খোকাবাবু ফিরেছেন, সঙ্গে লজ্জাও কি ফিরল?

দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন মুরাদ হাসান।
ছবি: সংগৃহীত

খোকাবাবু ফিরে এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন একরাশ ‘লজ্জা’। লজ্জা চিরকাল দুর্বলের ভূষণ। মুরাদ হাসান ততক্ষণ পর্যন্ত লজ্জা পাননি, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। অর্থাৎ ক্ষমতা যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের লাগামছাড়া কথাবার্তা নিয়ে তাঁকে লজ্জিত হতে হয়নি। তিনি বারবার বলছিলেন, ভুলটা তিনি কোথায় করেছেন, লজ্জাটা কেন পাবেন তা তিনি বুঝতে পারছেন না। যে যা-ই বলেছে সব তিনি বাউন্স করে দিয়েছেন, তাঁর পিচ্ছিল মনে সেসব লেগে পিছলে বেরিয়ে গেছে। যে-ই ক্ষমতা চলে গেল, অমনি লজ্জা যেন ফিরে এল। খোলা মুখে যা আসে তা-ই বলতেও লজ্জা পাননি, কিন্তু মন্ত্রিত্ব হারানোর পর তিনি মাথা-মুখ ঢেকে বিদেশে পলায়ন করলেন। তাঁর দল ও বন্ধুমহলের জন্য লজ্জার বোঁচকা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কেউ আর সেই বোঁচকা মাথায় নিতে রাজি ছিল না। কানাডার উদ্দেশে দেশ ছাড়ার পর অনেকেই ভেবেছে, যাক লজ্জার বিদায় হলো। কিন্তু এখন আবার তিনি বিভিন্ন দেশের সীমান্তে ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এসেছেন দেশে। এই যাওয়া-আসার সময় প্রকাশ্যে যেখানেই তাঁকে দেখা গেছে, সেখানেই লজ্জায় মুখ ঢেকে থেকেছেন। গতকালও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এসে লুকিয়ে অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল দিয়ে বেরিয়েছেন।

কিন্তু মুরাদ হাসান তো ফিরলেন, দেশ থেকে লজ্জা যে বিদায় হচ্ছে সেটা কি আর ফিরবে? লজ্জা আসলে কী? নিজের ভেতরে বসে থাকা এক বিচারকের সামনে দাঁড়াতে না পারাই লজ্জা। লজ্জা পাওয়ার ব্যাপার ঘটলে তা বাইরে পাওয়ার আগে নিজের ভেতরে পেতে হয়। নিজের ভেতরের সেই বিচারক, সেই ন্যায়-অন্যায় নিরূপণকারী, যাকে আমরা বিবেকও বলি, সেটা যখন মরে যায়, তখন ভেতরে-বাইরে কোথাও আর লজ্জা থাকে না।

রাজনীতিতে লজ্জা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অপরাধ করলে, দুর্নীতি করলে, মিথ্যা বলে ধরা পড়লে, নারী নির্যাতন করলে, অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করাকে লজ্জার বিষয় মনে করা হতো। রাজনীতির লোক, রাষ্ট্রের হর্তাকর্তাদের কাছ থেকে লজ্জার শোভনতা দাবি করা হতো। এমনকি মৃত্যুর সামনে ভীরুর মতো পলায়ন করাকেও লজ্জার ব্যাপার মনে করতেন বিপ্লবী যুগের নেতারা। আমাদের নেতারা লজ্জা পান না। মুরাদ হাসানের পর বিএনপির নেতা আলালের নির্লজ্জ বাক্যবাজিও আমরা দেখেছি। অপকর্ম করলে মানুষ বাইরের লোকের কাছে লজ্জা না পেলেও নিজের সন্তানের কাছে লজ্জিত হয়। আমাদের মহাত্মনদের লজ্জা সব ইউরোপ-আমেরিকা-কানাডায়। সন্তানেরা যে সেখানেই থাকেন! তাই দেশে তাঁদের লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

যখন ক্ষমতাবানদের মনের ভেতরের বিবেকটা মরে যায় আর নাগরিকেরা যখন চূড়ান্তভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন ক্ষমতাবানের লজ্জা পাওয়ার কিছুই থাকে না। মানুষকে যদি মানুষই মনে করা না হয়, তখন সেসব মানুষ কিংবা নাগরিক নামধারীদের কাছে লজ্জার কী থাকতে পারে? আমরা কি গরু-ছাগল-কুকুর-বিড়ালের সামনে কিছু করতে বা বলতে লজ্জা পাই? মানুষকে যদি ভেড়ার পাল মনে করা হয় তখন আর কোনো কিছুর জন্য তাদের সামনে লজ্জা পেতে হয় না।

এখন যতক্ষণ কেউ কোনো না কোনো ক্ষমতার খুঁটি ধরে বসে আছেন, তাঁকে কোনোভাবেই আর লজ্জা দেওয়া যায় না। লজ্জা দেওয়ার কাজ করলে জনসভায় দাঁড়িয়ে লজ্জা দেওয়া হতো। গম চুরি করে ধরা পড়লে গমের বস্তার সঙ্গে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান-মেম্বারের ছবি পত্রিকায় ছাপা হতো। এখন সব মানুষের অধিকার চুরি করে নিলেও লজ্জা দেওয়ারও কেউ নেই, দিলেও কেউ গায়ে মাখেন না। বিদেশিরা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিনা বিচারে হত্যা নিয়ে যত লজ্জা দেওয়ারই চেষ্টা করুক না কেন , আমাদের কিছু মন্ত্রী, ডজন ডজন অধ্যাপক আছেন এটা বলতে যে ব্যাপারটা আসলেই গর্বের। যে আমেরিকার স্বীকৃতির জন্য ওয়াশিংটনে কোটি ডলারের লবিইস্ট নিয়োগ করা হতো, এখন সেই রাষ্ট্রের নিন্দায় নাকি গর্ব হয়। কারণ, রাষ্ট্রটা নিজেই নাকি সাম্রাজ্যবাদী ও অগণতান্ত্রিক!

যখন ক্ষমতাবানদের মনের ভেতরের বিবেকটা মরে যায় আর নাগরিকেরা যখন চূড়ান্তভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন তখন ক্ষমতাবানের লজ্জা পাওয়ার কিছুই থাকে না। মানুষকে যদি মানুষই মনে করা না হয়, তখন সেসব মানুষ কিংবা নাগরিক নামধারীদের কাছে লজ্জার কী থাকতে পারে? আমরা কি গরু-ছাগল-কুকুর-বিড়ালের সামনে কিছু করতে বা বলতে লজ্জা পাই? মানুষকে যদি ভেড়ার পাল মনে করা হয় তখন আর কোনো কিছুর জন্য তাদের সামনে লজ্জা পেতে হয় না।

আগেই বলেছি লজ্জা দুর্বলের ভূষণ। একই সঙ্গে লজ্জা দুর্বলের একমাত্র অস্ত্র। যখন ক্ষমতার লজ্জাহীনতাকে কিছুই করা যায় না, তখন মানুষ তাকে লজ্জা দিতে চায়। তার কুশপুত্তলিকা বানায়, বানায় কার্টুন। কিংবা ফেসবুকে দেখা যায় নানা রকম আভাস-ইঙ্গিতের লজ্জাদানের কার্যক্রম। লজ্জা পাওয়াকে এখনো সভ্যতা ধরা হয়, লজ্জা গণতন্ত্রেরও শর্ত। যদি লজ্জাই না থাকে, তাহলে জনমতের দাম কী থাকল আসলে?
লজ্জা না পেলেও অপমানবোধ সবারই থাকে। মুরাদ হাসান যে ফিরে আসার সময় মুখ লুকালেন সেটা কি লজ্জায় না অপমানের ভয়ে? রাস্তাঘাটে, বিমানবন্দরে কেউ যদি তাঁকে অপমান করে বসে! কিন্তু কেউ যদি কোনটি লজ্জার কাজ আর কোনটি নয়, তা বুঝতে না পারেন তা হলে তাকে অপমান করা বড়ই শক্ত।

এ বিষয়ে জমিদারি আমলের এক গল্প বলা যাক। জমিদার নায়েবকে গ্রামে পাঠিয়েছেন খাজনা আদায় করতে। গ্রামদেশে ভীষণ অভাব, খরায় ফসল মার গেছে। নায়েবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রজারা খেপেখুপে তার ওপর চড়াও হলো। নায়েব সেই অবস্থার বিবরণ দিয়ে জমিদারকে চিঠি লিখলেন: ‘উহারা আমার মাথা ন্যাড়া করিয়া ঘোল ঢালিয়া গ্রামময় ঘুরাইল, ইহার পরে গলায় জুতার মালায়ও ঝুলাইল। এসবও সহ্য হয় হুজুর, কিন্তু এখন বলিতেছে নাকি অপমানও করিবে! হুজুর, আমি আর যাহা পারি অপমান লইতে পারি না!’

মুরাদ হাসানের কীসে কী হবে হবে তা জানি না। তবে নারীবিদ্বেষী আচরণ ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সমাজের মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে। তো, মহাশয়ের তাহাতেও অপমান হইবে কিনা বলতে পারি না।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk.wasif@prothomalo.com