গণতন্ত্র, সুশাসন, সুবিচার এখনো অধরা

জাতি এ বছর জাতীয় ইতিহাসের তিনটি বিশেষ উপলক্ষ উদ্‌যাপন করছে—বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ গত বছর শুরু হলেও করোনার কারণে সেটির উদ্‌যাপন এখনো চলছে, এ বছর মার্চে শুরু হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর ১৬ ডিসেম্বর উদ্‌যাপিত হলো দেশকে শত্রুর দখলমুক্ত করে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। এ যেন ইতিহাসের ত্রিবেণি সংগম। তবে এগুলো স্বতন্ত্র ধারা নয়, একই প্রবাহের উত্তরণের বিভিন্ন মাইলফলক। বলা যায়, এই ঐতিহাসিক স্রোতোধারার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে এ ত্রিবেণি সংগম—তিনিই মুখ্য প্রবাহ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কালের প্রবাহে বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটে, সম্ভবত তার তাৎপর্য ও ব্যাখ্যারও রূপান্তর প্রয়োজন হয়।

বঙ্গবন্ধু যখন তাঁর অভিযাত্রা শুরু করেন, তখন রাজনীতি ছিল গণশিক্ষার এক কার্যকর মাধ্যম। সেকালে রাজনৈতিক ক্লাসও হতো, তাঁর নিজের রাজনৈতিক শিক্ষার গুরু ছিলেন আবুল হাশিম—মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা। তাঁর পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই। অনেক কাল রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ভাষণ ছিল জনগণের জন্য ইতিহাস ও সমকাল সম্পর্কে জানার মুক্তমঞ্চ। ছাত্র-তরুণ থেকে সাধারণ কৃষক-শ্রমিক এমন আয়োজন থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা জানতে পারতেন এবং নিজেদের চলার পথের দিশাও পেতেন। জনগণের জন্য আরেকটি বড় সুযোগ ছিল অভিজ্ঞ নেতাদের সংস্পর্শ, তাঁদের ঘরোয়া বৈঠকের আলাপচারিতা। বঙ্গবন্ধুর জীবনেও এমন অভিজ্ঞতার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এমন ধারা বাংলাদেশ আমলেও চালু ছিল। বঙ্গবন্ধুর কথা আজও সাধারণ কর্মী ও সমর্থকও স্মরণ করেন নিজেদের ব্যক্তিগত প্রাপ্তির বিবেচনা থেকে। সেটা অবশ্যই কোনো বৈষয়িক বিষয় নয়, ব্যক্তিগত স্নেহ–মমতা এবং সমকালীন ইতিহাসের এক নায়কের কাছ থেকে জীবনের বৃহত্তর যাত্রাপথের দিশাপ্রাপ্তির জন্য। তাই সেকালে অনেক নিরক্ষর মানুষের মধ্যেও রাজনীতির গভীর জ্ঞান দেখা যেত।

ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে ব্যাপক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বা মাথাপিছু গড় আয়ের বিপুল বৃদ্ধি সত্ত্বেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কেবলই বাড়ছে। ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন বা সব ক্ষেত্রে সুবিচারপ্রাপ্তি দূরকল্পনা হয়ে রয়েছে।

গত কয়েক দশকে রাজনীতিতে গুণগত বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন একজন রাজনীতিক গণবিচ্ছিন্ন দূরের মানুষ, রাজনীতির মঞ্চ বা ময়দানে সাধারণের স্থান সংকুচিত এবং তাদের জন্য জানার তেমন কিছু থাকে না। রাজনীতি এখন সম্পন্ন মানুষের ক্ষমতাচর্চার এবং উচ্চাভিলাষীর সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের অবলম্বন মাত্র। তাদের প্রয়োজন টাকা—সাদা বা কালো যা–ই হোক, প্রয়োজন বিত্ত, বৈধ বা অবৈধ যা–ই হোক, আর চাই ক্ষমতা—আদর্শ বা আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে হলেও তা চাই। সফল রাজনীতিকের লক্ষণ হলো তাঁকে ঘিরে থাকবে অসংখ্য উমেদার-চাটুকার ও কৃপাপ্রার্থী—তিনি যেন মৌচাক, ক্ষমতা ও বিত্তের ভান্ডার। এর বাইরে ক্ষমতাচর্চার জন্য তাঁর একটি অন্তরঙ্গ চক্র থাকে, যারা কর্মী হিসেবে পরিচিত হলেও প্রায়ই ক্ষমতার দাপুটে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

জনসভায় শোনা যায় নেতাদের প্রশংসা, গুণগান এবং ভিন্ন দল ও নেতার প্রতি বিষোদ্‌গার। রাজনীতির অঙ্গন সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে, প্রেক্ষাপট গেছে হারিয়ে। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রাজনীতির বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে না রেখে ও না দেখে শতবর্ষে সঠিক মূল্যায়ন করা যাবে না। হয়তো কিছু প্রবন্ধে তা থাকছে, কিন্তু জনসাধারণের নাগালে যেসব কথাবার্তা পৌঁছাচ্ছে, তাতে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আসল বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের জন্মের পরে বিশ্বরাজনীতি ও মানুষের জীবনযাপনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব বিষয়ের তাৎপর্যও কিছু পরিবর্তিত হয়, কোনো কোনো প্রপঞ্চের পুনঃসংজ্ঞায়ন প্রয়োজন হয়, বহু ক্ষেত্রে রদবদল, সংযোজন-বিয়োজন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধরা যাক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অহরহ শোনা যায়, এ সময় বেশিই শোনা গেছে। কিন্তু চেতনাটা কী, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এর ভাবার্থে কী প্রভাব পড়েছে, তা স্পষ্ট নয়। অস্পষ্টতা শিল্পে চলে, রাজনীতিতে নয়। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে জাতি যে চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাকে বলা যাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। সেটির ভিত্তি ছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধনির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা। ফলে এর মধ্যে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত সমতাভিত্তিক উদার মানবিক চেতনাও আধারিত ছিল। গত তিন দশকে সমাজে ধর্মচর্চার ঝোঁক এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার যে ধারায় বেড়েছে, তাতে সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন, ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্বেষ বেশ স্পষ্ট। ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণের যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে ব্যাপক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার বা মাথাপিছু গড় আয়ের বিপুল বৃদ্ধি সত্ত্বেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কেবলই বাড়ছে। ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন বা সব ক্ষেত্রে সুবিচারপ্রাপ্তি দূরকল্পনা হয়ে রয়েছে। যে লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র ছিল রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ, তার মূল ভিত ছিল সবার জন্য বিকাশের সুযোগের নিশ্চয়তা এবং যত দূর সম্ভব সম্পদের সমবণ্টন। তা-ও আপাতত অধরাই থাকল।

আর ১৯৭৩ সালে সংসদে নবরচিত সংবিধান উপস্থাপনের পরই স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, এই সংবিধান বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য জাতির অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয় না। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের মূল উদ্বেগ হলো আমাদের সংস্কৃতি বিলীন হওয়ার হুমকিতে পড়েছে...আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়েই বাঁচতে চাই।’ সংবিধানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দেশকে একক সংস্কৃতি ও এক ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ নিয়ে রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করার উপায় নেই, কারণ তখন আদতে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুদ্ধিজীবী মহলেও আদিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কোনো আলোচনা শুরু হয়নি, এ বিষয়ে সচেতনতাও তেমন ছিল না। কিন্তু যখন ইস্যুটা উত্থাপিত হলো, তখন অন্তত বাঙালি নেতৃত্বের তো বোঝার কথা ভাষা-সংস্কৃতির অস্তিত্ব যদি সংকটের মধ্যে পড়ে, তবে সেই জাতির কেমন অনুভূতি হয়। কিন্তু লারমার উচ্চারণের প্রতি তখনো মূলধারার বাঙালি উপযুক্ত সংবেদনশীলতা প্রদর্শন করতে পারেনি, এমনকি এত বছর পরে আজ পর্যন্ত নয়। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা উপলব্ধি ও সমঝোতার পথের সূচনা করলেও তেমন কার্যকর অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি—তাঁর দলসহ সমাজ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের প্রভাবে অর্থনীতিতে সংরক্ষণবাদী অবস্থান ধরে রাখা কঠিন ছিল। কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের খয়রাতি সহায়তার চেয়েও প্রয়োজন ছিল কৃষিভিত্তিকসহ ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে তাদের জন্য উপার্জনের বহুতর পথ খোলা এবং মানসম্পন্ন শিক্ষা-স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা।

যে রাজনীতি গণতন্ত্রকে লালন করে, তার অবসান ঘটানো হয়েছে, এর ফলে সহজেই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার গঠিত হলেও—সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধও বটে—নির্বাচিত ব্যক্তিদের থাকতে হয় আমলাদের অধীন হয়ে।

সমাজতন্ত্র না হলেও কল্যাণকামী সমাজব্যবস্থার দিকেই অগ্রসর হওয়া দরকার ছিল। চরম অবিচার হচ্ছে জাতির সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত যে শাসনব্যবস্থা, সেই গণতন্ত্রের প্রতি। যে রাজনীতি গণতন্ত্রকে লালন করে, তার অবসান ঘটানো হয়েছে, এর ফলে সহজেই নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা সম্ভব হচ্ছে। নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার গঠিত হলেও—সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধও বটে—নির্বাচিত ব্যক্তিদের থাকতে হয় আমলাদের অধীন হয়ে। গণতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের এমন ক্ষমতাপূর্ণ শক্তিমত্ত বিকাশ সহজে দেখা যায় না। এ ধরনের বাস্তবতায় সমাজ-জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ নষ্ট হয়, তার স্বাভাবিক অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে যায়। ফলে শিক্ষাঙ্গন, সাংস্কৃতিক জগৎ, নাগরিকের স্বাভাবিক বিনোদন সবই ক্ষীয়মাণ। সরকারসহ নানামুখী ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে থেকে কোনো সমাজের পক্ষেই তার সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব হয় না।

প্রযুক্তির কল্যাণে বিচ্ছিন্ন কিছু স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আমাদের চমকিত করলেও তা সর্বসাধারণের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত জীবনবিকাশের কোনো প্রমাণ দেয় না। এটা খুবই বেমানান যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল এবং আরও বিশেষভাবে, শেখ হাসিনার মতো একজন প্রাণবন্ত বলিষ্ঠ ব্যক্তির নেতৃত্বকালেও পরিবর্তিত বাস্তবতা অনুযায়ী জাতির সাংবিধানিক অভিপ্রায়কে সমকালীনতা দান এবং জাতীয় বিকাশের যাত্রাপথ নিয়ে অন্তত মুক্ত আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ তেমন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।

মনে হয় ইতিহাসের এই মহৎ সন্ধিক্ষণে একবার থেমে পেছনে ফিরে রাজনীতিকসহ চিন্তাশীল মানুষের ভাবা দরকার যে দেশ ও বিশ্বের পরিবর্তিত বাস্তবতায় আমাদের ঘোষিত নীতির কী ব্যাখ্যা হবে, কোথায় পরিমার্জন প্রয়োজন, কোথায়–বা নতুন সংযোজন জরুরি। এসব বিষয়ে সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্য তৈরির তাগিদ বুঝে এ কাজ করা দরকার। নয়তো আমাদের উন্নতি, অগ্রগতি যা হচ্ছে, তা হবে বহিরঙ্গে, অন্তরে ব্যক্তি ও জাতি তামাদি হয়ে পড়বে অথবা নানা বিষয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগবে। তাতে ব্যক্তি ও জাতির ব্যবহারিক জীবনে যেমন তেমনি নীতি-মূল্যবোধেও অসামঞ্জস্য থেকে যাবে, যা পদে পদেই আমরা দেখতে পাচ্ছি। দেশের নানা ক্ষেত্রে চমকপ্রদ উন্নতি দেখে সুখী হওয়া যায়, কিন্তু তাতে বিভোর হওয়ার উপায় নেই। কেননা, তাহলে বকেয়া কাজের স্তূপ জমবে, সংকট বাড়বে, উন্নত হয়েও সুশাসন অধরা থেকে যাবে।


আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক