ভোলার লালমোহনে ঘুমন্ত অবস্থায় আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছে নারী, শিশুসহ তিনজনকে। ঘাতকেরা সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকেছিল। নোয়াখালীর কবিরহাটে তিন সন্তানের জননীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এখানেও দুর্বৃত্তরা সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকেছিল। এ ছাড়া দিনাজপুরে তরুণী, ফরিদপুরে কিশোরী, বরিশাল ও শরীয়তপুরে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। (প্রথম আলো, ২০ জানুয়ারি)। উল্লিখিত ঘটনাগুলো শুধু ১৮ জানুয়ারি রাতের।
শিশু ধর্ষণের পর হত্যার খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকায় দেখি। আরও আছে নির্মম ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের নিত্য খবর। স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যা, স্বামী পলাতক অথবা স্ত্রীকে জবাই করেছে স্বামী—এরূপ খবর পত্রিকার পাতায় আজকাল হরহামেশা পাওয়া যায়। বিচিত্র উপায়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। শ্বাসরোধে হত্যা, ঘুমন্ত অবস্থায় বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা, টেঁটাবিদ্ধ করে হত্যা, জবাই করে হত্যা, এমনকি পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়েও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। হত্যা করে ঘরের বিছানার নিচে মাটিতে মৃতদেহ লুকানোর চেষ্টাও হয়েছে।
একজন মানুষকে কীভাবে এবং কতটা নির্মমভাবে পেটানো হলে তার মৃত্যু ঘটে, তা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। ভাবতে অবাক লাগে, যাঁর সঙ্গে ঘরসংসার করার কথা, সেই স্ত্রীকে কীভাবে জবাই করে হত্যা করেন তাঁরই স্বামী। জবাই শব্দটা গরু–ছাগল, হাঁস–মুরগির বেলায়ই জুতসই মনে হয়। ১৯ জানুয়ারি একটি পত্রিকা অপরাধের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেই চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। পত্রিকাটি বলছে, গত পাঁচ বছর সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজারটি। গড়ে প্রতিদিন ১১টি। এ ক্ষেত্রে শিশুরাই ধর্ষণ ও হত্যার শিকার বেশি।
ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে দুটি চ্যানেল সে দেশে সংঘটিত গুরুতর অপরাধ–সংক্রান্ত ঘটনা অভিনয় করে প্রদর্শন করে। একটি হলো ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ ও অপরটি ‘সাবধান ইন্ডিয়া—নয়া অধ্যায়’। আমি অনুষ্ঠান দুটো প্রায়ই দেখি। একটি বিষয় লক্ষণীয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধের ধরন বড় নির্মম। ব্যক্তিস্বার্থ, প্রেম, পরকীয়া, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ধর্ষণ ইত্যাদি কারণে মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তুলনামূলক বিচারে ভারত-বাংলাদেশের এসব অপরাধের ধরন প্রায় একই রকম।
কয়েক বছর আগে হাইকোর্ট কয়েকজন আসামির জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন। জানা যায়, আসামিরা সাত–আট বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করে একটি বাঁশঝাড়ের আড়ালে ফেলে রাখেন। যখন ওই মৃতদেহটি উদ্ধার হয় তখন দেখা যায়, শিয়াল মৃতদেহের অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছে। এই বীভৎস কাহিনি শুনে আমার মানসিক অবস্থা ঠিক হতে বেশ কয়েক দিন লেগেছিল। এ ধরনের গুরুতর অপরাধ সংঘটনের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশ আছে। পৃথিবীর সব দেশে এত পরিকল্পিত খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত হয় না। বিশেষ করে হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে আরব সাগরবেষ্টিত এই বিশাল জনভূমিতে এ ধরনের অপরাধের মাত্রা বেশি। আফ্রিকায় গোষ্ঠীগত হানাহানি ঘটে, মাঝেমধ্যে গণহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। সেখানে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব না, গোত্র দ্বন্দ্বই প্রকট। লাতিন আমেরিকায় দু-একটি দেশে মাদক–সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটে।
এসব অপরাধ নিয়ে যতই চিন্তাভাবনা করা হোক না কেন, একটি প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে। মানুষ কী কারণে অমানুষ হয়ে ওঠে। কী কারণে, কী স্বার্থে সে অন্য মানুষের প্রতি এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করে। সে কি এর ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে ভাবে না? আইন, পুলিশ ও বিচার—এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে কেন এত হিংস্র আচরণ করে। একটি খুন বা ধর্ষণ মামলার আসামি হলে আর্থিক দিক থেকে ওই ব্যক্তির
পরিবার নিঃস্ব হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এসবও তোয়াক্কা করে না।
