গর্ভপাত নিষিদ্ধ: যুক্তরাষ্ট্র পেছনের দিকে হাঁটছে

শেষ পর্যন্ত এটা হয়েই গেল। বাস্তবতা হচ্ছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে এটা ঘটার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। তাই ধাক্কাটা আমাদের ভোঁতা অনুভূতিতে তেমন কোনো আঘাত হানতে পারেনি। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট ‘ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেনস হেলথ অর্গানাইজেশন’ মামলার রায় দিতে গিয়ে ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায়টি পাল্টে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা ৫০ বছর ধরে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে যে সার্বভৌম অধিকার পেয়ে আসছিলেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে উচ্চ আদালতের অনির্বাচিত ছয় বিচারপতি সেটা কেড়ে নিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র পেছনের দিকে হাঁটছে, এটা বলা হয়তো ভুল হবে। এটা বলা ভুল হবে যে যুক্তরাষ্ট্র সত্তরের দশকে প্রাক্‌-রো (নারীদের গর্ভপাতের অধিকারহীনতা) যুগে প্রত্যাবর্তন করল। প্রকৃতপক্ষে আমরা আরও অশুভ দিকে যাত্রা শুরু করলাম। প্রাক্‌-রো যুগে চলতে-ফিরতে এত নজরদারির ব্যবস্থা ছিল না, কিন্তু সেটা এখন আছে। দমনমূলক যেকোনো আইন এখন আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়। যদি কেউ গুগলে ‘গর্ভপাতের পিল’ খোঁজেন, তাঁর বিরুদ্ধেও এই আইন প্রয়োগ করা হতে পারে। যথেষ্ট আশঙ্কা আছে, আপনার ‘অনলাইন সার্চ’ ইতিহাসকে আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হতে পারে। আপনি যদি গর্ভপাত বৈধ, এমন কোনো অঙ্গরাজ্যে যান এবং সেখানে নিরাপদ গর্ভপাতের সুযোগ নেন, তাহলে আপনার লোকেশন তথ্য আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হতে পারে। গত এক দশকে আমরা ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। আমরা এখন দুঃস্বপ্নের একেবারে মধ্যগগনে।

এই দুঃস্বপ্ন অবশ্যই ঘটনাচক্রে আসেনি। গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তে সবাই সমানভাবেও আক্রান্ত হবেন না। উচ্চ আদালতের এই রায়ে তুলনামূলকভাবে গরিব এবং কালো ও বাদামি নারীরা বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন। অন্যদিকে পুরুষ রিপাবলিকান রাজনীতিকেরা সম্ভবত নিজেদের সুবিধামতো তাঁদের স্ত্রীদের গর্ভপাতের সুযোগ নেবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে রো-যুগের এই পরিসমাপ্তিকে নাগরিক অধিকারের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণের সূচনা বলা যায়। গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার এই সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে রক্ষণশীল মানুষেরা এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণ বন্ধের আইনও পাস করবেন। এর যথেষ্ট আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। গত শুক্রবার বিচারপতি ক্লারেন্স টমাস মন্তব্য করেছেন, উচ্চ আদালত শুধু গর্ভপাত ইস্যুতেই থেমে থাকবেন না। অথচ এই টমাসের বিরুদ্ধে সমকামিতা ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রয়েছে।

আমেরিকায় নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। তৃতীয় লিঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। সাদা বাদে অন্য গাত্রবর্ণের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে। ভাবুন তো, কিসের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ? দুঃখজনক হলো, সরকারের কেবল একটি অংশই এ যুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। গত শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট শুধু ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায় ছুড়ে ফেলেছে, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। গত কয়েক দশকে রিপাবলিকানরা নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার জন্য এবং আমেরিকায় তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এ রায় তারই প্রতিফলন। ডেমোক্র্যাটদের এখন তাঁদের ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলার এবং শক্তভাবে লড়াইয়ের মাঠে নামার সময় হয়েছে।

আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বেলায় অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি, কিন্তু গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মানে কি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অস্ত্রের চেয়ে তাদের নারীদের ওপর বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়? আমার ধারণা, জরায়ুকে মারণাস্ত্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা!

গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়ার আগের দিন সুপ্রিম কোর্ট শত বছরের পুরোনো আগ্নেয়াস্ত্র আইনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন। এর ফলে এখন থেকে বাড়ির বাইরে গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করা কঠিন হবে। একই সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্ট দুটি রায় দিলেন। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের বেলায় অঙ্গরাজ্যগুলোকে নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি, কিন্তু গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এর মানে কি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার অস্ত্রের চেয়ে তাদের নারীদের ওপর বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়? আমার ধারণা, জরায়ুকে মারণাস্ত্রের স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা!

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সবখানেই নারীর ওপর একই আচরণ চলছে। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত নতুন একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, গবেষণাকর্মে নারীর অবদান ‘প্রায় ক্ষেত্রেই স্বীকৃতি দেওয়া হয় না কিংবা উপেক্ষা করা হয়’। সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, বৈজ্ঞানিক কোনো নিবন্ধে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নারীকে পুরুষের তুলনায় বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ইউক্রেনে ধর্ষণের অভিযোগে প্রথম কোনো রাশিয়ান সেনার বিচার শুরু হয়েছে। তবে এটা একমাত্র অভিযোগ নয়। ধর্ষণ সব সময়ই যুদ্ধের অস্ত্র। এ জন্য খুব কম ক্ষেত্রেই তাদের জবাবদিহির আওতায় আসতে হয়।

এ মাসের শুরুর দিকে উত্তর চীনের শহর তাংসানে একটি রেস্তোরাঁয় কয়েকজন নারী একদল পুরুষের কাছে নিষ্ঠুরভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সহিংসতার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তা বিশ্বজুড়ে খবরের শিরোনাম হয়েছে। হামলাকারীদের মধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাংসানকে চীনের ‘জাতীয় সভ্য শহর’-এর তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর বাকি শহরগুলোকে ‘সভ্য শহর’ বলা যাবে?

নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্রগুলোর প্রয়োগ সম্ভবত এখনো বাকি রয়ে গেছে।

গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • আরওয়া মাদালি দ্য গার্ডিয়ান-এর কলামিস্ট ও লেখক