মতামত

গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি

গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছে মিয়ানমারের জনগণ
ছবি: এএফপি

গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি? আমাদের নিজেদের কথা থাক, অন্য দেশের কথাই না হয় বলি। ভারতে নির্বাচনে যে গেরুয়াধারী রামভক্তরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের ভাবসাব কিন্তু মোটেই গণতন্ত্রীদের মতো নয়। সেখানে আবারও নির্বাচন হবে, তাতে বুর্জোয়া দলগুলো যে রামভক্তদের হটিয়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারবে, এমন ভরসা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশাতে রয়েছেন। বড় রকমের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।

নির্বাচন হয়েছে বেলারুশেও। ২৬ বছর ধরে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন, আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো, এবারও তিনি জিতেছেন বলে দাবি করছেন। বিরোধীদের দাবি, নির্বাচন হয়নি, একটা প্রহসন হয়েছে মাত্র। মুখের কথা নয় শুধু, প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। আন্দোলন ছয় মাস পার করেছে, কিন্তু লুকাশেঙ্কো অনড়। বোঝাই যাচ্ছে, সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে আছে।

থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন হয় না, তা নয়, কিন্তু দেখা যায় যারাই জিতুক, ঘুরেফিরে সেনাবাহিনীর কর্তারাই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করে। কিন্তু এবার ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। ছাত্ররা নেমে পড়েছেন রাস্তায়। ছাত্ররা আগেও একবার প্রবলভাবে নেমেছিলেন। সেই বিক্ষোভ দমন করেই ক্ষমতায় আসে সেনাবাহিনী।

থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ কার্যকর হচ্ছে না, সেটা অন্যত্রও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে, সেটা আর বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য, তারই আভাস ফুটে উঠছে সর্বত্র। সেটা গৃহযুদ্ধ।

মিয়ানমারও গৃহযুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে। সেখানেও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আগের চেয়েও ভালো ফল করেছে। তাতেই ঘটেছে তাদের এবং ভোটদাতা জনগণের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসব তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি—সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও শান্ত থাকেনি, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে। দুর্ভাগা মানুষদের জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল, সব দখল করে নিয়েছে।

একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি, তিনি প্রতিবাদ করবেন কী, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন, এই ছিল তাঁর আশা। সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে পুনরায় তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারও আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারা না পারুক, সাধারণ মানুষ ঠিকই পেরেছেন।

বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ-মীমাংসার কাল শেষ হয়ে এসেছে। সামরিক দুঃশাসনের নিদারুণ শিকার যে সাধারণ মানুষ, লড়াইটা তাঁদেরই করতে হবে। তাঁরা ভোট দিয়েছেন সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে; দেখেছেন তাতে কাজ হলো না, এবার তাই নেমে এসেছেন রাজপথে। এসেছেন ছাত্ররা। ছাত্র বিদ্রোহ আগেও একবার হয়েছিল; সেবার ভয়াবহ রক্তপাত ঘটিয়ে তাঁদের দমন করেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারছে না। কারণ, ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন পেশাজীবীরাও।

এমনটা যে ঘটতে পারে, তা ছিল জেনারেলদের একেবারেই ধারণার বাইরে। কিন্তু অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে তাঁদের পক্ষে কোনো উপায়ও ছিল না; নির্বাচনে বিজয়ী বুর্জোয়ারা তাঁদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করছিল। জেনারেলরা তাই একেবারে মরণকামড়ই বসিয়েছেন। কিন্তু এটা তাঁরা টের পাচ্ছেন যে তাঁদের প্রতিপক্ষ এখন আর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল নয়, প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপদ আছে। কে জানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো হুকুম শুনবে না, সেনাসদস্যরাও হয়তো আপনজনদের ওপর ট্যাংক-কামান-বন্দুক প্রভৃতি নিয়ে হামলা চালিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে রাজি হবেন না। রোহিঙ্গা দমনের সময় যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সেনাবাহিনী ঠিক কাজ করছে বলে রাস্তায় বের হয়ে সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন, তাঁরাও দেখা গেল এবার জেনারেলদের প্রতি সমর্থন জানাতে নারাজ।

রাজপথে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ হয়তো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বেদনাটাও এখন অনুমান করতে পারছেন। ছবিতে তো দেখাও গেল, হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত।’ উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মৌতাত ভেঙে মানবিকতার এই নাড়াচাড়া দেওয়াটা দৃশ্য হিসেবে সুখকর, ঘটনা হিসেবে আশাপ্রদ।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেজিবির সাবেক কর্মচারী ভ্লাদিমির পুতিনও বেশ ‘গণতন্ত্রমনা’। তিনি নির্বাচন দিয়ে থাকেন; তবে নির্বাচনব্যবস্থাটাকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলেছেন যে তাঁর আমৃত্যু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কমিউনিস্টদের উপস্থিতি যাতে শক্তিশালী না হয়, তার ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়ারা যে দল গঠন করবে, এমন সম্ভাবনাও তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে। তবু প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। এক ব্যক্তি, তাঁর কোনো গোছানো দল নেই, সাহস করে তিনি যে–ই বলেছেন, আগামী নির্বাচনে তিনি পুতিন সাহেবের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, অমনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছেন; বলা তো যায় না, লোকেরা আবার ওই প্রায় অচেনা ব্যক্তিটির পেছনেই দাঁড়িয়ে যান কি না।

গোয়েন্দারা কোনো ঝুঁকি নেননি, লোকটিকে তাঁরা ইহজগৎ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। খাবারে নয়, তাঁর অন্তর্বাসের ভেতরে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। লোকটির টেকার কথা ছিল না। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিলেন। জার্মান দূতাবাসের লোকেরা বললেন, চিকিৎসার জন্য ওঁকে আমরা আমাদের দেশে নিয়ে যেতে চাই। লোকটি জার্মানির হাসপাতালে গেলেন। কী কঠিন তাঁর প্রাণশক্তি, জার্মান চিকিৎসকদের চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠলেন।

তবে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হলো। যথারীতি মামলা দেওয়া হলো এবং যথাপ্রত্যাশিত স্বাধীন আদালতের সুবিবেচিত রায়ে তিনি দণ্ডপ্রাপ্তও হয়ে গেলেন। অনেক লোক প্রতিবাদ করল, অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাতে কী হবে? অদম্য ব্যক্তিটি জেলেই আছেন; কারণ, তিনি তাঁর এই ঘোষণায় অনড় রয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বেনই। কাজেই তাঁর জন্য আরও অনেক দুর্ভোগ যে অপেক্ষা করছে, এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটাই দাঁড়াবে যে পুতিনই জিতবেন।

তবে এটা লোকে বুঝবে, যেমনটা অন্য দেশের মানুষেরাও বুঝতে পারছে যে স্বৈরশাসকদের হটাতে গেলে নির্বাচনে আর কুলাবে না, অনিবার্য হচ্ছে অভ্যুত্থান, যার অপর নাম গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও কিন্তু কাজ হবে না, যুদ্ধটা যদি কেবল ব্যক্তিকে সরানোর জন্যই হয়। প্রয়োজন সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লব লেনিন ঘটিয়েছিলেন রাশিয়াতে, মাও সে-তুং চীনে। কিন্তু সে বিপ্লবের অর্জনও স্থায়ী হবে না, যদি না বিপ্লব বিশ্বময় ঘটে। এর বাইরে যা, সেসব কেবলই সংঘর্ষ, অরাজকতা ও মেরুকরণ বৃদ্ধি।


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়