যাঁরা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন, অপরাধতত্ত্ব নামে একটি বিষয় তাঁদের পড়তে হয়। অপরাধ ও অপরাধীর বিভিন্ন রকম বিচার–বিশ্লেষণ থাকে এ বিষয়ে। অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের অপরাধপ্রবণতার কারণ প্রধানত জিনগত ও পরিবেশগত। সমাজবিজ্ঞানীরা দায়ী করেন পারিপার্শ্বিক অবস্থাসহ কোনো সমাজের সার্বিক পরিবেশ, যথা দারিদ্র্য, অশিক্ষা, শোষণ, নির্যাতন ইত্যাদি। বাম রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত ব্যক্তিদের মতে, অপরাধপ্রবণতা পুঁজিবাদের বিষবৃক্ষ। অর্থনীতিবিদদের ভাষায় অপরাধপ্রবণতা অনেকটা আর্থিক বৈষ্যম্যের ফল। অর্থই সব অনর্থের মূল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আর্থিক অনটন বা আর্থিক কারণেই পারিবারিক বা ব্যক্তি সংঘাতের সূত্রপাত। তবে যার আছে তার আরও চাই প্রবণতাও কম
দায়ী নয়।
আমাদের দেশে এই বর্ধিত হারে গুরুতর অপরাধ সাম্প্রতিক কোনো কালের সৃষ্টি নয়, এর ইতিহাস বহু পুরোনো। পাল্টেছে শুধু ধরন। ১৮৭৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় এইচ বেভারেজের লেখা বই দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ: ইটস হিস্টরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস। মি. বেভারেজ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি নিয়ে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলায় (বর্তমানে ছয়টি জেলায় বিভক্ত ও বরিশাল বিভাগ নামে পরিচিত) কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি তাঁর বইয়ে দারোগার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সব অপরাধের একটি নিয়মিত হিসাব সংরক্ষণ করেছেন। ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ১৭৯৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছরের বিচারের সংখ্যার একটি হিসাব দিয়েছেন। ওই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৭৯৭ থেকে ১৮০১ সাল পর্যন্ত ওই এক জেলায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৮৬টি, ডাকাতি ১০১টি এবং ডাকাতি ও খুন ৩০টি। এ ছাড়া আছে অন্যান্য অপরাধ।
আমি ২০০ বছরের বেশি পুরোনো এই পরিসংখ্যান দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করছি। তা–ও আবার একটি জেলার। দেশের সব অঞ্চলই কমবেশি একই রকম অপরাধপ্রবণ ছিল। ব্রিটিশ শাসন, পরে পাকিস্তান এবং ৪৭ বছর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একই সঙ্গে অপরাধের ধরন পাল্টেছে, বিস্তার ঘটেছে। কমেছে ডাকাতির মতো অপরাধ, বেড়েছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন। এ শুধু এই স্বাধীন বাংলাদেশে নয়, সমগ্র ভারতেও একই অবস্থা। পার্থক্য শুধু তাদের পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা আমাদের চেয়ে অধিক কার্যকর। কথা হলো, এ রকম কার্যকর আইন,
পুলিশ বাহিনী ও বিচারব্যবস্থা দিয়ে এসব গুরুতর অপরাধ সম্পূর্ণ রোধ করা যায় কি না। দেখা যায় তা সম্ভব নয়, শুধু কিছুটা লাগাম টেনে ধরা যায়। ভারতই তার বড় উদাহরণ।
গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা অনেকটা বেহাল হওয়া শুরু করে স্বাধীনতার পরপরই। সদ্য স্বাধীন দেশ—সবকিছুই নড়বড়ে অবস্থায় ছিল। বঙ্গবন্ধু কতিপয় গুরুতর অপরাধ সংঘটন রোধ করতে রক্ষীবাহিনী গঠন করলেন। রক্ষীবাহিনী গঠন সঠিক ছিল কি না, তা নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে যুক্তি আছে। এই রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে যাঁরা বিশেষ ধরনের প্রচার চালিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটেছেন, তাঁরাই বাংলাদেশে ক্রসফায়ার আমদানি করেছেন, ভারতে যা এনকাউন্টার। এতে সমূহ কিছু ফল দেয় বটে, তবে এ ব্যবস্থা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ট্যাবলেট খাইয়ে রোগ চাপা দেওয়ার মতো।
কিন্তু এই ক্রসফায়ার, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, অধিকতর কঠোর আইন, অধিক সংখ্যায় ফাঁসির দণ্ড ইত্যাদি কোনো কিছুই যেন তোয়াক্কা করছে না অপরাধীরা। অবশ্য ঢাকায় গ্যাংস্টার জাতীয় চাঁদাবাজদের খুনোখুনি আপাতত বন্ধ বলে মনে হয় এবং গ্যাংদের স্টাররা কেউ কেউ ধরা পড়েছে, অন্যরা পালিয়ে গেছে। ভারতের ও বাংলাদেশের আইনি ব্যবস্থা একই ব্রিটিশরাজ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তবে পুলিশ বাহিনী ও বিচারব্যবস্থায় জড়িত লোকজনকে সততা নিয়ে এ দেশে প্রশ্নের মাত্রা ভারতের চেয়ে বেশি। কতিপয় পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক এবং বিচারালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা–কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরে ঘুষ লেনদেন একটি নিয়ামক শক্তি মর্মে অভিযোগ আছে। মামলার বিচারে দীর্ঘ বিলম্ব এবং মামলার সংখ্যার তুলনায় বিচারকস্বল্পতাও দায়ী। যত দ্রুত সম্ভব এসব সমস্যা দূর করা যায়, ততই একটি অপরাধমুক্ত দেশ গড়ার দিকে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।
জাফর ইমাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী