মতামত

গণতন্ত্রের গুরুতর অবক্ষয়ের কাল

বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অব্যাহত অবক্ষয়ের মধ্যে অনেক দেশেই গণতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপন পরিহাস বৈ কিছু নয়। অন্তত যেসব দেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় হয়েছে এবং রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকারের দিক থেকে নাগরিকেরা মুক্ত নন অথবা আংশিক মুক্ত, সেই সব দেশের নাগরিকদের কাছে সে রকমই মনে হওয়ার কথা। গণতন্ত্র বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের ২০২০ সালে প্রকাশিত হিসাবে, গত বছরে গণতন্ত্রের ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটা দেশের সংখ্যা ৬৪। কিন্তু প্রতিবছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। জাতিসংঘ এ দিবস পালন করে আসছে ১৩ বছর ধরে। এ বছর এ উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের ওপর আরও বেশি আঘাত এসেছে, সরকারগুলো অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে।

গণতন্ত্রে ভিন্নমত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সংকটের সময়ে, বিশেষত মহামারির মতো সর্বগ্রাসী সংকটে অসহিষ্ণু শাসকদের কাছে ভিন্নমত সহনীয় না হওয়ারই কথা। সমস্যা হচ্ছে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন অকার্যকর ও দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। আবার রাজনৈতিক বিকল্প হয় অনুপস্থিত, নয়তো নেতৃত্বহীন। ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০’–এর প্রতিবেদনের শিরোনামে যেন এর একটা যথার্থ প্রতিফলন মেলে—এ লিডারলেস স্ট্রাগল ফর ডেমোক্রেসি। অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে স্মরণ করিয়ে দিই যে বিশ্বের ২১০টি দেশের ওপর পরিচালিত জরিপে রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার ভোগ করে, এমন মুক্ত অবস্থানে আছে ৮৩টি দেশ। মুক্ত নয়, এমন দেশের সংখ্যা ৪৯টি আর আংশিক মুক্ত দেশ ৬৩টি। বাংলাদেশ আংশিক মুক্ত দেশগুলোর অন্যতম।

গণতন্ত্রের এই সাম্প্রতিক বিপরীত যাত্রার ওপরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হয়েছে। শিকাগো ইউনিভার্সিটির ল স্কুলের আজিজ হক ও টম গিন্সবার্গ এ প্রক্রিয়াকে সাংবিধানিক পশ্চাদ্‌গমন বলে অভিহিত করছেন। তাঁদের সাম্প্রতিক প্রকাশনা হাউ টু লুজ এ কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেসিতে বলা হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী অধঃপতন হলো কর্তৃত্ববাদে সর্বাত্মক এবং দ্রুত পতন। যেমনটি ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান বা জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে। কিন্তু পশ্চাদ্‌গমন রাতারাতি ঘটে না, ধীরে ধীরে এবং সূক্ষ্মভাবে গণতন্ত্রের উপাদানগুলোতে পরিবর্তন ঘটে। গণতন্ত্রের তিনটি মৌলিক উপাদান প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন, মতপ্রকাশ ও সংগঠন করার উদারনৈতিক অধিকার এবং বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আইনের শাসন—এ তিন ক্ষেত্রেই ক্ষয়সাধন ঘটে। এগুলো ঘটে প্রায় একযোগে। তবে লেখকদ্বয়ের মতে, এগুলো এতটাই সন্তর্পণে এবং ধীরগতিতে হয় যে হয়তো কখনো কখনো মনে হতে পারে একেবারে আলাদা আলাদা সংস্কার এবং বিচ্ছিন্নভাবে অনেকটির ক্ষেত্রে তা যৌক্তিকও মনে হতে পারে।

আজিজ হক ও টম গিন্সবার্গ লাতিন আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজনীতি এবং আইনগত পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, পাঁচটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সাংবিধানিক পশ্চাদ্‌গামিতা ধীরে ধীরে পূর্ণতা পায়। এগুলো হচ্ছে ১. সাংবিধানিক সংশোধনী; ২. প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্যমূলক বাধা অপসারণ; ৩. নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং রাজনীতিকরণ; ৪. জনপরিসর বা সভা-সমাবেশ ও মতপ্রকাশের সুযোগগুলো সংকোচন অথবা বিকৃতিসাধন এবং ৫. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্মূল করা। সাংবিধানিক সংশোধনীর লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতার স্থায়িত্ব বাড়াতে নির্বাচনে বারবার প্রার্থী হওয়ার বাধা অপসারণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষমতা বিভিন্ন কমিশনের হাত থেকে একক কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করা, বিচারপতিদের নিয়োগ-অপসারণের ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া, অনুগত লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পদায়ন, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা সংকোচন ইত্যাদি।

জনপরিসরকে সংকোচনের লক্ষ্যে নাগরিক অধিকার হরণের যেসব পদক্ষেপ দেখা যায়, সেগুলোর মধ্যে আছে গণমাধ্যমের লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণ, সংবাদমাধ্যমে সেন্সরশিপ, সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতি, গ্রেপ্তার, অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, অপরাধ আইনের অপব্যবহার, রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার, দমন, ধর্মঘট নিষিদ্ধকরণ, বেসরকারি সংগঠন বা এনজিওগুলোর ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ ইত্যাদি। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার, ভোট কেনা, নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করা ইত্যাদি।

ফ্রিডম হাউস অবশ্য তার সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশনায় মধ্য ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার ২৯টি দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের ওপর আলাদা একটি গবেষণায় দেখিয়েছে, ওই সব দেশে গণতন্ত্রের খোলসটাও খসে পড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক সেলিকে সাকি ‘ড্রপিং দ্য ডেমোক্রেটিক ফ্যাসাড’ নিবন্ধে বলছেন, এসব রূপান্তরকালীন দেশে ক্ষমতাসীন নেতারা খোলাখুলিভাবেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত হানছেন এবং ক্ষমতার ওপর যতটুকু নিয়ন্ত্রণ বা বাধা আছে, তা অপসারণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখন যা দেখা যাচ্ছে তা হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ জোরদার হয়েছে, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের ওপর হুমকি বেড়েছে, নির্বাচনী আইনের ফোকর গলিয়ে কারসাজি এবং রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্র হিসেবে এবং নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহিতে পার্লামেন্টকে অকার্যকর করা। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন এসব নেতা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করার দাবি জানালেও তাঁরা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার হরণ চালিয়ে যাচ্ছেন।

সেলিকে সাকির ভাষায়, এসব ঘটনার কারণে রূপান্তরকালীন ২৯টি দেশে গণতন্ত্রে বিস্ময়কর ধস নেমেছে। ১৯৯৫ সালের পর অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় ওই অঞ্চলে গণতন্ত্রের সংখ্যা এখন কম। ওই অঞ্চলে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের অর্ধেক সংখ্যকই নিজেদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন। গবেষক মাইক স্মেলৎজার লিখেছেন, এখনকার ইউরেশিয়ার নেতারা বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের পথে অগ্রসর হচ্ছেন। তাঁরা পরিবারের সদস্যদের এমন সব ক্ষমতাসম্পন্ন পদে বসাচ্ছেন, যেখানে প্রয়োজনে সংবিধানসম্মত উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর সহজ হবে।

এসব বিশ্লেষণেই বিচার বিভাগের অবস্থান বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধন ঠেকানো এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর সুরক্ষায় বিচার বিভাগের কাছে সম্ভবত প্রত্যাশা অনেক। ৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস-এর আন্তর্জাতিক সংস্করণের প্রথম পাতায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের সোনিপাট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন এবং রাজনীতির অধ্যাপক মাধব খোসলা লিখেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের অত্যাচার এবং রাষ্ট্রের ভেতরে স্বৈরতান্ত্রিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে আদালতকে স্বাধীনতার রক্ষক এবং জবাবদিহি নিশ্চিতকারী হিসেবে দেখা হতো (উইথ ফ্রিডম অ্যাট স্টেক, কোর্টস আর কলাপসিং)। কিন্তু তিনি রীতিমতো অভিযোগ তুলেছেন যে আদালতগুলো এখন নীরব দর্শক এবং অন্যায়ের সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছেন। হাঙ্গেরি, তুরস্ক ও ভারতের জনতুষ্টিবাদী নেতাদের উত্থান এবং আদালতের দুর্বল ভূমিকার চিত্র বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন রাষ্ট্রপতিশাসিত এবং সংসদীয় উভয় ধরনের গণতন্ত্রের এ ক্ষয়সাধন ঘটছে। তাঁর পর্যবেক্ষণের যে অংশটুকু আরও গুরুতর, তা হচ্ছে সমাজে এখনো আদালতের একটি অবস্থান আছে। তবে বিচারিক নিয়োগে কারসাজির কারণে ফলাফল যা পাওয়া যায়, তা পূর্বনির্ধারিত।

বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এ সংগ্রামের ইতিহাস স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখনো অব্যাহত আছে। তবে ওপরে গণতন্ত্রের যেসব ক্ষয়সাধনের নজির ও বিশ্লেষণ আলোচিত হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো তুলনা হয় কি না, হলে তা কতটুকু, সেই বিচার পাঠক নিজ দায়িত্বেই করতে পারেন বিধায় আমি আর কথা বাড়াই না।


কামাল আহমেদ সাংবাদিক