খোলা চোখে

গরিবের ঘোড়া রোগ

নিউইয়র্কে দুই বাঙালি ভদ্রলোক গৃহকর্মীকে সময়মতো বেতন না দেওয়ার অভিযোগে এখন জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছেন। তাঁদের একজন বাংলাদেশ সরকারের কূটনীতিক, অন্যজন জাতিসংঘের বড় কর্মকর্তা। তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলো খুব গুরুতর। বাংলাদেশে গৃহকর্মীকে যা খুশি একটা পারিশ্রমিক দিয়ে কাজ করানো যায়, কিন্তু আমেরিকায় তা সম্ভব নয়। এ দেশে ন্যূনতম বেতন ধার্য করা আছে, ঘণ্টাপ্রতি সাড়ে ১০ ডলার। সার্বক্ষণিক কর্মী হলে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে, যেমন সময়মতো বেতনসমেত ছুটি, স্বাস্থ্যবিমা ইত্যাদি। আমাদের দেশের এ দুই ভদ্রলোকের এসব নিয়মকানুন না জানার কথা নয়। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে 

আনা অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে ধরে নিতে হয় যে তাঁরা কম মাইনে দিয়ে গৃহকর্মীদের খাটাতে চেয়েছিলেন।

অভিযোগের বিবরণ অনুয়ায়ী, তাঁরা দুজন যে একদম হৃদয়হীন তা নয়। কূটনীতিক সাহেব ভাবলেন, মাঝেমধ্যে গৃহকর্মীর দেশের বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেই হবে। কিন্তু বেতন যে দিচ্ছেন, তার প্রমাণ তো চাই। বলা তো যায় না, দেখা গেল সেই কাজের লোক বেতন পান না বলে অভিযোগ করে বসলেন। কয়েক বছর আগে একজন ভারতীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেল গৃহপরিচারককে যথাযথ বেতন না দেওয়ায় নাকাল হয়েছিলেন। তাঁকে হাতকড়া পরে জেলে যেতে হয়েছিল, পরে এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কূটনীতিক সাহেব ঠিক করলেন বেতন দেওয়ার একটা প্রমাণ সঙ্গে রাখবেন। বাসায় আসা অতিথিরা মাঝেমধ্যে ওই কর্মচারীকে যে টিপস দিতেন, সেটাই ব্যাংকে সেই গৃহপরিচারকের বেতন হিসেবে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

জাতিসংঘের কর্মকর্তা ভদ্রলোক বুদ্ধিতে আমাদের কূটনীতিকের চেয়েও সেয়ানা। গৃহকর্মীর কথা বলে অফিস থেকে ভিসা আদায় করেছেন, অফিস তো জানতে চাইবে তাঁকে বেতনপাতি দেওয়া হচ্ছে কি না। অভিযোগ হচ্ছে, তিনি প্রথমে গৃহকর্মীর সঙ্গে যথারীতি একটি চুক্তি করলেন, যাতে বলা হলো প্রতি সপ্তাহে ৪২০ ডলার দেবেন। ভিসা নেওয়ার সময় সেই চুক্তি দেখাতে হয়েছিল। অফিসকেও তার কপি জমা দিতে হয়েছিল। কিন্তু সপ্তাহে অত ডলার বেতন দেওয়ার কোনো ইচ্ছাই তাঁর ছিল না। তিনি ওই কর্মচারীর সঙ্গে আরেকটি চুক্তি করলেন, তাতে প্রতি সপ্তাহে বেতন ধার্য করা হলো ২৯০ ডলার। সেখান থেকে খোরপোষের জন্য সপ্তাহে ৭৫ ডলার কেটে রাখার ব্যবস্থাও করে নিলেন। এই চুক্তির একটি কপি তিনি নারী গৃহকর্মীর কাছে রাখতে দিলেন, তবে বেতনের পয়সা তাঁকে না দিয়ে বাংলাদেশে তাঁর স্বামীর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। বিষয়টি নিয়মসিদ্ধ করতে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হলো, তবে প্রথম দিন অ্যাকাউন্ট খোলা ছাড়া বাকি সব কাজ তিনি নিজেই করতেন। যে ব্যাংক কার্ডটি পেলেন, তার মাধ্যমে প্রতি মাসে মোট ১ হাজার ৬০০ ডলার জমা দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। কিন্তু তা কেবল কাগজে-কলমে। নারী গৃহকর্মী, যিনি এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না, এই অর্থের এক পয়সাও খরচের অধিকার পেলেন না। ব্যাংক কার্ডটি তাঁর নামে হলেও সেই জাতিসংঘ কর্মকর্তা নিজেই চেক জমা দিতেন, সময়মতো সেই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিজেরাই খরচ করতেন। এদিকে অফিসে চেকের প্রমাণপত্রসহ যাবতীয় হিসাব দাখিল করা। বলা হলো, চুক্তিমতো সব বেতন মেটানো হচ্ছে।

এসব কথা আমরা কিছুই জানতাম না। তাঁদের দুজনের সঙ্গেই আমাদের দেখা হয়েছে, কেউ কেউ তাঁদের বাসায় খানাপিনায় অংশও নিয়েছি। গত মাসে হঠাৎ জানা গেল, এ দুই কর্মচারী কাজ ছেড়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, সেখান থেকে ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিসে। কয়েক মাস ধরে কুইন্সের ও ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস তাঁদের উত্থাপিত অভিযোগগুলো তদন্ত করে বিস্তর প্রমাণপত্র সংগ্রহের পর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। তখনই বোমা ফাটানোর মতো এ ঘটনা জানা গেল। কূটনীতিক সাহেবের ক্ষেত্রে একজন ডিটেকটিভের নেতৃত্বে এবং হিসাব তদন্তকারীর (অ্যাকাউন্ট ইনভেস্টিগেটর) সহায়তায় জনা ছয়েকের এক টিম লম্বা সময় ধরে প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করে দেখে। জাতিসংঘের কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও তাই, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির তত্ত্বাবধানে সেই কাজ পরিচালনা করেন একজন স্পেশাল এজেন্ট।

প্রতিটি অভিযোগ তন্ন তন্ন করে খোঁজ নিয়ে তবেই আদালতের সামনে অভিযোগনামা দাখিল করা হয়। গৃহকর্মীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও তাঁর ব্যাংক কার্ড যে জাতিসংঘের কর্মকর্তা বা তাঁর আমেরিকান স্ত্রী ব্যবহার, তার প্রমাণ হিসেবে এই দুজনের ভিডিও ইমেজও দাখিল করা হয়।

এই কাহিনি পত্রিকায় বেরিয়েছে, আপনারাও হয়তো পড়েছেন। তাঁরা কেউই এখনো দোষী সাব্যস্ত হননি, কেবল অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁদের অভিযোগনামার ফিরিস্তি আমাকে নতুন করে দিতে হলো শুধু এ কথা বোঝাতে যে নিউইয়র্কের পুলিশ বা মার্কিন বিচার বিভাগ কোনো গোপন যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এ দুই বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেনি। তাঁদের বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ কোনো বিরাগ নেই। অভিযোগ যদি মিথ্যা হয়, আদালতেই তা প্রমাণ করতে হবে। আমি সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে পুরো ব্যাপারটা মিথ্যা। তারা ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাকে তলব করে ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়েছে। বলেছে, কূটনীতিক মহোদয়কে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যখন যুক্তরাষ্ট্রের আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তখন এমন মুক্তির দাবিতে মার্কিন বিচার বিভাগের কিছু যাবে আসবে বলে মনে হয় না।

কূটনীতিক ভদ্রলোক নিউইয়র্কের কনস্যুলেটে সহকারী প্রধান ছিলেন, দুই দেশের মধ্যে চুক্তি অনুসারে তাঁর রয়েছে সীমিত কূটনৈতিক নিষ্কৃতি বা ডিপ্লোম্যাটিক ইম্যুনিটি। পুরো ইম্যুনিটির সুযোগ দেওয়ার জন্য দিন কয়েক আগে তাঁকে কনস্যুলেট থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে স্থানান্তর করা হয়েছে। কিন্তু চাকরি বদল হলো মানেই যে তিনি ইম্যুনিটি পেয়ে গেলেন, এমন নয়। ইম্যুনিটি দেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, সে জন্য সবার আগে দরকার ভদ্রলোকের পাসপোর্টটি। কিন্তু সেটি তো আদালতের হাতে। নতুন আরেকটা পাসপোর্ট যাতে তাঁকে না দেওয়া হয়, আদালত থেকে তার আগাম নির্দেশও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আমার কথা হয়েছে। আমি নিজে জাতিসংঘে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। নতুন-পুরোনো সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। কূটনীতিকদের দাবি, তাঁরা যে বেতন পান এবং ‘মনোরঞ্জন’ (এন্টারটেইনমেন্ট) বাবদ যে যৎসামান্য এলাউন্স পান, তা দিয়ে গৃহকর্মীর নিয়মমাফিক বেতন দেওয়া সম্ভব নয়। চার বছর আগে ভারতীয় ডেপুটি কনসাল জেনারেলের বেলায়ও একই যুক্তি দেখানো হয়েছিল। আমার প্রশ্ন, যথাযথ বেতন দেওয়া যদি আপনার আয়ত্তের বাইরে হয়, তাহলে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী রাখার প্রয়োজনটা কী? এ দেশে কোটিপতি মানুষের বাসায়ও তেমন হাউসকিপার সচরাচর দেখা যায় না।

কূটনীতিকেরা আমাকে যুক্তি দেখিয়েছেন, তাঁদের পেশাদারি দায়িত্ব পালনের খাতিরেই গৃহকর্মী দরকার। পেশাদারি দায়িত্ব মানে মাঝেমধ্যে তাঁদের দেশি-বিদেশি বন্ধু ডেকে ‘পার্টি’র ব্যবস্থা করা। এই যুক্তি যদি মেনেও নিই, তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, মাসে ঠিক কতবার তাঁরা পার্টির আয়োজন করে থাকেন? আমি যদ্দুর জানি, মিশনপ্রধান ছাড়া বাকি প্রায় সবাই ব্যক্তিগত অতিথিদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করে থাকেন, এর কোনোটাই পেশাদারি দায়িত্ব পালন নয়। যে টাকাটা মনোরঞ্জনের জন্য পাওয়া গেল, তার পুরোটাই যাঁর যাঁর পকেটে। বিভিন্ন জাতীয় উৎসব উপলক্ষে মিশনে বা কনস্যুলেটে পানাহারের ব্যবস্থা হয়, তাতে দপ্তরের বড়-ছোট সবাই হাত লাগান। অনেক ক্ষেত্রেই বাইরে থেকে আহারের ব্যবস্থা করা হয়। তাহলে ঘরে ঘরে গৃহকর্মী রাখার দরকারটা কী?

জাতিসংঘের কর্মকর্তার বিষয়টি তো আরও ভয়াবহ। তিনি দারিদ্র্য নিয়ে কাজ করেন, দুর্নীতি দমন বিষয়ে তাঁর মোটা মোটা গবেষণাপত্র আছে, তিনি মানবাধিকার নিয়েও কাজ করেছেন। তিনি কোন বুদ্ধিতে দেশ থেকে গৃহকর্মী এনে তাঁকে নিয়মমাফিক বেতন না দিয়ে জালিয়াতি করতে গেলেন? কোনো ইউরোপীয় অথবা মার্কিন জাতিসংঘ কর্মকর্তার বাসায় সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী আছে এমন কথা তো আমি শুনিনি। কূটনীতিক মহোদয় ‘এন্টারটেইনমেন্ট এলাউন্সের’ দোহাই দিতে পারেন, জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা কিসের দোহাই দেবেন? জাতিসংঘের পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর তো সেই সমস্যা থাকার কথা নয়। তাহলে?

সত্যি কথা হলো, কূটনীতিক হই বা জাতিসংঘের বড় কর্মকর্তা হই, আমরা কেউই গৃহকর্মীদের ঠিক মানুষ বলে জ্ঞান করি না। দেশেও করতাম না, বিদেশেও না। কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাবেন, যে অর্থ বেতন হিসেবে দেওয়া হয়েছে, এর বেশি গৃহকর্মীদের কবে কে দিয়েছে? মানছি, কূটনীতিক ভদ্রলোকের বাসায় বখশিস হিসেবে যে অর্থ গৃহকর্মীটি পেতেন, বাংলাদেশের হিসাবে তা কয়েক গুণ বেশিই হবে। জাতিসংঘের কর্মকর্তা তাঁর নারী গৃহকর্মীর নামে দেশে তাঁর বাড়িতে টাকা পাঠাতেন, তা–ও নিশ্চয় দেশের তুলনায় বেশি বই কম হবে না। সমস্যা হলো, আমেরিকায় থাকতে হলে এ দেশের আইনকানুন মেনে চলতে হয়। উভয় কর্মকর্তা যেমন এখানে দেশের তুলনায় বহুগুণ বেশি বেতন পান, তাঁদের গৃহকর্মীদেরও দেশের তুলনায় নিয়মমাফিক কয়েক গুণ বেশি বেতন পাওয়ার কথা।

এই সহজ কথাটা মাথায় রাখলে এই বঙ্গসন্তানদের এভাবে কেঁচে যেতে হতো না।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি