বোকা কিংবা বুদ্ধিমান—দুদিক থেকেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বিখ্যাত। গল্পের হোজ্জায় দুজনেরই দেখা মেলে। হোজ্জার নামে চালু আছে হাজারটা গল্প। তার কোনো কোনোটি আবার মিলে যায় অন্য কোনো এমন গল্পের চরিত্রের সঙ্গে। সে আলোচনায় যাওয়া অবান্তর। মূলত, হোজ্জার একটি গল্প মনে পড়াতেই এই গৌরচন্দ্রিকা।
গল্পটি বলা যাক। হোজ্জা কোনো এক পন্থায় বেশ টাকা কামিয়েছেন। কিন্তু কঞ্জুস স্বভাবটি যায়নি। একদিন ঘরের চাল ঠিক করছেন। মই বেয়ে চালে উঠে কিছু একটা বাঁধাছাদা করছেন। এমন সময় দুই লোক এল তাঁর দরজায়। বসন-ভূষণে দারিদ্র্য সুস্পষ্ট। অনেক ডাকাডাকির পরও কোনো সাড়া না পেয়ে ওপরে তাকিয়ে তাঁরা দেখলেন হোজ্জাকে। লোক দুটির চোখে ধরা পড়ার পর হোজ্জা মিষ্টি করে হাসলেন। কিন্তু হাসিতে কি চিড়ে ভেজে? ফলে, লোক দুটি হোজ্জাকে বললেন, একটু কথা শুনে যাও। হোজ্জা অগত্যা নেমে এলেন। লোক দুটি নিজেদের দুর্গতির কথা সবিস্তারে তুলে ধরে কিছু সাহায্য চাইল। এবার হোজ্জা কোনো বাক্যব্যয় ছাড়াই আবার মই বেয়ে চালে উঠে গেলেন। লোক দুটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার ডাকাডাকি শুরু করল। এবার হোজ্জা তাদের ডাকলেন চালের ওপর। লোক দুটি মই বেয়ে হোজ্জার কাছে যেতেই তিনি বললেন, হবে না, হাত খালি।
এই হলেন হোজ্জা। এই হোজ্জা এখনকার সময়ে হাজির হলে কী করতেন? এই প্রশ্ন রীতিমতো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। আর সময়ের সঙ্গে স্থানের প্রসঙ্গটি জুড়ে দিলে হোজ্জাকে নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে নিশ্চিতভাবে। বিশেষত, সেই স্থান যদি হয় বাংলাদেশ এবং সময়টি এই সময়, তবে তো আর কোনো কথাই নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই সময়ের বাংলাদেশে এলে হোজ্জার মতো বোকা সেজে থাকা বুদ্ধিমানেরও নাভিশ্বাস উঠে যেত। কারণ, এই সময় ও বাংলাদেশ এক কথায় ‘হতবুদ্ধিকর’।
দেশে এখন নির্বাচনী আবহ। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে। আবার নির্বাচনকালীন সরকার, প্রশাসন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনাও চলছে। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কথাও আসছে। ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সংবিধান’ শব্দ দুটি বরাবরের মতোই নিজের জনপ্রিয়তার প্রমাণ রেখে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। সব পক্ষই এই দুটির প্রতি নিজের অশেষ শ্রদ্ধা প্রকাশ করছে, যেন কোনো এক যুগল অবতার, কাউকে নিরাশ করে না। হত্যার শিকার ও হত্যাকারী দুইকেই তুষ্ট করার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা তার হাতে। সবকিছুই হচ্ছে গণকে সামনে রেখে। অথচ গণকে কোনো প্রশ্নই করা হচ্ছে না। নির্বাচনের এই খেলায় জনগণকে বিবেচনা করা হচ্ছে অনেকটা সুন্দরবনের মতো কিংবা সেই ক্ষয়িষ্ণু নদীটির মতো, যে নিজের অস্তিত্বের সংকটের কথা বলতে পারে না শ্রুতিগ্রাহ্যভাবে। যদিও বিরাট প্রকৃতি ও তার অংশ মানুষের বলার আছে অনেক কিছু, আছে ভাষাও।
দেশে নির্বাচন হবে, এটা ভালো কথা। নির্বাচন এই দেশে উৎসবের মর্যাদা পায়। মানুষ নির্বাচন খুব ভালোবাসে। একটা ভীষণ উদ্দীপনা থাকে মানুষের মধ্যে। কিছু মানুষ কোনো দলই হয়তো করে না। কিন্তু নির্বাচনের সময় রংবেরঙের পোস্টার, আর নানা প্রকরণের প্রচার দেখে বেড়ায়, পথে-ঘাটে। মোড়ে মোড়ে বসে চায়ের আড্ডা। নির্বাচন এলেই মানুষের দাম বেড়ে যায়—এটাই চিরাচরিত দৃশ্য। একেবারে অভাবিতভাবে কোনো উঁচুতলার মানুষ নিজের পায়ে লোকদেখানো হলেও ধুলো মাখবেন, কারও ঘামে ভেজা পিঠে হাত রেখে বলবেন, ‘কেমন আছেন?’ এমনটাই হয়ে আসছে এই দেশে। বলার অপেক্ষা রাখে না এই লোকদেখানো বিষয়টি মানুষও বোঝে-জানে। কিন্তু ওই যে অল্পেই তুষ্ট বাঙালি; সব জেনে-বুঝেও এই হঠাৎ সমাদরে তার বিগলিত হওয়াটা তাই দস্তুর। এই সবই ঘটে আসছিল রীতিসিদ্ধভাবে এই বাংলাদেশে। কিন্তু হঠাৎ যেন ছন্দপতন।
এখন আর গায়ে-মাথায় হাত রাখার প্রয়োজন হচ্ছে না। কেউ কাউকে প্রশ্ন করছে না, লোকদেখানো জানতে চাইছে না কুশল। উঁচুতলার লোকেরা উঁচুতে বসেই জানিয়ে দিচ্ছে, ‘মানুষ ভালো আছে, তারা আমাকেই চায়।’ এই শুনে বিপরীতে থাকা আরেকটি পক্ষ তখন তেড়েফুঁড়ে বলছে, ‘না না, মানুষ বীতশ্রদ্ধ, সে মুক্তি চায়।’ সবার গলাই উঁচুতে। কেউই একটু কণ্ঠ নিচে নামিয়ে, কানকে সজাগ করে জানতে চাইছে না, আদতে কী চাই মানুষের। ডিজিটাল ঘেরাটোপ, উন্নয়ন, লক্ষ্য ও সম্ভাবনা, পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগ, পাগলাটে যানজট, ক্রমে নৃশংস হয়ে ওঠা প্রেম (প্রেমিক দাবি করা এক তরুণের পছন্দের মানুষ ও তার পরিবারকে ক্ষতবিক্ষত করার খবর বেরিয়েছে এই সেদিন), সড়কের অনিশ্চয়তা, সুন্দরবনের বাঘের বিষণ্ন চোখ—এই সবকিছুকে সামনে রেখে মানুষ আসলে কী বলতে চায়, তা কেউই শুনতে প্রস্তুত নয়। প্রতিটি দল-উপদল একজন আরেকজনের ঘাড়ে চড়ে বলতে চাইছে, আমরাই সেরা। যেন এক বিরাট বিজ্ঞাপন বিরতিতে পড়ে গেছে গোটা দেশ। জনগণকে নিয়ে মূল অনুষ্ঠানের বাকি অংশ দেখা যাবে এরপরই। অথচ বিজ্ঞাপন শেষ হয় না। বরং দেখেশুনে মনে হয়, এই তো কেবল শুরু। উপাধি ও উপমায় ছেয়ে যাচ্ছে দেয়ালগুলো। সিনেমার পোস্টার থেকে আর আলাদা করা যাচ্ছে না, রাজনৈতিক পোস্টার। ব্যানারগুলো কোচিং সেন্টারের মতো করেই দিচ্ছে নানা প্যাকেজ সংবাদ। জনগণকে উদ্দিষ্ট করে চলমান এই কর্মযজ্ঞের কোথাও জনগণই নেই।
আবার ফিরে যাই হোজ্জার কাছে। হোজ্জা কোনো এক পন্থায় গ্রামের হর্তাকর্তা বনে গেছেন। পন্থাটি বিবেচ্য নয়। হর্তাকর্তা বিষয়টিই গুরুত্ববহ। দীর্ঘদিন এই ভূমিকায় কাজ করছেন হোজ্জা। আনন্দও পাচ্ছেন। নিজেকে একেবারে রূপকথার অসীম ক্ষমতাধর কোনো রাজা মনে হচ্ছে। হোজ্জা খুশি। কিন্তু গ্রামে হঠাৎ তোলপাড়। হোজ্জা অনিচ্ছায় চোখ মেললেন। দেখলেন, বহু পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। তাদের কারোরই হোজ্জার সুখ সহ্য হচ্ছে না, এমনটাই মনে হলো হোজ্জার। তাদের নানাভাবে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, তাড়িয়ে-বেড়িয়ে কেটে গেল আরও কিছু কাল। কিন্তু কাজ হলো না। রীতি বলে তো একটা কথা আছে। হোজ্জা এবার ডেকে পাঠালেন বাকি পক্ষগুলোকে। তারা এল বিরাট বিরাট বহর নিয়ে। হোজ্জাও তাঁর চ্যালাদের নিয়ে শুনলেন সব কথা। পক্ষগুলো বলার অপেক্ষা রাখে না, গিয়েছিল অনেক আশায়। কারণ, ক্ষমতাহীনতা তাদের ট্যাঁকেও ভাটার টান নিয়ে এসেছে। এই কারণে তারা এ থেকে নিস্তারের পথ খুঁজছে। হোজ্জা সব শুনলেন। তাঁর মনে পড়ল সেই দরিদ্র দুই লোকের কথা, যাদের তিনি দারুণ দক্ষতায় মইয়ের আগায় তুলে চূড়ান্তভাবে ‘খারিজ’ করেছিলেন। মনে হলো, আর্থিক ব্যবস্থাপনার এ বুদ্ধি তো এই মসনদি সমীকরণেও কাজে লাগতে পারে। বললেন, ‘সিদ্ধান্ত পরে জানানো হবে।’ দুদিন যায়, পাঁচ দিন যায়, হোজ্জা কিছু বলেন না। এদিকে তাঁর অমাত্যরা নানা কথা বলে। বাতাসে ভাসে তার চেয়েও বেশি। হোজ্জা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন। এভাবে দিন কাটাতে থাকেন হোজ্জা। প্রতিপক্ষের লোকজন উন্নয়ন উন্নয়ন বলে গ্রামজুড়ে আলোড়ন তোলে। তারপর হঠাৎ করেই হোজ্জার এক মিত্র জানিয়ে দেন, ‘হবে না।’ সবাই স্তব্ধ। হোজ্জা হাসেন। তিনি প্রস্তুতি নেন আরেক মেয়াদে কর্তা হওয়ার। হোজ্জা ভাবেন, গণ ফেলে রেখে তন্ত্রের কলে তেল ঢেলে জীবন তো ভালোই যাচ্ছে। কিন্তু গণ তখন কী ভাবছে, তা হোজ্জা টের পাচ্ছেন না।