অবশেষে গণমাধ্যমকর্মী আইনটি সংসদে উপস্থাপিত হয়েছে। এ পর্যন্ত আসতে সময় লাগল ১০ বছর। সাংবাদিকদের দাবিদাওয়ার সময় হিসাব করলে যোগ হবে আরও ৫ বছর।
এই আইনের একটি বড় পূর্ব ইতিহাস আছে। ভারত ভাগ হয়ে যখন পাকিস্তান হলো, তখন দেখা গেল, সব পেশায় শৃঙ্খলা আনার জন্য নানা আইনকানুন-বিধি আছে, কিন্তু সাংবাদিকতার জন্য কিছুই নেই। ধারণা করি, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী অবিভক্ত ভারতে তাদের গোটা শাসনামলে সংবাদমাধ্যমকে যেহেতু শত্রুপক্ষ ভাবত, আবার অন্যদিকে সে সময়কার সাংবাদিকতা পুরোটাই যেহেতু শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেহেতু এ পেশা (তখনো সংবাদমাধ্যমশিল্প হয়নি) নিয়ে কালাকানুন ছাড়া কোনো কানুন প্রণীত হয়নি। এ অবস্থায় সাংবাদিকদের মর্যাদা ও বেতন-ভাতা নির্ধারণে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রস্তাব করেন সদস্য নূর আহমেদ। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান প্রেস কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন রিপোর্ট পেশ করে ১৯৫৯ সালে। এ রিপোর্টের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৬০ সালে জারি করা হয় দি ওয়ার্কিং জার্নালিস্ট (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অরডিন্যান্স। এই আইন বলেই ১৯৬০ সালে বিচারপতি সাজ্জাদ জানের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রথম ওয়েজ বোর্ড। ১৯৬১ সালে ৩১ ডিসেম্বর প্রথম ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় ওয়েজ বোর্ড হওয়ার কথা ছিল ১৯৬৬ সালে। সে সময়কার অগ্নিগর্ভ পাকিস্তান, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আবার সেই শূন্যতা দেখা দিলে সাংবাদিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকার ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জারি করেন নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অরডিন্যান্স। এ আইনের অধীনই সাংবাদিক ও সংবাদপত্র বোর্ড কর্মচারীদের ওয়েজ বোর্ড হয়ে আসছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে ৬ষ্ঠ ওয়েজ বোর্ড গঠনের সময় ধরা পড়ল, বিএনপি সরকার কোনো অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে এ আইন বাতিল করে দিয়েছে। ২০০৬ সালে শ্রম আইন সংশোধনের সময় এ আইন বাতিল করে শুধু সংবাদপত্রের জন্য কয়েকটি বিষয় সংযোজন করা হয় শ্রম আইনের কয়েকটি ধারায় (১৪৩/১৪৪/১৪৫/১৪৬/১৪৭/১৪৮)। শ্রম আইন অনুযায়ী এরপর গঠিত হলো মজুরি বোর্ড।
এর মধ্যে প্রেক্ষিত বদল হলো। বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যম, রেডিও চালু হলো। কিন্তু এই বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক, শ্রমিক ও কর্মচারীরা পড়লেন সমস্যায়। না তারা পড়লেন শ্রম আইনে, না তাদের জন্য নতুন কোনো আইন হলো। এক অরাজক অবস্থা। না পদ বিন্যাসের ঠিক আছে, না বেতন কাঠামো ঠিক আছে। এ অবস্থায় সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আমরা দাবি জানালাম: ১৯৭৪ সালের আইনটি ফিরিয়ে আনা হোক এবং বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যম, রেডিওর সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনা হলে তিনি এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিলেন। এ প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে আমি সাংবাদিক সমাজের প্রস্তাব তুলে ধরি।
এ সভার আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর আইনের একটি খসড়া প্রকাশ করে অংশীজনের মতামত চাওয়া হয়। সাংবাদিক ও কর্মচারী সংগঠনগুলো লিখিত মতামত দেয়। ২০১৪ সালে আরেকটি খসড়া করে মতামত চাওয়া হয়। আবারও আমরা আমাদের লিখিত মতামত দিই।
সংক্ষিপ্তভাবে আবারও বলি: সাংবাদিক–সংবাদমাধ্যমকর্মীরা এমন একটি আইন চান, যা ১৯৭৪ সালের আইনের মূল চেতনা ধারণ করবে। নতুন আইনে বিশেষ অধিকারগুলো সুনির্দিষ্ট করবে; প্রচলিত শ্রম ও সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে বিশেষায়িত বিষয়গুলো সমন্বয় করবে; যেগুলো বিধিতে আনা সম্ভব, সেগুলো বিধির জন্য পাঠাবে; যেগুলো ওয়েজ বোর্ডে নির্ধারিত হবে, সেগুলো পৃথক করবে, যা বাহুল্য তা–ও বাতিল করবে। এভাবেই নতুন আইনটি সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন, বেসরকারি বেতার মাধ্যমের সাংবাদিক, আলোকচিত্র সাংবাদিকসহ সব কর্মচারীর অধিকার, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, এমনটিই প্রত্যাশা সব অংশীজনের।
২০১৪ সালের খসড়া অনুমোদন করার জন্য বৈঠক হয় সে বছর ১৭ নভেম্বর। সেই সভায় বলা হয়, একটি আন্তমন্ত্রণালয় টেকনিক্যাল কমিটি এ খসড়া প্রস্তুত করেছেন। এ সভার পর ২০১৭ সালে আরেকটি খসড়া প্রকাশ করে মতামত চাওয়া হয়। আবার সাংবাদিক ও কর্মচারী সংগঠনগুলো লিখিত মতামত দেয়। এই ধারাবাহিকতাতেই আইনটি মন্ত্রিসভায় পাস হয় এবং ২০১৮ সালের ১১ মার্চে তথ্যমন্ত্রী ও সচিব এটিতে সই করেন। এটি পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ের কাছে। তারা আরেকটি খসড়া তৈরি করে। সংশোধিত এ খসড়া সম্পর্কে মতামত জানানোর নোটিশ দেওয়া হয় ২ অক্টোবর ২০১৮। সবশেষ এ সংশোধিত আইনের খসড়া ২০২২ সালের ২৮ মার্চে সংসদে উপস্থাপন করা হয়।
কথা হলো, এ আইন কেন জরুরি? ১৯৭৪ সালে আইনটি সাংবাদিকতা পেশাকে কয়েকটি বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। এ আইনে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীদের অধিকার ও বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়গুলো শ্রম আইনের মধ্যে রেখেও কিছু বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করেছিল। এগুলো হচ্ছে সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীদের জন্য পৃথক ওয়েজ বোর্ড গঠন, পেশার সংজ্ঞায়ন, বিশেষায়িত বলে কতিপয় বিশেষ সুবিধা নিশ্চিতকরণ। সে সময় দেশে শ্রম আইন বহাল থাকলেও এ আইন করা হয়েছিল এই বিশেষ লক্ষ্য নিয়েই। তখন এ আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছিল শিল্প সম্পর্ক ১৯৬৯ (XXIII of 1969) এবং এমপ্লয়মেন্ট অব লেবার (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস) অ্যাক্ট ১৯৬৫—এই দুই আইনের সঙ্গে সমন্বয় করে। এ আইন দুটি এখন আর নেই। নতুন আইন করতে হলে এ চেতনা ধরে রাখতে হবে বলেই বিশ্বাস করি।
সংসদে উপস্থাপিত নতুন আইনটির প্রাথমিক পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এতে ব্যত্যয় ঘটেছে অনেক জায়গায়। ১৯৭৪ সালের আইনে ধারা ছিল ২১টি, ২০১৮ সালের খসড়া আইনে ধারা ছিল ২৩টি আর ২০২১ সালের (২০২২ সালে সংসদে উপস্থাপিত) আইনে ধারা ৫৪টি। এ আইনে এমন কিছু সংযুক্ত করা হয়েছে যে বিষয়গুলো বিধি দিয়ে বা ওয়েজ বোর্ডের সুপারিশ দিয়ে কার্যকর করা সম্ভব। অনেকে এ কথা বলতে চান, ২০১৮ সালের খসড়া আইনটি থেকেও আমরা কিছুটা দূরে সরতে চাই কি না। অবশ্যই, ২০১৮ সালে আইনটি পাস হলে এত দিনে তার সংশোধনী নিয়ে আলোচনা হতে পারত। কাজেই আলোচনার সুযোগ যখন এসেছে, গোটা বিষয় নিয়েই আলোচনা করা যাক।
প্রস্তাবিত আইনের যেসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, ধারাক্রম অনুযায়ী তা তুলে ধরছি—
১. সংক্ষিপ্ত শিরোনাম: গণমাধ্যমকর্মী (চাকরি শর্তাবলি) আইন, ২০২১।
পর্যবেক্ষণ: শিরোনামটি হোক: সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম কর্মচারী (চাকরি শর্তাবলি) আইন, ২০২১। এতে যাঁদের জন্য এ আইন, সেই পেশাজীবীদের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
২. আইনের ১.২ ধারা: ইহা বেসরকারি গণমাধ্যম, গণমাধ্যমমালিক ও গণমাধ্যমের কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে।
পর্যবেক্ষণ: যাঁরা ওয়েজ বোর্ডের সুপারিশকৃত আওতায় বেতন–ভাতা পান বা পাবেন, তাঁদের সবার বেলায় এই আইন প্রযোজ্য হবে।
৩. আইনের ২.২ ও ৩ ধারা: গণমাধ্যম আদালত–বিষয়ক উপধারার উল্লেখ আছে
পর্যবেক্ষণ: এই উপধারা বাতিল করা প্রয়োজন। গণমাধ্যম আদালত নিয়ে ভিন্নমত আছে।
৪. ধারা ৩: আইনের প্রাধান্যের জায়গায় বলা হচ্ছে: বলবৎ অন্য আইনে যাহাই থাকুক, এই আইন প্রাধান্য পাইবে।
পর্যবেক্ষণ : সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীদের অধিকার ও বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়গুলো শ্রম আইনের আওতায় রেখে বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করতে এ আইনের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে।
৫. ধারা ৫: গণমাধ্যমকর্মীদের শ্রেণি বিভাগ ও শিক্ষানবিশ। এতে তিন ধরনের কর্মচারীর কথা বলা হয়েছে—অস্থায়ী, শিক্ষানবিশ ও স্থায়ী।
পর্যবেক্ষণ: অস্থায়ী বা সাময়িক কর্মী থাকবে না। ৫.২ বাতিল হবে, সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমের নবীন কর্মচারী শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগ পাবেন। ৬ মাস পর মূল্যায়ন শেষে এ কাল আরও ৬ মাস বাড়ানো যাবে। এরপর মূল্যায়ন শেষে স্থায়ী নিয়োগ করতে হবে।
৬. ধারা ৮: কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা। ১৯৭৪ সালের আইনেও তা–ই ছিল।
পর্যবেক্ষণ: পেশার বিশেষত্ব বিবেচনা করে এ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে একজন রিপোর্টার, ডেস্কে কর্মরত সাংবাদিক বা আলোকচিত্র সাংবাদিককে ঘণ্টা হিসাবের বাইরেও কাজ করতে হয়। তাঁদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি বা অন্য বেসরকারি শিল্পের মতো সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা যেতে পারে।
৭. ধারা ১১: মৃত্যুজনিত সুবিধা, ধারা ১২: ছাঁটাই, ধারা ১৩: অব্যাহতি, ধারা ১৪: দণ্ডপ্রাপ্তি, ধারা ১৫: বরখাস্ত।
পর্যবেক্ষণ: ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে চার মাসের টার্মিনেশন বেনিফিট, কর্মকালীন মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করে বাকি বিষয় প্রচলিত শ্রম আইনের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়।
৮. ধারা ১৬: স্বেচ্ছায় ইস্তফা প্রদান, ১৬:৩: ক/খ: পাওনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষণ: এভাবে স্পষ্ট করতে হবে, শ্রম আইন অনুযায়ী সব প্রাপ্যের অতিরিক্ত হিসাবসহ তাঁরা এসব পাওনা পাবেন।
৯. ধারা ২০: চাকরি হইতে অবসর গ্রহণ।
পর্যবেক্ষণ: পুরোটা বাতিল করে লিখতে হবে: কোনো সাংবাদিক যত দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার মতো শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন, তাঁর বিরুদ্ধে যদি কোনো আর্থিক দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত কোনো প্রমাণিত অভিযোগ না থাকে, তাহলে তাঁকে অবসর দেওয়া যাবে না। কারণ, সাংবাদিকতা বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা। যত বয়স বাড়ে, ততই তাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হন। তাঁদের অকাল অবসর সাংবাদিকতাকেই দুর্বল করবে। তবে সাংবাদিক ছাড়া অন্য কর্মচারীদের বেলায় অবসরের বয়সসীমা হবে ৬৭ বছর।
১১. ধারা ২১: ছুটি, চিকিৎসা, ভবিষ্য তহবিল।
পর্যবেক্ষণ: ক. সরকারি ছুটির অনুসরণে সপ্তাহে দুই দিন ছুটি ঠিক রেখে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা যায়। শ্রান্তি ছুটি হবে সবেতনে ৩০ দিন।
১২. ধারা ২৩: চিকিৎসা ভাতা: বলা হচ্ছে এটি মালিকপক্ষ নির্ধারণ করবে।
পর্যবেক্ষণ: চিকিৎসা ভাতা নির্ধারণ করবে ওয়েজ বোর্ড। এটি মালিকের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।
১৩. ধারা ২৫: ন্যূনতম ওয়েজ বোর্ড। বলা হচ্ছে: একজন চেয়ারম্যান, মালিক প্রতিনিধি একজন, কর্মচারী সংগঠনের তিনজন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় ও যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন।
পর্যবেক্ষণ: সরকার একজন চেয়ারম্যান নিযুক্ত করবেন, যিনি হবেন আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সংবাদমাধ্যমের মালিকের তিনজন প্রতিনিধি (একজন সংবাদপত্রমালিকদের সংগঠন, একজন টেলিভিশনমালিকদের সংগঠন ও একজন অনলাইন মালিকদের সংগঠন থেকে)। বিএফইউজে—বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে তিনজন (সংবাদপত্র , টেলিভিশন, অনলাইনের প্রতিনিধি)। সংবাদপত্র প্রেস শ্রমিকদের একজন প্রতিনিধি। সংবাদপত্র সাধারণ কর্মচারীদের একজন প্রতিনিধি। টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমের সাধারণ কর্মচারীদের একজন প্রতিনিধি। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মর্যাদার একজন প্রতিনিধি। অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব মর্যাদার একজন প্রতিনিধি।
১৪. ধারা ২৬: গণমাধ্যমকর্মী ও গণমাধ্যম সম্পর্ক।
পর্যবেক্ষণ: এ ধারা পুরোটাই নতুন করে লিখতে হবে: সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীরা প্রচলিত আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারী হবেন। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীদের বর্তমান ট্রেড ইউনিয়নগুলো দর–কষাকষির অধিকারী হবেন।
১৫. ধারা ২৭: বিরোধ নিষ্পত্তিকারী প্রতিনিধি।
পর্যবেক্ষণ: এ ধারায় স্পষ্ট করতে হবে, এ ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তির বেলায় নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন (এ ক্ষেত্রে বিএফইউজে—বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন) সাংবাদিকদের এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তাঁদের নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিত্ব করবে।
১৬. ধারা ২৮: বিরোধ নিষ্পত্তি, গণমাধ্যম আদালত, গণমাধ্যম আপিল আদালত।
পর্যবেক্ষণ: ধারা ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭ ও ৩৮ বাতিল করতে হবে। পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের কোনো আদালতের অস্তিত্ব নেই। সব বিষয় শ্রম আদালতে শ্রম আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। বরং সময়ে সময়ে শ্রম আদালত সংবাদমাধ্যম–সংক্রান্ত মামলা শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করতে পারবে। সে রকম বিধান থাকা উচিত।
১৭. ধারা ৪৫: চুক্তির কার্যকারিতা।
পর্যবেক্ষণ: ৪৫: ১: সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন ও মালিকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি পড়তে হবে। গণমাধ্যম কর্মী সমিতি বলে কিছু থাকবে না, থাকবে আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন।
১৮.ধারা ৪৭: গণমাধ্যমকর্মী বা কল্যাণ সমিতির অন্যায় আচরণ।
পর্যবেক্ষণ: ধারাটি বাতিল করতে হবে। প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন সদস্যদের অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষায় কর্মসূচি দিতে পারবে।
১৯. ধারা ৪৮: ধারা ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১ বাতিল হবে।
পর্যবেক্ষণ: যেহেতু এসব বিষয় শ্রম আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, কাজেই এখানে নতুন করে কিছু বলার নেই।
প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ থেকে কিছু পরামর্শ তুলে ধরা হলো। এসব পূর্ণাঙ্গ নয়। নিশ্চয়ই সাংবাদিক, সংবাদমাধ্যমকর্মী ও মালিকদের সংগঠন তাদের প্রস্তাব ও পরামর্শ দেবে। একটি ভালো আইন করতে হলে সবার প্রস্তাব থেকেই উপাদান নিতে হবে। বিষয়টি এখন সংসদীয় কমিটির হাতে। সংসদীয় কমিটিতে আমাদের অভিজ্ঞতা ইতি ও নেতিবাচক দুই রকমেরই আছে। ২০০৯ সালে সংসদীয় কমিটি আমাদের প্রস্তাব সমন্বয় করে তথ্য অধিকার আইন করেছিল বলেই আমরা একটি ভালো আইন পেয়েছিলাম। আবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার সময় সংসদীয় কমিটির প্রতিশ্রুত চূড়ান্ত বৈঠক না করে, সাংবাদিকদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে আইনটি পাস করায় এর সমালোচনা হচ্ছে দেশে ও দেশে বাইরে।
সংক্ষিপ্তভাবে আবারও বলি: সাংবাদিক–সংবাদমাধ্যমকর্মীরা এমন একটি আইন চান, যা ১৯৭৪ সালের আইনের মূল চেতনা ধারণ করবে। নতুন আইনে বিশেষ অধিকারগুলো সুনির্দিষ্ট করবে; প্রচলিত শ্রম ও সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে বিশেষায়িত বিষয়গুলো সমন্বয় করবে; যেগুলো বিধিতে আনা সম্ভব, সেগুলো বিধির জন্য পাঠাবে; যেগুলো ওয়েজ বোর্ডে নির্ধারিত হবে, সেগুলো পৃথক করবে, যা বাহুল্য তা–ও বাতিল করবে। এভাবেই নতুন আইনটি সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন, বেসরকারি বেতার মাধ্যমের সাংবাদিক, আলোকচিত্র সাংবাদিকসহ সব কর্মচারীর অধিকার, নিরাপত্তা, মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, এমনটিই প্রত্যাশা সব অংশীজনের।
আশার কথা, এবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়–বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান সাবেক মন্ত্রী। তিনি এ আইনের আদ্যোপান্ত সব জানেন। বর্তমান মন্ত্রীও সবার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আইনটি করার পক্ষে। সে জন্যই আমরা আশায় বুক বেঁধে রইলাম।
মনজুরুল আহসান বুলবুল সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ই–মেইল: bulbulahsan@gmail.com