সুশাসন ও নির্বাচনে সৎ, যোগ্য প্রার্থীর জন্য হাহাকার করছি আমরা দেড় যুগ ধরে। সে জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি নিয়ে আর্তনাদেরও শেষ নেই। কিন্তু কারচুপির নির্বাচন তো নির্বাচনই নয়, ত্রুটিমুক্ত বা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারও যে সুশাসন দিতে পারবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? তার অর্থ এই নয় যে অলৌকিক উপায়ে একটি আদর্শ সরকার গঠিত হবে, যা জাতিকে উপহার দেবে সুশাসন।
ত্রুটিমুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত সরকারই সুশাসনের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা, যাঁরা নির্বাচিত নন, নিযুক্ত; তাঁদের ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যত ভালো নির্বাচনই হোক, অযোগ্য, অদক্ষ ও অসৎ আমলাদের দিয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। সেই রাষ্ট্র থেকে জনগণ সুশাসন পেতে পারে না। যে দেশে নির্বাচনে কারচুপি এবং কর্মকর্তা নিয়োগে অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়, সে রাষ্ট্রের বিপর্যয় অনিবার্য।
আজকাল প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়, ‘প্রশাসনে পদোন্নতিবঞ্চিতদের ক্ষোভ’। বিষয়টি অতি গুরুতর। নিয়োগের সময় চেষ্টা-তদবির খাটালেও পদোন্নতি কারও মৌলিক অধিকার নয়। ওপরের পদ খালি আছে কি না এবং সেই পদে যাওয়ার যোগ্যতা আছে কি না, সে বিবেচনায়ই প্রশাসনে পদোন্নতি হয়ে থাকে। আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন হলো পিরামিডের মতো। যতই ওপরে যাবে, ততই পদের সংখ্যা কমতে থাকবে। সহকারী সচিবের চেয়ে উপসচিব কম, উপসচিবের চেয়ে যুগ্ম সচিব আরও কম, যুগ্ম সচিবের চেয়ে অতিরিক্ত সচিব অল্প এবং সচিবের সংখ্যা সবচেয়ে কম।
আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ব্রিটিশ ব্যুরোক্রেসি ছিল খুবই দাপুটে, তবে দক্ষতার পরাকাষ্ঠা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সেই ধারাবাহিকতা অনুসৃত হয়, কিন্তু মান অনেকটা কমে আসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পদ্ধতিটা একই রকম থাকে বটে, কিন্তু মানের অবনতি ঘটে। তা সত্ত্বেও যত দিন পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসের কর্মকর্তারা ছিলেন, তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষা ও দক্ষতা ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিসিএস দিয়ে যাঁরা বিভিন্ন ক্যাডারে নিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে যোগ্য, দক্ষ ও উজ্জ্বল যাঁরা ছিলেন, হয় তাঁরা রাজনৈতিক চাপে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেননি অথবা তাঁদের যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়নি। যোগ্যতার স্বীকৃতি না থাকলে মানুষের মধ্যে হতাশা দেখা দেয় এবং হতাশা থেকে আসে অবসাদ।
একটি সময় ছিল যখন ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে কেউ যদি কোনো রকমে যুগ্ম সচিব হতে পারতেন, তিনি মোগল সাম্রাজ্য হাতে পাওয়ার আনন্দ ও গৌরব ভোগ করতেন। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে আমলাতন্ত্রের আকার ছিল ছোট, কিন্তু দক্ষতায় ছিল সেরা। প্রশাসনিক ক্যাডারে ব্রিটিশ আমলে ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) এবং ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিস (আইপিএস)। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে আফগান সীমান্ত থেকে মিয়ানমার (বার্মা) পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যে ১৯৪৭ সালে আইসিএস-আইপিএস কর্মকর্তা ছিলেন ১ হাজার ১৫৭ জন। তার মধ্যে ব্রিটিশ ৬০৮ জন, হিন্দু-শিখ-পার্শি ৪৪৮ জন এবং মুসলমান ১০১ জন। তঁাদের মধ্যে বাঙালি মুসলমান অতি অল্প।
ব্রিটিশ যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করে, পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তখন আইসিএস-আইপিএস কর্মকর্তারাও ভাগাভাগি হয়ে যান। তাঁদের কে কোন দেশে থাকতে চান তার অপশন বা পছন্দ জানতে চাওয়া হয়। ১ হাজার ১৫৭ জনের মধ্যে ৯৫ জন পাকিস্তানে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই ৯৫ জনের মধ্যে ৬ জন সঙ্গে সঙ্গে অবসরেও চলে যান। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান সাংঘাতিক কর্মকর্তা-সংকটে পড়ে। রাত–দিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করে কর্মকর্তারা কোনো রকমে পরিস্থিতি সামাল দেন।
১৯৪৭-এ পাকিস্তান যাত্রা শুরু করে যে আইসিএস-আইপিএস আমলা বাহিনী দিয়ে, তার সংখ্যা ছিল সাকল্যে ১৫৭ জন। তাঁদের মধ্যে মুসলমান আইসিএস ছিলেন ৮৩ জন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত খ্রিষ্টান ছিলেন ১ জন, ব্রিটিশ আইসিএস ছিলেন ৩৬ জন, মুসলমান আইপিএস ছিলেন ১২ জন এবং ব্রিটিশ আইপিএস ছিলেন ১৪ জন। তাঁদের বাইরে ১১ জন ছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বিশেষভাবে নিযুক্ত কর্মকর্তা। বাঙালি আইপিএস অফিসারদের মধ্যে কাজী আনওয়ার-উল হক, এ কে এম হাফিজউদ্দিন, মহিউদ্দিন আইজি হয়েছিলেন। [বিস্তারিত দেখুন: কম্বাইন্ড সিভিল লিস্ট ফর ইন্ডিয়া, পাকিস্তান অ্যান্ড বার্মা, নাম্বার ১৬১, জানুয়ারি-মার্চ, ১৯৪৮, লাহোর, ১৯৪৮]
উচ্চপদস্থ আমলার চাকরি এক স্বপ্ন। সেখানে আছে অর্থ ও ক্ষমতা। সরকারের পরিবর্তন ঘটে, তাঁরা থাকেন যথাস্থানে। এখন যাঁরা বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁদের কাছে বিস্ময়কর মনে হবে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে সমগ্র ভারতবর্ষে মাত্র তিনজন মুসলমান ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিব। সেই তিনজনের একজন পাকিস্তানের কুখ্যাত বাঙালিবিদ্বেষী গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গঠন করেন পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (পিএএস)। কর্মকর্তার স্বল্পতা
দূর করার লক্ষ্যে বিশেষ নিয়োগের ব্যবস্থা হয় প্রশাসন, পুলিশ ও ফরেন সার্ভিসে। বাঙালিদের জীবনের দরজা খুলে যায়। ১৯৫০ সালে গভর্নর জেনারেল স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সময় পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (পিএএস) নাম পরিবর্তন করে করা হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি), পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস (পিএফএস), পাকিস্তান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস (পিএঅ্যান্ডএএস), পুলিশ সার্ভিস অব পাকিস্তান (পিএসপি) প্রভৃতি। জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ চট্টগ্রামের বাঙালি হিন্দু প্রভাত মুকুল চৌধুরী ওরফে পিএম চৌধুরীকে বিশেষ বিবেচনায় ফরেন সার্ভিসে নেওয়া হয়। ষাটের দশকে তিনি বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
১৯৫১ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসএস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাঁরা প্রশাসন, ফরেন সার্ভিস, পুলিশ,
অডিট অ্যাকাউন্টস প্রভৃতি ক্যাডারে নিযুক্ত হন, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা যথেষ্ট ছিল। পাবলিক সার্ভিস কমিশন কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের নিয়োগ দিয়েছে। তাঁদের প্রশিক্ষণও ছিল কঠোর। তাঁদের নিয়োগে যেমন তদবির ছিল না, পদোন্নতিতেও নয়। কঠোর নিয়ম মেনেই হতো। দেশে কার্যকর গণতন্ত্র ছিল না, কিন্তু দক্ষ প্রশাসন ছিল।
দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার বৈষম্য করত। গুরুত্বপূর্ণ শীর্ষ পদে বাঙালিদের নিয়োগেও বৈষম্য হতো বলে আমাদের ক্ষোভ ছিল। রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চালাতে গেলে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তার বিকল্প নেই। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন একজন সুযোগ্য আইসিএস অফিসার। তিনি আশির দশকে এবং তারপরেও আমার সঙ্গে একাধিকবার আলাপকালে বলেন, ১৯৫৭–তে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কাগমারী সম্মেলন থেকে গিয়ে তাঁকে এবং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে বলেন, মওলানা ভাসানী তাঁকে বলেছেন পূর্ব বাংলা বেশি দিন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকবে না, স্বাধীন হবেই। অন্নদাশঙ্কর বলেন, আমি তারাশঙ্করকে বলেছিলাম, খুব তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে আসা ঠিক হবে না, কিছুকাল অপেক্ষা করা প্রয়োজন, যত দিন পর্যন্ত বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার কেন্দ্রে যুগ্ম সচিব না হন। পূর্ব বাংলা স্বাধীন হলে রাষ্ট্র চালানোর জন্য যোগ্য কর্মকর্তার প্রয়োজন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও আমি বলেছিলাম, গণতন্ত্র সংহত করতে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা তৈরি করুন।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনে সিনিয়র কর্মকর্তা কমই ছিলেন। কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বয়সে তরুণ, কিন্তু তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দক্ষতা যথেষ্ট ছিল। তা না হলে সেই সংকটময় সময়ে দেশ চালাতে পারতেন না। যেসব কর্মকর্তার মধ্যে গণমুখী চেতনা লক্ষ করেছেন, তিনি তাঁদের বিশেষ স্নেহ করতেন। যেমন সাবেক সিএসপি অফিসার ড. এম এ সাত্তার। নতুন স্বাধীন দেশের আর্থসামজিক পুনর্গঠনে ড. সাত্তারের আগ্রহ দেখে তাঁকে প্রথমে পরিকল্পনা কমিশনের সচিব ও পরে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব করেন। পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সবাই ছিলেন তাঁর চেয়ে সিনিয়র। তিনি তাঁদের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ না করলেও তাঁরা অস্বস্তি বোধ করেন। এ রকম আভাস পেতেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে এনে তাঁরই দপ্তরে ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য প্রাইম মিনিস্টার করেন। সেখানে তাঁর কাজ বিশেষ ছিল না। বাংলাদেশের মতো দেশে সরকার সব কাজ করতে পারে না। বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। ড. সাত্তার গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি এডুকেশন (বিএসিই)। তিনি এবং তাঁর ব্রিটিশ স্ত্রী এলেন সাত্তার শিক্ষা, নারী ও গ্রাম উন্নয়নে বহু কাজ করেছেন। সেসব কাজের সঙ্গে নারী নেত্রীদের মধ্যে যুক্ত ছিলেন সালমা সোবহান, হামিদা হোসেন, সালমা খান প্রমুখ। ড. সাত্তারের দুজন স্কুলজীবনের বন্ধু ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ। তাঁদের একজন সৈয়দ কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। ড. সাত্তার পাওলো ফ্রেয়ারের পেডাগজি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন।
কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জনসেবা করে স্মরণীয় হয়ে আছেন। আখতার হামিদ খান, নিয়াজ মোহাম্মদ খান, ডিআইটির চেয়ারম্যান মাদানী প্রমুখ তাঁদের দায়িত্বের বাইরেও কাজ করে মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। নিয়াজ মোহাম্মদ খানের নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্কুল, মাদানীর নামে বারিধারায় রাস্তা তাঁদের প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
অগণতান্ত্রিক সরকার আমলানির্ভর। সামরিক বা আধাসামরিক সরকার যারা বাহুবলে বলীয়ান কিন্তু জনসমর্থনের দিক থেকে দুর্বল, তেমন সরকার চায় নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কর্মকর্তাদের নিজেদের পক্ষে রাখতে। কর্মকর্তাদের বশে রাখার অন্যতম উপায় ঘন ঘন পদোন্নতি দেওয়া। আজ বাংলাদেশে উঁচু পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা বিপুল। পদ নেই, তবু প্রমোশন। গণতন্ত্রের জন্যও জিনিসটি ক্ষতিকর। নিরপেক্ষ আমলাতন্ত্র ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ছাড়া আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যত অর্থনৈতিক উন্নয়নই করুক, জনগণের কল্যাণ করতে পারবে না। বাংলাদেশে যে হারে কর্মকর্তাদের দলীয়করণ হচ্ছে এবং অপ্রয়োজনে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে তাতে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য যা অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।