গরিব মানুষ ঘাটে ঘাটে মরে

সফিকুল (৪৫), ধলা (৫০), রহিমুদ্দী (৬০)। চিলমারী বন্দর থেকে নৌকায় চলেছেন শাখাহাতি ও কড়াইবরিশাল। গন্তব্যের দূরত্ব ৩ থেকে ৩ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল। দুজনের হাতে গতা ও শিং মাছ ধরার বেকড়ি। তাঁরা মাছ ধরার জন্য যাবেন চরগুলোর দোলাভূমিতে (নিচু ভূমি), বুকপানিতে বেকড়ি (বাঁশের ডগায় সুচালো লোহা দিয়ে মাছ ধরার যন্ত্র) চালিয়ে গতা ও শিং ধরবেন। আরেকজনের বাঁউঙ্কার (ঘাড়ে করে মাল বহনের জন্য বাঁশের তৈরি বাঁক) একপাশে চেংটা (গুড় দিয়ে তৈরি খাবার), বিস্কুট, চকলেট, হাতে বানানো চানাচুর। আরেক পাশে প্লাস্টিকের হরেক মাল। সবাইকে ভাড়া দিতে হবে ৪০ টাকা করে।

এ রকম শ দুয়েক নারী প্রতিদিন নৌকায় করে বিভিন্ন চরে যান। কেউ খড়ি কুড়ান, কেউ শাক। কিন্তু ভাড়া ওই ৪০ থেকে ৬০ টাকা। বিভিন্ন চরের খেয়ানৌকা তাঁদের আনা-নেওয়া করে। মানে চরের মানুষের কোনো সেবা রাষ্ট্র দিতে পারুক না পারুক, প্রাকৃতিক দুর্গমতাকে পুঁজি করে প্রভাবশালীরা ব্যবসা করবে।

২.

আসছে ঈদ। সবাই বলছে, এক কোটি লোক ঢাকা ছাড়বে। অর্ধেকের মতো মানুষ বাড়িতে ঈদ করবে মূলত ঈদের পরের দিন। ঈদ হবে আসলে মহাসড়কেই। অথচ নদ-নদীতে নতুন পানি আসছে। প্রতিদিন পানি বাড়ছে। ঈদ আসতে আসতে ফেরিও চলতে পারবে মোটামুটি। কিন্তু যাত্রীরা নৌপথে আগ্রহী নয় কেন?

গবেষণায় দেখা গেছে, টন-কিলোমিটারে (প্রতি কিলোমিটারে এক টন পণ্য পরিবহন) ডিজেলের খরচের হিসাব হলো এ রকম: সড়কপথে যেখানে খরচ হয় ২১৭ টাকা, রেলপথে তা ৮৫ ও নৌপথে তা ২৫ টাকা মাত্র। অথচ কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী-চিলমারী ১১ কিলোমিটার নৌরুটে ভাড়া হলো ১৫০ টাকা। সঙ্গে মোটরসাইকেল থাকলে ভাড়াও ওঠানামা করে। একইভাবে চিলমারী-সুন্দরগঞ্জের তিস্তা নদীর ১ দশমিক ৫ কিলোমিটারের ভাড়া ৫০ টাকা। শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানিপ্রবাহ ২০ মিটার হয় এবং নৌকা ঠেলে এক পার থেকে অন্য পারে নেওয়া হয়। সে সময়েও ভাড়া ৫০ টাকা দিতে হয়।

বুড়িগঙ্গা থেকে বা শীতলক্ষ্যা থেকে উজানে চিলমারী আসতে লাগে ২ দিন। ২ দিন মানে ৪৮ ঘণ্টা না, ১২ + ১২ = ২৪ ঘণ্টা। এক রাত নৌকায় আরামের ঘুমও আছে। চিলমারী বন্দরের মাঝি শওকাত (৫৫) জানান, বড় নৌকায় ৫০ থেকে ৬০ জন লোক অনায়াসে শুয়ে দুই দিনে ঢাকা থেকে চিলমারী পৌঁছাতে পারবে। রাতের বেলা নৌকা চালানো গেলে এক দিনেই আসা সম্ভব। চিলমারী থেকে ভাটিতে ঢাকা যেতে আরও কম সময় লাগবে। মাঝির নৌকার হিসাব আমরা লঞ্চে করতে পারি। এর ফলে নানা পণ্য পরিবহনে নৌপথ আরও সুগম হবে।

অন্যদিকে স্বাভাবিক সময়ে ময়মনসিংহ-রৌমারী বা জামালপুর হয়েও ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় চিলমারী আসা যায়, যেখানে কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসে লাগে ১০ ঘণ্টা ও বাসে ৯ ঘণ্টা। তবু ঈদ ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে এই রুটে যাত্রী চলাচল হয় না। বিপদে না পড়লে এই নৌরুট অব্যবহৃত থাকে কেন?

নৌপথগুলোয় সড়কের মতো মেরামতের খরচ নেই। নেই রেলপথের মতো পাথর বিছানোর ঝামেলা। তবু চিলমারী থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে রংপুরে যেতে ট্রেনে লাগে ৪০ টাকা আর বাসে লাগে ১২০ টাকা। আর সেখানে রৌমারী থেকে চিলমারী ১১ কিলোমিটার নৌপথে আসতে লাগে ১৫০ টাকা, শাখাহাতি চর থেকে জোড়গাছ হাট ৩ কিলোমিটার আসতে লাগে ৪০ টাকা। তার ওপর জলপথে গতিও কম। কেন এই বৈপরীত্য? কেন এই জুলুম?

নৌপথগুলোই ছিল বাংলার ধনীতম দেশের প্রধান কারণ। সুলতান ও নবাবেরা নৌপথের যত্ন নিতেন। তাই তাঁরা জলকর নিতেন। নৌপথের কারণেই চিলমারীর সঙ্গে রৌমারী-রাজীবপুর মিলে একটি সংসদীয় আসন। একসময় সুন্দরগঞ্জও চিলমারীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। চিলমারী বন্দরকে যে ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্যের লিভারপুল ও গ্লাসগোর সঙ্গে তুলনীয় বলত, তার কারণও এই নৌ যোগাযোগ।

৩.

শাহ মোমেন (৪৭), শিপন মিয়া (৩০) ও জামিউল ইসলাম বিদ্যুৎ (৩৫)। তাঁরা যথাক্রমে রৌমারী, রাজীবপুর ও চিলমারী উপজেলার রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির নেতা। চিলমারীর জামিউল ইসলাম বলেন, ‘গত বছর ঘাট ডাকছে ৪৫ লাখ টাকায়। এবার নাকি ১ কোটি টাকায় মন্ত্রীর লোকজন ইজারা নিছেন। ফলে ৭০ টাকার ভাড়া ১৪০ হইছে। বড় বিপদে না পড়লে কেউ ওপারে যায় না।’

একই কথা বলেন শাহ মোমেন ও শিপন মিয়াও। তাঁরা বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসক স্মারকলিপি দিয়েছি, মানববন্ধন করেছি। যে লাউ সেই কদু। এই যে বছর বছর ইজারা ডাক ডাবল হয়, ভাড়া তো এ কারণেই বাড়ে। গরিব মানুষ ঘাটে ঘাটে মরে।’

৪.

নৌপথগুলোই ছিল বাংলার ধনীতম দেশের প্রধান কারণ। সুলতান ও নবাবেরা নৌপথের যত্ন নিতেন। তাই তাঁরা জলকর নিতেন। নৌপথের কারণেই চিলমারীর সঙ্গে রৌমারী-রাজীবপুর মিলে একটি সংসদীয় আসন। একসময় সুন্দরগঞ্জও চিলমারীর সঙ্গে যুক্ত ছিল।

চিলমারী বন্দরকে যে ব্রিটিশরা তাদের সাম্রাজ্যের লিভারপুল ও গ্লাসগোর সঙ্গে তুলনীয় বলত, তার কারণও এই নৌ যোগাযোগ। ভূপেন হাজারিকার গান, ‘মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র মহামিলনের তীর্থ/ কত যুগ ধরি আইসে প্রকাশি সমন্বয়ের অর্থ।’

স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ব্রিটিশদের কথা চেপে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলায় এই গাফিলতির সূচনা হয় মারাঠা-আফগান যুদ্ধের সময়। এ ছাড়া গোড়ার দিকের ব্রিটিশ বণিক ও নাবিকেরা সেচকাজ বিষয়ে কিছুই জানত না। যুদ্ধের পর এ রকম অজস্র জলপথ অব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত দেখে তারা ভেবেছিল, নদীগুলো কেবল জলপথে চলাচলের জন্য এবং তারাও ফেলে রাখল।’ (বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা, অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ, ডাকঘর, ২০২১)

সেই থেকে নদ-নদীগুলো অযত্নেই পড়ে আছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের কাছে নিলাম দিয়ে ঘাটে ঘাটে কর নেওয়া হচ্ছে। একে তো জলপথে গতি কম, তার ওপর ভাড়া বেশি। মানুষ কেন নৌপথে চলবে?

নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক। nahidknowledge@gmail.com