কিছুদিন ধরে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলে আসছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখন ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’। একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি যে কেবল তাঁর ‘জীবন-মৃত্যুর’ বিষয় তা নয়, এর সঙ্গে দেশের আইন ও রাজনীতির বিষয় সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে, যা এমনকি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করবেন। ইতিমধ্যে তার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। এ প্রশ্নের সঙ্গে যুক্ত আছে বিএনপির ভবিষ্যতের প্রশ্নও। কেউ যদি এ প্রশ্ন করেন, বিএনপি কি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে? তাহলে তাঁকে কি অতিরঞ্জনের দায়ে দায়ী করা যাবে?
বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর দাবি করে আসছে। গত মঙ্গলবার মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের পরামর্শকে উদ্ধৃত করে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। কারণ, দেশের ‘হাসপাতালগুলো যথেষ্ট যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ নয়’। এ বিষয়ে পরিবারের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। সরকার এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। সরকার বলছে, যেহেতু তিনি একজন দণ্ডিত ব্যক্তি, সেহেতু আইনের বাইরে সরকার কিছু করবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা তিনি ইতিমধ্যেই ব্যবহার করেছেন। ১৭ নভেম্বর তিনি বলেছেন, ‘আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার, সেটুকু আমি দেখিয়েছি। এখানে আমার কিছু করার নাই। আমার যেটা করার, আমি করেছি। এটা এখন আইনের ব্যাপার।’ কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটাও প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি নয়?’ আইনের প্রশ্নটি তুলেছেন বিএনপি–সমর্থক আইনজীবীদের একটি দলও। তাঁরা মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্মারকলিপি দিয়ে বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১)-এর ধারা অথবা ৪০১-এর ৬ উপধারা মোতাবেক বিশেষ আদেশের মাধ্যমে সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে। এ সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ জানে বেঁচে না থাকুক, সেটি আমাদের উদ্দেশ্য নয়’ (প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর ২০২১)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন ধরনের সমালোচনার পরও বলেছেন, তিনি মানবিক আচরণ করেছেন বলেই খালেদা জিয়া বাসায় আছেন, চিকিৎসা পাচ্ছেন।
ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কারণে সম্ভাব্য ‘গুজব ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে’ দেশজুড়ে পুলিশকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে (প্রথম আলো, ২৩ নভেম্বর ২০২১)। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বিএনপি কর্তৃক কিছু কর্মসূচি পালনের পর। সরকারের এ পদক্ষেপ সেসব কর্মসূচির প্রতিক্রিয়া, নাকি সবার জানা নেই, এমন কিছু আশঙ্কার কারণে, সেটা আমরা জানি না। এমন অনুমান করা যেতে পারে যে বিএনপির ওপর আরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টির জন্যও এটা করা হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ‘রেড অ্যালার্ট’ যে আরও বেশি উদ্বেগের সৃষ্টি করবে, সেটা বোধগম্য। এ থেকে এমন অনুমান করাই স্বাভাবিক যে বিএনপি যা বলছে, অবস্থা সম্ভবত তার চেয়ে বেশি খারাপ। বিএনপি খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সব ধরনের রেকর্ড জনসমক্ষে প্রকাশ করছে না কেন, এ প্রশ্ন করা যায়। বলাই বাহুল্য, এ জন্য রোগী হিসেবে খালেদা জিয়ার সম্মতি দরকার হবে। কিন্তু এ ধরনের তথ্য জানালে এটা বোঝা যেত যে আদৌ বিএনপির দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু এবং বিপরীতক্রমে সরকার এ ধরনের আবেদন নাকচ করে নৈতিকভাবে ঠিক করছে কি না। স্বচ্ছতার স্বার্থেই বাংলাদেশের নাগরিকদের এটা জানানো বিএনপির দায়িত্ব। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর কোনো উদাহরণ আছে কি না, সেটা প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচ্য না হওয়াই সমীচীন। বিএনপি ও আইনমন্ত্রী উভয় পক্ষ মানবিক বিবেচনার কথাই বলছে।
বিএনপি যে কেবল তার নিজের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই ক্রমাগতভাবে ক্ষীণশক্তি হয়েছে, তা নয়; বরং দেশে গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা ঘটেছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের খুঁটিগুলো জোরদার হয়েছে, রাষ্ট্র-সরকার-দলের পার্থক্য ঘুচিয়ে এক ব্যক্তির শাসনের দিকেই দেশ এগিয়েছে।
