আমাদের সরকারি প্রশাসনে ও সংসদীয় বিতর্কে মাঝেমধ্যে একটা শব্দ শোনা যায়, তা হলো গণশুনানি। তবে শব্দটি যত বেশি শোনা যায়, তত বেশি তা দেখা যায় না।
গণশুনানির অর্থ হলো জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়, ঘটনা বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সাধারণ মানুষ বা ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, মতামত ইত্যাদি প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে শোনা ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার যথাসম্ভব প্রতিকার করা। কোনো কোনো অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধানও করা হয়, প্রচলিত দাপ্তরিক বা আইনি প্রক্রিয়ায় যার সমাধান হতে অনেক সময় লেগে যেত, হয়তো কোনো দিনই যার সমাধান হতো না।
গণতান্ত্রিক সমাজে গণশুনানি একটি কার্যকর প্রক্রিয়া। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান এর চেয়ে সুন্দরভাবে ও ভালোভাবে তাঁর মক্কেলদের (ক্লায়েন্ট) অভিযোগ, মতামত ও পরামর্শ শোনার আর সুযোগ পাবেন না। অবশ্য প্রতিষ্ঠানপ্রধান এ ব্যাপারে আগ্রহী হলেই শুধু গণশুনানির আয়োজন করা হয়ে থাকে। আমাদের সরকারি প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে ‘গণশুনানি’ এখনো একটি নিয়মিত বা পরিচিত কর্মসূচি হিসেবে স্থান লাভ করেনি। কারণ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসন বা সরকারি অফিস এখনো জনবান্ধব নয়। হয়তো সারা দেশে হাতে গোনা কিছু সরকারি অফিস জনবান্ধব হতে পারে। সরকারি অফিস সাধারণ মানুষের কাজ সহজ করার পরিবর্তে অনেক সময় জটিল করে তোলে। সরকারি অফিস সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তবে সত্যের খাতিরে এ কথাও বলতে হবে, বহু সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী দিন-রাত পরিশ্রম করে মানুষের নানা সমস্যার সমাধান করে যাচ্ছেন। তাঁরা না থাকলে সরকারি প্রশাসন কি চলতে পারত?
সরকারি অফিসকে গতিশীল ও জনবান্ধব করার নানা প্রক্রিয়া রয়েছে। আমরা মনে করি তার একটি প্রক্রিয়া হলো গণশুনানি। এখানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান সরাসরি মক্কেল বা ভোক্তার কাছ থেকে অভিযোগ বা মতামত শুনতে পারেন। তাঁদের বক্তব্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান সমাধানমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। যদি তিনি সমাধানে আগ্রহী হন। বছরে অন্তত একবার গণশুনানির আয়োজন করতে পারলে ভালো হয়। প্রতিবছর যদি গণশুনানির আয়োজন হয়, তাহলে একটি প্রতিষ্ঠানের অনেক অনিয়ম দূর করা সম্ভব। সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা দু-তিন বছরের বেশি কোনো প্রতিষ্ঠানে থাকেন না। ব্যতিক্রম খুবই কম। কাজেই তাঁর পক্ষে প্রতিষ্ঠানের সব সমস্যা জানা বা বোঝা সম্ভব হয় না। প্রতিষ্ঠানটির চরিত্র বুঝতে বুঝতেই তাঁর বেশ কিছু সময় চলে যায়। তাই এ ধরনের গণশুনানি তাঁকে পেছনের অনেক কিছু এক দিনেই জানতে সহায়তা করে, যেসব বিষয় তাঁর অধস্তনেরা হয়তো তাঁকে কখনো বলতেন না। গণশুনানিতে ফাইল পুটআপের কোনো প্রয়োজন নেই। চিঠি গায়েব করারও কোনো সুযোগ নেই। ইচ্ছা করে ফাইল ‘হারিয়ে যাওয়ারও’ কোনো সুযোগ নেই।
তবে গণশুনানির আয়োজন করা সহজ কাজ নয়। এটা ১০ জন সহকর্মীকে নিয়ে অফিসের সভা করা নয়। এটা পাবলিককে নিয়ে বড় আকারের সভা। সভার তারিখ, সময়, স্থান, স্থানের ধারণ ক্ষমতা, দক্ষ র্যা পোর্টিয়ার, সভা সঞ্চালনার দক্ষতা, কতজনকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া যাবে, কত পর্বে সভাটি হবে, সমাগত ব্যক্তিরা কী কী বিষয়ে কথা বলবেন, কথা বলার জন্য প্রতিজনকে কতটুকু সময় বরাদ্দ করা হবে, মাইক্রোফোনের যথাযথ ব্যবহার ইত্যাদি অনেক কিছু বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের সভা সুশৃঙ্খলভাবে করতে না পারলে পুরো আয়োজনটিই পণ্ড হয়ে যেতে পারে।
অন্তত এক মাস আগে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণশুনানির ঘোষণা দিলে ভালো হয়। একটা ফরম পূরণ করে আগ্রহী ব্যক্তিরা গণশুনানিতে অংশ নিতে পারেন। আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হলে পর পর দুই দিন গণশুনানি হতে পারে। অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা মৌখিক বক্তব্যের পাশাপাশি একটি সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্যও কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে পারেন, যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ অভিযোগটি ভালোভাবে অনুসন্ধান করতে পারবে।
যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নানা ভোগান্তি হয় বলে জনমনে ধারণা জন্মেছে, সেই সব প্রতিষ্ঠানে গণশুনানি নিয়মিত হওয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগে নানা কর্মকর্তা-কর্মচারীর হাতে সাধারণ মানুষ যে কতভাবে ভোগান্তি, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হয়, তা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানতেই পারেন না। সংবাদপত্রে বা টিভির খবরে তার এক-দশমাংশ চিত্রও প্রতিফলিত হয় কি না সন্দেহ।
>অন্তত এক মাস আগে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গণশুনানির ঘোষণা দিলে ভালো হয়। একটা ফরম পূরণ করে আগ্রহী ব্যক্তিরা গণশুনানিতে অংশ নিতে পারেন। আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হলে পর পর দুই দিন গণশুনানি হতে পারে
আমাদের সরকারি প্রশাসনিক সংস্কৃতিতে মন্ত্রণালয়ের আমলা, সচিব বা মন্ত্রীর কাছে তাঁদের অধীন প্রতিষ্ঠানের সব খবর ঠিকভাবে পৌঁছায় না। পৌঁছার কোনো ব্যবস্থাও নেই। ফলে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে অধীন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও ভোগান্তির কথা জানার কথা নয়; ব্যতিক্রম ছাড়া। এ ধরনের গণশুনানি হলে তার খবর যখন সংবাদপত্র ও টিভিতে প্রচারিত হবে, তখন মন্ত্রী বা সচিবের এমনকি প্রধানমন্ত্রীরও টনক নড়তে পারে। এভাবে গণশুনানির মাধ্যমে সরকার চাইলে প্রশাসন তথা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মক্ষমতা, কার্যকারিতা আরও বাড়াতে পারে। গণশুনানি যেহেতু এখনো বাধ্যতামূলক নয়, সেহেতু প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা তা এড়িয়ে যেতে পছন্দ করেন। কারণ গণশুনানির ফলে প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম, দুর্নীত, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ইত্যাদি জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়তে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধানই তাতে স্বস্তি বোধ করবেন না। আমাদের দেশে গণশুনানি না হওয়ার এটাই প্রধান কারণ। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী বা সচিবেরাও কখনো এ ব্যাপারে আগ্রহী হননি। কারণ কেউ চান না সরকারি অফিসের দুর্বলতা জনসমক্ষে উন্মোচিত হোক।
তবে আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সচিব সবাই আন্তরিকভাবে চান প্রতিটি সরকারি অফিস জনবান্ধব হোক। সরকারি অফিসে যেন মানুষ ভালো সেবা ও সুবিচার পায়। মানুষের যেন কোনো হয়রানি না হয়। যদি সরকার তা আন্তরিকভাবে চায়, তাহলে ব্যাপক জনগণের সঙ্গে কাজ করে, সে রকম সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর গণশুনানির আয়োজন করার জন্য সরকারপ্রধান নির্দেশ দিতে পারেন। সেই গণশুনানির বিবরণ সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারেও যেন প্রচারিত হয়। সরকারপ্রধান নির্দেশ না দিলে তা নিয়মিত হবে বলে মনে হয় না। সরকারপ্রধান গণশুনানির জন্য নির্দেশ দেবেন এ জন্য যে এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান জবাবদিহির মধ্যে আসবে, অনেক বেশি সক্রিয় ও গতিশীল হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান গতিশীল হলে সরকার প্রশংসিত হবে।
গণশুনানিতে কী কথা হয়? অনেকের মনে এ প্রশ্ন জাগতে পারে। তা বোঝানোর জন্য প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনের সহায়তা নিচ্ছি। গত ২৭ জানুয়ারি (২০১৬) ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে রাজউকের উদ্যোগে এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। রাজউকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য আয়োজিত এই গণশুনানিতে ৭০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ওই দিন ৩০টি অভিযোগের শুনানি হয়। এসব অভিযোগের মধ্যে ছিল: টাকা জমা দিয়েও প্লটের দখল না পাওয়া, লটারিতে বিজয়ী হয়েও প্লট না পাওয়া, অবৈধ স্থাপনা ভাঙার আবেদন করার পরও না ভাঙা, ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লট পাওয়ার কথা থাকলেও না পাওয়া, নামজারি, প্ল্যান পাস করার ক্ষেত্রে হয়রানি-সংক্রান্ত। (প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬)
একজন অভিযোগকারী (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব) বলেছেন, রাজউকের একটা নথি দেখতে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছে। আরেকজন বলেছেন, তাঁর শ্বশুর ১৯৮৭ সালে আড়াই কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। কিন্তু দুই যুগ পার হয়ে গেলেও তিনি তা এখনো বুঝে পাননি। পূর্তমন্ত্রী, পূর্তসচিব ও রাজউকের চেয়ারম্যান ওই গণশুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী পর্বে বক্তারা বলেন, কেবল দোষারোপ করাই এই শুনানির উদ্দেশ্য নয়; বরং অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা এর উদ্দেশ্য।
আশা করি এই একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে আমরা বোঝাতে পেরেছি গণশুনানিতে কী হয়। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের গণশুনানি এক রকম
হবে না। প্রতিষ্ঠানের সার্ভিসের ওপর গণশুনানির চরিত্র নির্ভর করবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ৯ মে ঢাকার বিআরটিএ নিয়ে একটি গণশুনানির আয়োজন করেছিল। খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে ঘুষের কারবার বেশি বলে জনগণ বিশ্বাস করে, সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে দুদক সিরিজ গণশুনানির আয়োজন করতে পারে।
যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের গণশুনানি হতে পারে সেগুলো হলো: দুদক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ভূমি অফিস, সরকারি বিদ্যালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ বিমান, সরকারি ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিআরটিএ ও অন্যান্য। রাজধানী পর্যায়ে, বিভাগীয় পর্যায়ে বা জেলা পর্যায়েও এ রকম শুনানি হতে পারে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের সেবা করার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই সেবা ছাড়া অন্য কিছু হলে তা সরকারকে জানতে হবে। এই জানার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হলো গণশুনানি।
আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রয়েছে নানা দুর্বলতা। গণশুনানির মাধ্যমে সব দুর্বলতা রাতারাতি দূর হয়ে যাবে এমন আশা করি না। তবে গণশুনানি কিছুটা দুর্বলতা যে দূর করতে পারে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে গণশুনানি একটা বার্ষিক অনুষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই প্রত্যাশা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।