গলা সাধছি

গোধূলিবেলা চলছে। ছায়াপথও। কত দিন কে জানে।
ঝিঁঝি ক্ষুদ্র প্রাণী। তার শব্দতরঙ্গ সৃষ্টির ক্ষমতা বিস্ময়কর। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন, অন্ধকার রজনীতে যখন নদীর ধারে বসে আছি নৌকো কখন আসবে সেই প্রতীক্ষায়, তখন ওই পোকার ডাক আনে সাহস। ওরা অত বড় নদীতে সম্পূর্ণ সহায়সম্বল ছাড়া বিচরণ করছে, ডেকে চলেছে, তাহলে আমার ভয় কিসের? নির্ভয় হলাম। কত জন্তু-জানোয়ার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলে কেন হব ভীত?
পোকাটি জানান দিল, একা নও, আমিও আছি, ভয় পেয়ো না। গাইছি কবির গান: ‘ঝিল্লির সনে, তীর ছাপি নদী এল কল্লোলে, এল পল্লীর কোলেরে’। রাস্তার নেড়ি কুকুর চিৎকার করে আমার আগমন বার্তা জানিয়ে দিল পাড়াটিকে মাথায় তুলে। ভোরবেলা ব্যালকনির ধারে গান শুনিয়ে চলে যায় দোয়েল। গানের গলা ঈর্ষণীয়। অডিশনে এলে শিল্পীরা তার কাছে মার খেয়ে যেত। প্রাণীকে যত ক্ষুদ্রই জ্ঞান করা হোক, তার শব্দতরঙ্গ তৈরির ক্ষমতা যতটা মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি। লেখাও পৌঁছাবে অনেক দূর।
আমেরিকায় এক ভদ্রলোক আঠারো হুইলারের নিচে চাপা পড়ে ৯০ মিনিট ছিলেন মৃত। তাঁর অবস্থান ছিল স্বর্গে। ফিরে এসে বই লিখেছেন। বইয়ের দাম ২০ ডলার। কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। বলছেন, স্বর্গের চেয়ে ভালো জায়গা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর মানুষ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারবেন না সেখানে কী পাবেন। কী আনন্দময় পরিবেশে বাকি জিন্দেগি কোনো কাজ না করেই পায়ের ওপর পা দিয়ে অতিবাহিত করতে পারবেন তাঁরা। নিয়ার ডেথ এক্সপেরিয়েন্স [এনডিই] নিয়ে বই বেরিয়েছে অনেকগুলো। নর-নারীর সম্পর্ক নিয়ে রসঘন উপন্যাসের পাতাগুলো এর কাছে পানসে। আমেরিকায় বার্নস অ্যান্ড নোবেল বইয়ের দোকানে প্রবেশ করে ক্যাপাচিও পানের অবকাশে যাঁরা বই নাড়াচাড়া করবেন নিখরচায়, তাঁদের অন্যতম আকর্ষণ: এনডিই। আশির ঘরের বুড়োবুড়িরা আমার সামনেই। মুখে বলছেন: ভগবান, কবে আমাকে নেবে? গলায় ক্রস। লেখা: ‘লাভ ইউর নেবার অ্যাজ ইউরসেলফ’, প্রতিবেশীকে ভালোবাসো, যতখানি বাসো নিজকে।

>ভোরবেলা ব্যালকনির ধারে গান শুনিয়ে চলে যায় দোয়েল। গানের গলা ঈর্ষণীয়। অডিশনে এলে শিল্পীরা তার কাছে মার খেয়ে যেত। প্রাণীকে যত ক্ষুদ্রই জ্ঞান করা হোক, তার শব্দতরঙ্গ তৈরির ক্ষমতা যতটা মনে করা হয়, তার চেয়ে বেশি

কথাটা ভাবিয়ে তুলল। এ নিয়েই ভাবতে থাকলাম এবং আরও এক কাপ কফির অর্ডার দিলাম। কফির মূল্য ৯ ডলার ২০ সেন্ট। জীবনের সমাপ্তি নির্ণয় করে মস্তিষ্ক, দেহ নয়। মস্তিষ্ক সক্রিয় থাকলে ভগবানের বাড়ি বেড়িয়ে আসা যায়। স্বর্গ ভাবনা একেক জনের একেক রকম। সম্প্রতি পবিত্র কোরআন অনুবাদ করায় এর ব্যাখ্যা আমার কাছে সহজলভ্য।
যা জেনেছি, ঝিঁঝি পোকার শব্দের চেয়েও বিস্ময়কর। শুধু এইটুকু: স্বর্গের কল্পনা মানুষের কল্পনাকে হার মানাবে। ঘুমানোর সময় সেই গ্রামটির কথা ভাবি, যেটি আমার স্বপ্নের বাড়ি। বলরামপুর গ্রামে কালজানি নদ পার হলেই সেই স্বর্গে প্রবেশাধিকার পাই। ও মা, এত কাছে রয়েছে আমার স্বর্গ! কোনো দিন ভাবিনি। আমার বন্ধুরা আগে থেকেই সুন্দর সুন্দর বাড়িতে বাস করছে। নদীতে সাঁতার কাটছে, কী নেই সেখানে? একজন বলল, তুই এত দেরি করছিস যে ভালো বাড়িগুলো বাজে লোকেরা এসে ‘অকুপাই’ করে বসে আছে।
আমেরিকায় বইয়ের দোকান দুটি সবচেয়ে নামকরা। ‘বার্নস অ্যান্ড নোবেল’ এবং ‘বর্ডার্সে’ লেখকদের আসতে অনুরোধ জানাই। পাঠকেরা পৃথিবীর কথা আর জানতে চায় না। মানুষ যে ক্রমেই অমানুষ তা জানতে হলে আর বই পড়ার প্রয়োজন নেই। সব বই কেনার সাধ্য নেই, শুধু নাড়াচাড়া করে গেলাম। হাতের কাছে বই। ‘আমিও আছি’। সমুদ্রের তলদেশে প্রাণীর সংখ্যা বিধাতা ছাড়া কারও জানা নেই। তলদেশে যে জীবদের বাস, তাদের দেখতে গিয়েছি মায়ামি ‘কি ওয়েস্টে’। বিচিত্র ডলফিনের ধ্বনি তরঙ্গ প্রথম শুনলাম। ওখানেও তারা কথা বলে, গান গায়। অনেক দূর থেকে তা শোনাও যায়। সেগুলো পড়তে পড়তে ওদের ল্যারিংসের ছবি পেলাম। ওটা ভোকাল ভয়েস। বাতাস গিয়ে সেখানে আন্দোলিত হলে জিহ্বা, ঠোঁট ও নাকের ক্যাভিটি দিয়ে সেগুলো বাইরে বেরোয়।
সকালবেলা যে এক ঘণ্টা গলা সাধলাম, সেটা হলো আমার ল্যারিংসকে সহজেই ওঠানামা করতে সাহায্য করার অভিপ্রায়। কোনো কোনো শিল্পী [যেমন অজয় চক্রবর্তী] দিনে ১০ ঘণ্টা এ কাজটি করেন। ডলফিনরা তাদের নাকের ছিদ্র দিয়ে এ শব্দটি বাতাসে ছেড়ে দেয়, যা পানির তরঙ্গের সঙ্গে মিশে ধ্বনি সৃষ্টি করে। সে ধ্বনি কখনো ঘণ্টাধ্বনির মতো, কখনোবা গার্ডের বাঁশির মতো, কখনো বা মেঘগর্জনের মতো। উৎসাহীরা অনুকরণ করে নানা শব্দ সৃষ্টি করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেয়।
মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত গায়ক সনু নিগম একবার ঢাকায় এসেছিল। গরিলার গলা কেমন হতে পারে তা-ও শুনিয়ে দিল। বলা বাহুল্য, আর শুনতে যাব না। মনুষ্য ল্যারিংস নয়, অন্য প্রাণীদেরও Vocal Fold, U Fold, Homolog, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ল্যারিনজিয়াল Sac [স্যাক]-কে ছোট-বড় করতে পারেন। তিমি মাছ ব্রডব্যান্ডের সঙ্গে পরিচিত [৩০-১২০০০ HZ]। তাদের ধ্বনিতরঙ্গ পৌঁছায় বহুদূর। মাছুয়ারা বুঝতে পারে তিমি কত দূরে। সেই হিসেবে বড়শি ফেলে।
গলা সেধে চলেছি। পাতলা খাঁর গলিতে যখন থাকতাম, বাড়ির সামনে ভিড় হয়ে যেত, গলা সাধাটুকু শোনার জন্য। কিছুদিন পর দেখা গেল, পাশের বাড়ির লোক এসে অভিযোগ করছে যে গলাটা একটু খাটো করুন। ছেলের পরীক্ষা। বললাম, কালই আমরা পুরানা পল্টন চলে যাচ্ছি। সেখানে সারা দিন গান গাইলেও কেউ কিছু বলবে না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net