বাংলাদেশের বামপন্থীরা অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন করলেন। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলো। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও অনেক লেখালেখি আমার নজরে পড়েছে। অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার শেষ হয়নি। গভীর ও বিশদ গবেষণা চলছে, নতুন নতুন বই লেখা হচ্ছে। যতটা রাশিয়ায়, তার চেয়ে বেশি পশ্চিমা দুনিয়ায়। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক বেনিয়ামিন নাথানস দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ বুকস-এর চলতি সংখ্যায় লিখেছেন, অক্টোবর বিপ্লব নিয়ে এ পর্যন্ত বই লেখা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার; শুধু ইংরেজি ভাষাতেই প্রায় ৬ হাজার।
বোঝার চেষ্টা চলছে, অক্টোবর বিপ্লব কেন ও কেমন করে ঘটেছিল; সোভিয়েত ইউনিয়নের গোড়াপত্তন থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় পরাশক্তি হয়ে ওঠা পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছিল, সেসব কী করে সম্ভব হয়েছিল এবং স্পষ্ট কোনো পূর্বলক্ষণ ছাড়াই সেই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রটি কেন ও
কীভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে গেল। এই ছোট্ট লেখায় এত বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করার সুযোগ নেই। শুধু শেষের প্রশ্নটি নিয়ে কিছু কথা বলার চেষ্টা করব: সোভিয়েত ইউনিয়ন কেন ও কীভাবে ভেঙে গেল।
এই প্রশ্নের দুটো সরল উত্তর প্রচলিত আছে।
একটা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন একটা ষড়যন্ত্রের ফল। ষড়যন্ত্রের হোতা মিখাইল গর্বাচভ; তিনি আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর এজেন্ট ছিলেন। তিনি নিজের চারপাশে যেসব লোককে জড়ো করেছিলেন, তাঁরাও সবাই ছিলেন পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের দালাল। এই দালাল চক্র আমেরিকা ও তার পুঁজিবাদী মিত্রদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছে। নইলে দেশটির পতনের কোনো কারণ ছিল না।
দ্বিতীয় উত্তরটা হলো, সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তিই হয়েছে অবৈধভাবে, এটা ছিল একটা অশুভ শক্তি, এর পতনের বীজ তার ভেতরেই লুকোনো ছিল। তা ছাড়া এর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল অস্বাভাবিক: ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বাজারব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটিয়ে প্রত্যেক নাগরিকের সমস্ত দায়দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র অনন্তকাল চলতে পারে না। গর্বাচভ ব্যবস্থাটার সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা সংস্কারের যোগ্য ছিল না, বরং সংস্কার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার ভেঙে পড়াই অনিবার্য ছিল। অবশেষে সেটাই ঘটেছে।
এ দুটো মতের কোনোটাই ভাবুক ও কৌতূহলী মানুষকে সন্তুষ্ট করে না। তাঁরা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন গর্বাচভের সময় সামগ্রিকভাবে কী ঘটেছিল।
১৯৮৫ সালের মার্চে মিখাইল গর্বাচভ যখন দায়িত্ব নেন, তখন না সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতরে, না বাইরে কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে পরবর্তী ছয় বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল না, তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করায় খারাপের দিকে যাচ্ছিল।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ১৯৭৩ সালে চতুর্থবারের মতো আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ বাধলে তা কয়েক মাসের মধ্যে ৪০০ শতাংশ বেড়ে যায়। এতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে চাঙা হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ আয় হয়েছে তেল রপ্তানি থেকে। তেলের দাম বাড়ার ফলে তেল রপ্তানিকারক আরব দেশগুলোর প্রচুর লাভ হয়, সেই লাভের টাকায় তারা ব্যাপক সামরিকায়ন করে: সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনা বাড়িয়ে দেয়। এই সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নেও ব্যাপক সামরিকায়ন ঘটে; প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় দেশটি আমেরিকার সমকক্ষ হয়ে ওঠে।
পশ্চিমা অর্থনীতিবিদেরা জ্বালানি তেলকে বলতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘আকিলিসের গোড়ালি’, মানে অত্যন্ত নাজুক জায়গা। গর্বাচভের দুর্ভাগ্য, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই তেলের দাম কমতে শুরু করে। ১৯৮৬ সালে কমে যায় ৬৯ শতাংশ; তেল কেনাবেচার মুদ্রা মার্কিন ডলারের দামও পড়ে যায়। এর মধ্যে ওই বছরই ঘটে চেরনোবিল দুর্ঘটনা, যার প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল।
আরও বড় এবং বেশ গুরুতর সমস্যা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পকারখানাগুলো ১৯৮০ দশক নাগাদ সেকেলে ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। বিশেষত বিশালাকার যেসব শিল্প ১৯৩০ দশকে গড়ে তোলা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই পুরোনো মডেলেই পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে ব্রেঝনেভের আমলে ব্যাপক সামরিকায়ন চলছিল, তা অব্যাহত ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ ব্যয় করা হতো সামরিক খাতে।
এ রকম অবস্থায় গর্বাচভ এসে দেখলেন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক সাধ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের আর নেই। এটা থামাতে হবে। তাঁর পররাষ্ট্রনীতির একটা গোড়ার কথা ছিল এটাই। এ জন্য তাঁকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নিতে হয়েছে। সেটা আন্তরিকভাবে করতে গিয়ে তিনি যে শেষ পর্যন্ত ধোঁকা খেয়েছেন, তা তিনি সেই সময় বুঝতে পারেননি। বুঝেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার অনেক বছর পর। এখন তিনি বলেন, ‘আনি আবমানুলি নাস’। (ওরা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে)।
যাহোক, এটা অন্য প্রসঙ্গ। গর্বাচভ সামরিক ব্যয় কমানোর প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক গতিসঞ্চারের জন্য শিল্পকারখানার কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেটা ঘটেনি। কারণ, সংস্কার করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। যে কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত সবকিছু চালাত, তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল এককেন্দ্রিক। পার্টির ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না; ব্যাপক বিস্তৃত দুর্নীতি পার্টির জন্য হয়ে উঠেছিল একটা দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। পার্টির নেতাদের অধিকাংশই জনগণ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
গর্বাচভ অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নের উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অভাব দূর করতে চেয়েছিলেন রাজনৈতিক সংস্কারের (পিরিস্ত্রোইকা) মাধ্যমে। সে জন্য তিনি এসে বললেন, পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র দরকার। গণতন্ত্রের চর্চা হলেই সমাজতন্ত্র আরও বিকশিত হবে। তাঁর পিরিস্ত্রোইকার প্রথম স্লোগান ছিল ‘আরও গণতন্ত্র, আরও সমাজতন্ত্র’।
তিনি পিরিস্ত্রোইকার আগে শুরু করেন ‘গ্লাসনস্ত’ (কথা বলার স্বাধীনতা)। সোভিয়েত ইউনিয়নের জনসাধারণ গ্লাসনস্তের জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। তারা মুক্তির নিশ্বাস ফেলল। যেন বিশাল এক বাঁধ ভেঙে গেল। সোভিয়েত সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এমন প্রাণবন্ত হয়ে উঠল, যেমনটা এর আগে কখনো ঘটেনি। সবাই যখন নির্ভয়ে কথা বলার ও লেখার সুযোগ পেল, তখন যে বিষয়টা প্রকট হয়ে উঠল তা হলো অতীতের সমালোচনা। অতীতের অর্জনের চেয়ে বড় হয়ে উঠল ভুল ও ব্যর্থতাগুলো। ‘র্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটরা’ চূড়ান্তবাদী হয়ে উঠলেন, তাঁরা বলে উঠলেন, ভুল নয়, ব্যর্থতা নয়, সেগুলো ছিল ‘অপরাধ’। স্তালিনকে তাঁরা আখ্যায়িত করতে লাগলেন ‘প্রিস্তুপনিক’ (ক্রিমিনাল) বলে।
এটা গেল একটা দিক। অন্যদিকে সোভিয়েত জনগণ পুঁজিবাদী দুনিয়ার খবর পেতে শুরু করল; টেলিভিশনের পর্দায় তারা দেখতে পেল ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ কত ভালো জীবন যাপন করছে। কী চাকচিক্যময় তাদের জীবন। টেলিভিশনে দেখায়, লন্ডনের দোকানগুলোতে ২২ থেকে ৪২ রকমের পাউরুটি বিক্রি হয়। এই সব দেখতে দেখতে সোভিয়েত জনগণ আবিষ্কার করল, তাদের নিজের দেশে দোকানগুলোর তাক ক্রমেই শূন্য হয়ে যাচ্ছে; মাংস, মাখন, পনির কেনার লাইনগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা তাঁদের জনগণকে সব সময় বলে এসেছেন, সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের চেয়ে ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু জনগণ দেখতে পেল, কথাটা সত্য নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে একটা সময় খোদ কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরেই এমন একটা গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেল, যারা গর্বাচভের সংস্কারের ‘ধীরগতি’তে সন্তুষ্ট থাকতে পারল না। এই গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন পলিটব্যুরোর অন্যতম সদস্য বরিস ইয়েলৎসিন।
গর্বাচভের প্রত্যাশা মিথ্যা হয়ে গেল, যখন তিনি দেখলেন গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকার ফলে আমলাতন্ত্রে ও কলে-কারখানায় ভীষণ বিশৃঙ্খলা দেখা দিল; অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ল। ‘কো-অপারেটিভের’ নামে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়া হয়ে উঠল রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুটপাটের উৎসব, যার নেতৃত্বে ছিলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতিবাজ নেতারা।
জনসাধারণের দুর্দশা ক্রমেই বেড়ে চলল এবং গর্বাচভের জনপ্রিয়তা কমতে লাগল। জনগণ গর্বাচভের ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল, তাঁকে দোষারোপ করতে লাগল এই বলে যে তাঁদের সব দুঃখ-দুর্দশা ডেকে এনেছেন এই ভদ্রলোক। ১৯৯০ সালের শেষ নাগাদ পিরিস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্ত অকার্যকর হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি, সেনাবাহিনী, কেজিবি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেকে গর্বাচভের পাশ থেকে সরে গেলেন। তাঁদের মধ্যে লিগাচভ ও রিঝকভের মতো প্রভাবশালী নেতাও ছিলেন।
গর্বাচভের বিরুদ্ধে এই পক্ষের লোকজনের অভিযোগ ছিল, তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ধ্বংস করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছেন, পূর্ব ইউরোপকে বিসর্জন দিয়েছেন, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের বিলোপ ঘটিয়েছেন। সাঝি উমালাতোভা নামে কংগ্রেসের এক ডেপুটি কংগ্রেসের অধিবেশনে বলেন, ‘মিখাইল গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংস ডেকে আনতে চলেছেন। তিনি পশ্চিমা দুনিয়ার হাততালি পেয়ে ভুলে গেছেন তিনি কাদের প্রেসিডেন্ট।’ প্রকাশ্য ফোরামে বলাবলি চলতে থাকে, গর্বাচভ যদি দেশে ‘শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনেন’, তাহলে তাঁকে পদচ্যুত করা হবে। গর্বাচভবিরোধী মনোভাব সবচেয়ে বেশি প্রবল হয়ে ওঠে সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। তাঁরা মনে করছিলেন, গর্বাচভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পরাশক্তি’র মর্যাদা ধ্বংস করছেন। ১৯৯১ সালের প্রথম দিকে মস্কোসহ বিভিন্ন শহরে এমন গুঞ্জন শোনা যায় যে অচিরেই একটা ‘পিরিভারোত’ (অভ্যুত্থান) হতে যাচ্ছে। ‘ঝেলেজনায়া রুকা’ (আয়রন হ্যান্ড) ফিরে আসতে আর দেরি নেই।
অন্যদিকে ইয়েলৎসিনে জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে চলল; লোকজন ভাবতে শুরু করল, এই লোক তাদের ‘ত্রাণকর্তা’; তিনি এই দুর্দশা থেকে তাদের উদ্ধার করবেন। ১৯৯১ সালের জুন মাসে রুশ প্রজাতন্ত্রের ভোটাররা ইয়েলৎসিনকে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করল। ইয়েলৎসিন ইতিমধ্যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা বন্ধ করেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পার্টির অনেক সদস্য। একটা সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে গণহারে পদত্যাগ শুরু হয়। এর পাশাপাশি প্রচুর সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার মানুষ ইয়েলৎসিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা সবাই অতি দ্রুত সোভিয়েত ব্যবস্থার ‘আমূল পরিবর্তন’ চাইছিলেন, কার্যত রাশিয়াকে পুঁজিবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন।
একদিকে দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার নামে আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি, অন্যদিকে আরও দ্রুত ও ব্যাপক সংস্কারের নামে বাজারব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার দাবি—এই দুইমুখী চাপে গর্বাচভ প্রায় দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি প্রকাশ্যে কট্টর সংস্কারপন্থী নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করলেন; সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এমন রদবদল আনলেন, যাতে মনে হয়, ক্ষমতা সেই সব লোকের হাতে সংহত করা হলো যাঁরা সংস্কারের বিরোধী। এটাকে কেউ কেউ বললেন স্বৈরতান্ত্রিক কট্টরপন্থার দিকে গর্বাচভের ডিগবাজি। তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কমরেডদের একজন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এদুয়ার্দ শেভার্দনাদজে রেগে গিয়ে পদত্যাগ করে বললেন, ‘স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসছে।’
কিন্তু গর্বাচভের সমাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চেষ্টা শুরু করতে বেশ দেরি হয়ে গেছে। তত দিনে তাঁর সূচিত সংস্কারের রেলগাড়িটা তাঁকে ছেড়ে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। সেই গাড়ির চালক তখন বরিস ইয়েলৎসিন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের রাষ্ট্রটি বিলুপ্ত হওয়ার আগে ওই দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে সমাজতন্ত্র। কার্যত এটা ঘটেছে সংবাদমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা; গ্লাসনস্তের সুযোগে সমাজতন্ত্রবিরোধী প্রচারণা সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের বৃহত্তর অংশকে ভীষণভাবে বদলে দিয়েছে। তাদের মনে উন্নত পুঁজিবাদী দুনিয়ার মতো বৈষয়িক সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে না বলে তাদের মনে হয়েছে।
তাই ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে গর্বাচভ ক্রিমিয়ায় অবকাশ যাপনের সময় কমিউনিস্ট পাটির কট্টর নেতারা যখন তাঁকে ‘অসুস্থ ও
দেশ চালাতে অক্ষম’ ঘোষণা করে অভ্যুত্থান ঘটাতে গেলেন, তখন জনগণ তার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এল। অভ্যুত্থানকারীদের সমর্থন জানাতে তাঁদের পক্ষের কেউ রাস্তায় নামেনি।
আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণ একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল, মাঝামাঝি সংস্কারমূলক পদক্ষেপে তারা আর তুষ্ট
থাকতে পারছিল না। ১৯১৭ সালেও তারা কেরেনস্কির বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, বৈপ্লবিক পরিবর্তন চেয়েছিল। বলশেভিকদের অক্টোবর বিপ্লব ঘটতে পেরেছিল সে কারণেই।
উভয় ঘটনায় জয় হয়েছে জনগণের চূড়ান্তবাদী প্রবণতার।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com