঠক হচ্ছে সুন্দরবন নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য। দিল্লির এক পরামর্শক পরামর্শ দিলেন, সুন্দরবন পাহারা দিতে অনেক ফোর হুইল গাড়ি বরাদ্দ করলেই তো হয়। তাঁকে বলা হলো, সুন্দরবন পাহারা দিতে নৌযান বরাদ্দ করলে তা কাজে লাগতে পারে, গাড়ি এখানে কোনো কাজে লাগবে না। আরেকবার পশ্চিমা রেইনফরেস্ট বিশেষজ্ঞ সুন্দরবন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষণ আগে যা ছিল স্থলভাগ, কয়েক ঘণ্টার পর তা পানির নিচে ডুবে গেল কীভাবে?

গল্পগুলো শুধুই গল্প, নাকি এগুলো সত্যিকারের কাহিনি, তা আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু স্যারের সেই সব কথা আজও মনে আছে। এখনো আমি মনে করি, বাংলাদেশের স্থানীয় সমস্যার সমাধানে স্থানীয় মানুষদের জ্ঞানকে আমলে নিতে হবে। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান কোনো পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ পুরোপুরি দিতে পারবেন না, যতক্ষণ না আমাদের দেশের স্থানীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং সমাধান অন্বেষণ করতে কাজে লাগানো হয়!

আকবর আলি খান যেমন বলেন, অর্থনৈতিক সমস্যার আমলাতান্ত্রিক সমাধান নেই, রাজনৈতিক সমস্যার প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক সমাধান নেই, তেমনি করে আমরা বলতে পারি, ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যারও রাজনৈতিক সমাধান নেই। তবে যে সমস্যা কিংবা যে সমাধান নিয়েই আমরা কথা বলি না কেন, মানুষের কথা শুনতে হবে, স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। পৃথিবীসেরা প্রকৌশলী এফ আর খান বলেছেন, একজন টেকনিক্যাল মানুষের আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়, তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে এবং জীবন হলো: শিল্প, নাটক, সংগীত, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।

সমস্যার সমাধানের জন্য মানুষের কাছেই যেতে হবে। ড. আইনুন নিশাত স্যারকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে আমি আমাদের সব শিক্ষককে শ্রদ্ধা জানাই, যঁারা লেখাপড়াটাকে কেবল পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখতে আমাদের ক্রমাগতভাবে শিখিয়ে যাচ্ছেন।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক