মতামত

গণবিচ্ছিন্নতাই কি আধুনিকের নিয়তি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

একটি শিশুকে সুখী রাখতে মা-বাবা-পরিবার ছাড়াও পশুপাখি, ঘাস-মাটি, প্রতিবেশীদের শিশুরাসহ একটা আস্ত জগৎ লাগে। যে কিশোর বা কিশোরী মন খারাপ করে থাকে, সে হয়তো বলতেও পারছে না ভালো থাকতে হলে অনেক বন্ধু-স্বজন, অনেক রোমাঞ্চ আর অনেক ভালোবাসা চাই তার। প্রেমিক মিলছে প্রেমিকার সঙ্গে, তবু ‘শুধু দুজনে’ মার্কা জীবনে সুখ সাময়িক। মানুষের আরও অনেক মানুষ চাই, আর চাই ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা। যে মানুষটি আত্মহত্যা করে বসলেন, তিনি হয়তো বলতে চাইছিলেন মৃত্যুভয়ের চেয়েও বড় ভয় আছে।

ধানমন্ডির এক নিঃসঙ্গ ভদ্রলোক ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করলেন। ভিডিওটি দেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারিনি। সময়টা ভালো না। কত রকম মন খারাপ করানো ঘটনা। সব নেওয়া যায় না। দুঃখ বা দুঃসংবাদের ব্যবস্থাপনাও যেন জরুরি হয়ে পড়েছে। সবার সব কষ্টধ্বনি মনে ঢুকে পড়লে তো মন চুপ করে থাকে না! মন প্রতিধ্বনি করে। লম্বা সময় ধরে সেই কষ্টের এসওএস বার্তা প্রতিধ্বনি তুলতে থাকে মনের ভেতর।

তবু পারা গেল না। ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেওয়া সেই লাইভ আত্মহত্যার দৃশ্য অন্য উপায়ে দেখা হয়ে গেল। মনের ভেতর এখনো প্রতিধ্বনি তুলছে চলে যাওয়া মানুষটির অন্তিম সংলাপ:

‘প্রত্যেকটা লোকের কাছে আমি প্রতারিত হয়েছি…পৃথিবীতে কেউই আপনার না…ফ্যামিলির লোকজন কেন বুঝতে চায় না…অনেক দিন ধরে আমি মেন্টালি আপসেট…নিজের ওপর নিজের এতটাই বিতৃষ্ণা এসে গেছে…ফেসবুক যদি লাইভ না করি, যদি ঘরে মরে পড়ে থাকি, কেউই জানবে না।’

কথাগুলো খুবই দুঃখের। তবে দুঃখের দরিয়ার মধ্যে অভিযোগের তিরগুলোও খেয়াল করা যায়। তিনি একভাবে সমাজটাকে, পারিবারিক বন্ধনকে, ব্যবসার হালচালকে এবং প্রবীণদের প্রতি অবহেলাকে অভিযোগ করে গেছেন। একজন আত্মহত্যাকারীর অন্তিম এজাহার আমলে নিতে হবে। নিঃসঙ্গ মৃত্যু অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু ফেসবুকে লাইভ-সঙ্গ রেখে আত্মহত্যায় কি সেই জ্বালা জুড়ায়?

অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা, অজানা বিপদ বা ব্যর্থতার ভয় আধুনিক জীবনের ছায়াসঙ্গী। এটা একজনের বা অল্প কয়েকজনের ওপর ছায়া ফেলে না, এর শিকার গোটা সমাজ। অথচ বিজ্ঞাপিত জীবন শেখায় ভোগই সুখ। এই পণ্যময় জীবন খালি পেতে শেখায়। হারানো মানেই সর্বনাশ। হারিয়ে ফেলার শোক সামলানোর ক্ষমতা কমে যাচ্ছে আমাদের। অথচ কিছু না হারিয়ে কে কবে কিছু পেয়েছে?

বারুদ আর দুঃখ, দুটোই বিস্ফোরিত হয়। বারুদ থাকে বোমায়। দুঃখ জমে মানুষের মনে। না, মনের নাম মহাশয় নয়। মন অনেক কিছু নিতে পারে না। বোমা ফাটে কিন্তু মানুষ সব সময় দুঃখে ফেটে পড়ে না। কখনো চুপসে যায় মন, নীরব হয়ে যায়। কখনো–বা ফেটে পড়ে। ফেটে পড়ে দুঃখের কারণের বিরুদ্ধে, ফেটে পড়ে দুঃখকে ঠেকাতে। এই পথেই মানুষ বাঁচে, সমাজ বদলায়। নক্ষত্র মরে গেলে কৃষ্ণগহ্বর হয়। সেখানে আলো প্রবেশ করতে পারলেও বেরোতে পারে না। মানুষের মনও দুঃখে দুঃখে কৃষ্ণগহ্বর হয়ে যায়; সেখান থেকে কোনো কথা বের হয়ে আসে না। এর নাম ডিপ্রেশন বা অবসাদ।

কয়েক প্রজন্ম আগের মানুষ জানত না কাকে বলে ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন আধুনিকতার মানসিক গন্দম ফল। বাংলা ভাষায় ডিপ্রেশন বোঝানোর কোনো শব্দ নেই। কত বড় ঘুণপোকা জীবনের ভিত খেয়ে ফেলছে, তা অনেক সময় বুঝতেও পারি না। ধরতে পারি না যে অবসাদের মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে। করোনা মহামারির প্রথম বছরে কোভিড-১৯–এ মৃত্যুর চেয়ে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা ছিল বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, ২০২০–এর কোভিডকালীন ১০ মাসে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার মৃত্যুর বিপরীতে আত্মহত্যায় মৃতের সংখ্যা ছিল দ্বিগুণের বেশি—প্রায় ১১ হাজার। এঁদের মধ্যে নারী বেশি। শিক্ষিত তরুণদের আত্মহত্যাও ঘন ঘন ঝাঁকুনি দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডিপ্রেশনই ১৫-২৯ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার জন্য দায়ী।

অসন্তোষ, অনিশ্চয়তা, অজানা বিপদ বা ব্যর্থতার ভয় আধুনিক জীবনের ছায়াসঙ্গী। এটা একজনের বা অল্প কয়েকজনের ওপর ছায়া ফেলে না, এর শিকার গোটা সমাজ। অথচ বিজ্ঞাপিত জীবন শেখায় ভোগই সুখ। এই পণ্যময় জীবন খালি পেতে শেখায়। হারানো মানেই সর্বনাশ। হারিয়ে ফেলার শোক সামলানোর ক্ষমতা কমে যাচ্ছে আমাদের। অথচ কিছু না হারিয়ে কে কবে কিছু পেয়েছে? সাবেক কালের রুহানি মানুষেরা, সাধু মানুষেরা তো হারানোর মাধ্যমেই আরও প্রশান্তির জীবনের আদর্শ তুলে ধরতেন। তখন তো এত আত্মহত্যা ছিল না। জীবনে সুখই কাম্য, দুঃখ মানেই খারাপ, এটা ভুল বার্তা। দুঃখের ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক সময়ে কেবল মনোরোগ চিকিৎসক আছে। অথচ পুরোনো সময়ে আশ্রয় ছিল সমাজে; কারণ সমাজ নামক জিনিসটা জীবন্ত ছিল। আশ্রয় ছিল প্রকৃতিতে, যেহেতু তার ভেতরই মানুষ বাস করত। মাজারে ও তীর্থ ছিল। ছিল পরিজন আর ছিল দুঃখকে স্বাভাবিক ভাবার সংস্কৃতি।

সফল আমাদের হতেই হবে? চালাতে হবে অমানবিক প্রতিযোগিতা? ছুটতে ছুটতে পা হয়ে যাবে সিস্টেমের চাকা? পরিহাস, ভোগের বীরদেরও ক্লান্তি আসে। ভোগের দৌড়ে সফল ও ব্যর্থ, দুজনে একই সমস্যার দুই রকম শিকার। সেই সমস্যার নাম বিচ্ছিন্নতা, অবসাদ, জীবনের অর্থ হারিয়ে ফেলা। এসব আত্মাকে শুকিয়ে ফেলে, খেয়ে ফেলে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার ইচ্ছাশক্তি। আত্মহত্যা নামের ভালুকের থাবার তলে চলে যায় তখন অনেকেই। পুঁজিবাদ থাকবে কিন্তু অবসাদ থাকবে না, তা হয় না। ইউক্যালিপটাসগাছের মতো দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকার নাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য হতে পারে না। বিচ্ছিন্ন জীবনের নাম আধুনিকতা হতে পারে না। প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাচ-কংক্রিট-প্লাস্টিক আর স্ক্রিনের দম্ভকে সভ্যতা বলা যায় না। বণিক সভ্যতার এই শূন্য মরুভূমিতে কীভাবে মানুষ বেঁচে থাকার প্রেরণা পাবে?

এই পরিবেশে কখন কার মন বিস্ফোরিত হবে, ঘটাবে কোনো মর্মান্তিক ঘটনা, তা জানার বিদ্যা এখনো মানুষের মগজে সঞ্চিত হয়নি। আত্মহত্যা নিয়ে দিশারি গবেষণা করেন জার্মান সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম। সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, সামাজিক জলবায়ু বিষাক্ত হয়ে গেলে, সম্পর্ক ভেঙে পড়লে সমাজের কোনো কোনো অংশে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে পারে। এসবের কারণও আছে, প্রতিকারও অসম্ভব নয়। সমাজবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দীন প্রথম আলোর কলামেই দেখিয়েছেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বজনীন মঙ্গলের পরিবেশ থাকলে, আত্মহত্যা ঘটার হার কমে যায়।

অপরকে খুন করলে বিচার হলেও হতে পারে। যে পরিস্থিতি মানুষকে আত্মহত্যা করিয়ে নেয়, সেই পরিস্থিতির এজাহার তো দিয়ে গেলেন ধানমন্ডির মহসিন সাহেব। এখন বিচার চলুক বর্তমান সমাজব্যবস্থার। আত্মহত্যাকে ব্যক্তিগত ভেবে সবাই মিলে দায়মুক্তি নিয়ে নিলে সামনে আরও বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

  • ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও নির্বাহী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা

    faruk.wasif@prothomalo.com