এ কথা বললে সম্ভবত অতিরঞ্জন হবে না যে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রশ্নকে সামনে এনেছে। বিএনপি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল হলেও আজকের যে বিএনপি, তা খালেদা জিয়ার বিএনপি। কয়েক দশক ধরে এর নেতৃত্বে থেকে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যা করেছেন, তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক—সবটাই বিএনপির ঐতিহ্য। ফলে বিএনপি যেমন একদিকে ১৯৮২-৯০ সালে গণতন্ত্রের আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বের কৃতিত্ব দাবি করে, যেমন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে অর্থনৈতিক সাফল্য দেখিয়েছেন, নারীশিক্ষার অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখেছেন, তার কৃতিত্ব দাবি করে; তেমনি তাদের মেনে নিতে হবে যে তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার ওপর হামলার দায় তাঁর ওপর বর্তায়। কারণ, এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। একদলীয়ভাবে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে এরশাদের তৈরি ধারা ১৯৯৬ সালে বিএনপি অনুসরণ করেছে, সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী দেশের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর
সঙ্গে জোট গঠনের প্রয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বিএনপি সেই পথ থেকে কেন সরে আসেনি, তার কোনো ব্যাখ্যাও দলটি দেয়নি। ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি আত্মসমালোচনার পথ বেছে নেয়নি, যদিও বারবারই তার তাগিদ তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত, ২০১৫ সালের আন্দোলন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে দল কী পেয়েছে, দেশ কী পেয়েছে, সেটা রাজনীতির বিশ্লেষকেরা বলেন; কিন্তু বিএনপি নিজে তার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার জন্য মূল্যায়ন করেছে, এমন কোনো লক্ষণ নেই। মনে রাখতে হবে, এ সময় দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন খালেদা জিয়া।
এ সময়ে বিএনপি যে কেবল তার নিজের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণেই ক্রমাগতভাবে ক্ষীণশক্তি হয়েছে, তা নয়; বরং দেশে গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা ঘটেছে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের খুঁটিগুলো জোরদার হয়েছে, রাষ্ট্র-সরকার-দলের পার্থক্য ঘুচিয়ে এক ব্যক্তির শাসনের দিকেই দেশ এগিয়েছে। বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করে সুইডেনভিত্তিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স। তারা সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শাসনকে চিহ্নিত করেছে ‘কর্তৃত্ববাদী’ বলে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আয়োজিত গণতন্ত্র শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত হয়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে, সমাবেশের অধিকার তিরোহিত হয়েছে, আইন ও আইনবহির্ভূতভাবে নিপীড়ন অতীতের যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এই নিপীড়নের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন। এর বিপরীতে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করতে বিএনপি সক্ষম হয়নি, দলের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতিকে দল কার্যকর রূপ দিতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনীতির মাঠে বিএনপি যে এখনো প্রধান দল, তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও স্মরণ করিয়ে দেন।
২০১৮ সালে আটক হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব না দিলেও তাঁকে কেন্দ্র করেই দল একত্র থেকেছে। তিনিই দলের প্রতীক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐতিহ্য হচ্ছে এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। এটি গণতন্ত্র, রাজনীতি ও দলের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রতিবন্ধক, কিন্তু বিশেষ কোনো দলের বৈশিষ্ট্য নয়। ২০০৭-২০০৮ সালে এ সংস্কৃতিকে জোর করে বদলানোর চেষ্টায় প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব বদলের চেষ্টা সফল হয়নি। বরং তার ফল নেতিবাচক হয়েছে। কেননা, জোর করে সংস্কৃতি বদলানো যায় না, জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এটি সম্ভব নয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলে এ ধারা বদলানো যাবে না। দল গঠন ও তার আবেদন মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হলে গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চার মধ্য দিয়েই তা বদলানো সম্ভব।
এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির ধারায় দলের প্রধান যখন ‘জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’, সে সময় বিএনপির নেতৃত্বকে ভাবতে হবে, তাঁরা ভবিষ্যতে কীভাবে এগোবেন। দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি সংকটে, সম্ভবত দলের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এখন। বিএনপির এ পরীক্ষার ফল কেবল যে বিএনপি ভোগ করবে, তা নয়; অতীতের মতোই এর ফল বাংলাদেশের নাগরিকদেরও ভোগ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আচরণ–ভূমিকা দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতি না বদল হওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে বাদ দেওয়া যাবে না।
খালেদা জিয়া দ্রুত সুস্থ হবেন, সেটাই প্রত্যাশা। আশা করা যায়, সরকার মানবিকভাবে বিবেচনার কথা যা বলেছে, তা বিস্মৃত হবে না। কেননা, দণ্ডিত হলেও এবং বাড়িতে থাকলেও তাঁর যথাযথ চিকিৎসা না হলে সরকারের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠবে। সেটা নিশ্চয় ক্ষমতাসীনেরা চাইবেন না।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট