রাজনীতি

গণতন্ত্রের তুষারযুগ - আমলাতন্ত্রের স্বর্ণযুগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ এবং যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্কের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের ‘এক জরিপে ৯৫ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বলেছেন, তাঁরা জনসেবা করতে চান। কিন্তু জরিপ পরিচালনাকারী গবেষকেরা দেখেছেন, বাস্তবে কাজ করার উদ্যম আছে মাত্র ৫৭ শতাংশের। নৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রেও হারটা এক।’ [প্রথম আলো, ২৮ মার্চ ২০১৯ ]

কোনো জরিপ ও সমীক্ষাই প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্ট নয় যে তা শতভাগ নির্ভুল হবে। তবে মোটের ওপর নিরপেক্ষ জরিপে বাস্তব অবস্থাটা পাওয়া যায়। যেমন ৫৭ শতাংশের জায়গায় ৫২ শতাংশ বা ৬২ শতাংশ হতে পারে। দেশ-বিদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের সমীক্ষা থেকে যা জানা গেল তা হলো, অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সততার সঙ্গে জনসেবার আগ্রহের অভাব। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য এই সমীক্ষার ফলাফল উদ্বেগের। যে প্রশাসনের অর্ধেকের বেশি কর্মকর্তার আন্তরিকতা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও নৈতিকতার মান সন্তোষজনক নয়, সেখানে নাগরিকেরা যেমন প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনি তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও টেকসই হবে না।

গড়পড়তা বাঙালি ও বাংলাদেশের অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুর মেধার ঘাটতি নেই। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে যাঁরা বিভিন্ন ক্যাডারে নিযুক্ত হন, তাঁরা গড়পড়তার চেয়ে বেশি মেধাবী। তা সত্ত্বেও আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা ও দুর্বলতা কেন? স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি কার্যকর থাকলে ব্যুরোক্রেসির অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। নষ্ট রাজনীতির ফলে স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ প্রাধান্য পায়, যোগ্যতা-দক্ষতা-সততা গৌণ হয়ে পড়ে। প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘একাধিক সাবেক সচিব ও গবেষক বলেছেন, সার্বিকভাবে জনপ্রশাসনের গুণগত মান আর পেশাদারত্ব এখনো সন্তোষজনক নয়। কাজের স্পৃহা ও পেশাদারত্ব বাড়ানো ও দুর্নীতি দূর করার পথে দলীয়করণ একটা বড় বাধা।’

বঙ্গীয় সমাজে স্বজনপ্রীতি কিছু পরিমাণে ইংরেজ আমলেও ছিল, পাকিস্তান আমলে তার মাত্রা বাড়ে। স্বাধীনতার পর থেকে তার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েছে। বাঙালি নেতারা আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ, আত্মসমালোচনা অত্যন্ত অপছন্দ করেন। কেউ ভুল ধরিয়ে দিলেও তা স্বীকার করতে তাঁরা বাধ্য নন। যেমন সমীক্ষার স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণ সম্পর্কে নবনিযুক্ত জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, ‘এ অভিযোগ ভিত্তিহীন’। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরা সঠিক কর্মকর্তাকে সঠিক কর্মস্থলে পদায়নের নীতি গ্রহণ করেছি।’ সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোর পরে দেখা যাচ্ছে, তিনি সত্যি কথাটিই বলেছেন।

ব্রিটিশ আমলের আইসিএস এবং রাজস্ব ক্যাডারের কর্মকর্তাদের যোগ্যতা-দক্ষতা নিয়ে কারও প্রশ্ন তোলা সম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও দেখা গেছে, শেষের দিকে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর আসন্ন, তখন বহু কর্মকর্তা গোপনে মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তান, ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পর তাঁরা দুই দেশেই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত হন। ছয় দফা জনপ্রিয় হওয়ার পর—তার আগে নয়—অনেক সিভিল সার্ভেন্ট আওয়ামী লীগের সমর্থকে পরিণত হন। তাঁরা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে থাকেন, তাকে দলীয়করণ বলা যাবে না। দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি কী এবং কত প্রকার তা নব্বইয়ের দশক থেকে দেখতে দেখতে বাংলার মানুষ ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছে। এখন তারা ধরে নিয়েছে এ রোগ থেকে জাতির মুক্তি নেই।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের একটা মুদ্রাদোষ, কথায় কথায় আমলাদের একহাত নেওয়া। জনগণের বাহবা পেতে তাঁরা তা করেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের চেহারাটা দেখেন না। সময়ের প্রয়োজনে প্রশাসনের সংস্কার প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও সে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই ইংরেজ বা পাকিস্তানি আমলের চেয়ে উন্নত, তা প্রমাণিত হয়নি। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সময় ‘জেলা গভর্নর’ প্রথা প্রবর্তন করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, জেলা প্রশাসকের ওপরে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি থাকলে সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে। ওই ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগে অঙ্কুরেই তা বাতিল হয়ে যায়। কর্মকর্তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

প্রশাসনের সংস্কার চেয়েছেন সব সরকারের নেতারাই। জাতির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিবেচনা না করে ব্যক্তিগত চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্ত থেকে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা কোনো সরকারই কার্যকর করে যেতে পারেনি। বাকশালের জেলা গভর্নরদের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন, প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা ছিলেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিও ছিলেন।

‘ঔপনিবেশিক আমল’কে কষে গাল না দিলে বাংলাদেশে জননেতা হওয়া যায় না। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এক দলীয় সভায় বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে ঔপনিবেশিক আমলের সমাজ, প্রশাসনিক কাঠামো ও পুরোনো আইন চলতে পারে না।’ কথাটা শুনতে যতটা শ্রুতিমধুর অথবা বৈপ্লবিক মনে হোক, বিষয়বস্তু ততটাই অর্থহীন। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বা চীনের কমিউনিটি বিপ্লবের পরে কোনো নেতা এমন বক্তব্য দিলে মানানসই হতো।

জিয়াউর রহমানও প্রশাসনকে ঔপনিবেশিক আমল থেকে স্বাধীন দেশের উপযোগী করতে চাইলেন। তিনি প্রতিটি জেলায় ‘জেলা সমন্বয়কারীর’ পদ সৃষ্টি করলেন, যা ছিল জেলা গভর্নরের মতোই, শুধু শব্দের হেরফের। তাঁদের পদমর্যাদা, কার্যালয়, দায়িত্ব ইত্যাদির ব্যবস্থা না করেই পদ সৃষ্টি করা হয়। তাতে একশ্রেণির জনপ্রতিনিধি বেজায় খুশি হন, আমলারা হন শঙ্কিত—তাঁদের মাথার ওপর এ আবার কোন দেবতা!

রাজনৈতিক নেতারা আমলাদের ওপর অপ্রসন্ন। ১৯৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা এখনো ব্রিটিশ আমলের পুরোনো ঔপনিবেশিক আইন দিয়েই শাসিত হচ্ছি। একটা স্বাধীন দেশ ও জাতি এভাবে চলতে পারে না।...বর্তমানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোনো ক্ষমতা নেই, সমস্ত ক্ষমতা আমলাদের হাতে।’

এর বছর দুয়েকের মধ্যেই জাতির ভাগ্যাকাশে এরশাদ যুগের সূচনা। জনগণকে ক্ষমতায়ন করতে তিনি বসে থাকতে পারেন না। উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। শাসক হিসেবে তাঁর উত্তরাধিকারী খালেদা জিয়া দেখলেন, যে জিনিস জেনারেল এরশাদ করতে পারেন তা ভালো হতেই পারে না। সুতরাং দিলেন তিনি সেটাকে নাকচ করে। তবে বর্তমান যে উপজেলা ব্যবস্থা তাতে উপজেলার ভোটাররা নন, সমস্ত উপজেলায় মাত্র একজন মানুষই উপকৃত হন, তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান। এখন থেকে যদি কোনো চেয়ারম্যান তাঁর উপজেলার মানুষকে বলেন, ‘তোমাদের প্রতি আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই, তোমাদের ভোটে আমি নির্বাচিত নই, ’ তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না।

রাজনীতিতে যখন নামে তুষারযুগ, গণতন্ত্রের সব স্তরে যখন জগাখিচুড়ি, তখন আমলাতন্ত্রের স্বর্ণযুগ হওয়াই স্বাভাবিক। সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও পেশাদারত্বের যে ঘাটতি, তার জন্য তাঁরা ততটা দায়ী নন, দায়ী বর্তমান ব্যবস্থা। নিম্নমানের শিক্ষা, কোটাপদ্ধতি, নির্বাচনী পরীক্ষায় দুর্বলতা প্রভৃতি কারণে ক্যাডার সার্ভিসে যোগ্য লোকের অভাব। তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে দেখতে পেয়েছি, এখনো জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সৎ ও কর্মঠ কর্মকর্তা যথেষ্ট রয়েছেন। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন তাঁদের জন্য কঠিন। মাথার ওপরে যদি ওএসডি হওয়ার খড়্গ ঝুলতে থাকে, কারও পক্ষেই রাতে শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব নয়। অফিসাররাও মানুষ। তাঁদের ঘরসংসার, সন্তানসন্ততি নিয়ে বাস করতে হয়।

জনসেবা করতে অবশ্যই অধিকাংশ কর্মকর্তা অনিচ্ছুক নন, কিন্তু যদি তাঁদের ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থিসেবায় বাধ্য করা হয়, তাহলে জনসেবার অবকাশ পাবেন কখন? যে তথাকথিত জনপ্রতিনিধি জানেন তাঁর ‘নির্বাচনে’র সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তাঁর নিজের বা দলীয় কর্মীদের নয়—সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার, তিনি তাঁদের থেকে নৈতিকতা ও সততা আশা করবেন কোন মুখে। গণতন্ত্রসম্মত সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই প্রশাসন তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক