বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘একটি ব্যর্থতার’ কথা জানিয়েছেন । তাঁর ভাষায় খালেদা জিয়ার ব্যর্থতা হলো, তিনি বিএনপির মধ্যে সৎ, নির্ভীক ও সাহসী লোক তৈরি করতে পারেননি। তাঁর চারপাশে থাকা লোকগুলোও তাঁকে সৎ পরামর্শ দিচ্ছেন না। গয়েশ্বর খালেদা জিয়ার চারপাশে থাকা লোকগুলো বলতে কী বুঝিয়েছেন, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে তিনিও কাছের লোক। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁরও সক্রিয় ভূমিকা থাকার কথা। তবে গয়েশ্বর নিজের দায়ও পুরোপুরি অস্বীকার করেননি। বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যেও ঘাটতি আছে।’ তিনি দলের নির্বাচিত ছয়জন সাংসদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
দুর্নীতির দুটি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিগত ১৪ মাস কারাগারে আছেন। বিএনপির নেতারা মনে করেছিলেন, নিম্ন আদালতে শাস্তি হলেও তিনি জামিন পাবেন। কিন্তু অন্যান্য মামলায় জামিন পেলেও খালেদা এই দুটি মামলায় এখনো জামিন পাননি। তাঁর মুক্তির দাবিতে বিএনপি সভা, সমাবেশ, গণ–অনশন, মানববন্ধনের মতো নানা কর্মসূচি পালন করলেও সরকারের ওপর তেমন চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। এ নিয়ে দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।
গয়েশ্বের চন্দ্র রায় যখন খালেদা জিয়ার আশপাশের লোকজন সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেন, তখনই তাঁর (খালেদা জিয়া) প্যারোলে মুক্তি নেওয়া না–নেওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সরগরম আলোচনা চলছে। বিএনপির নেতাদের কেউ এ ব্যাপারে মুখ না খুললেও সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের বেশ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে মন্তব্য করে চলেছেন।
পত্রিকায় খবর বের হয়েছিল, ৩০ এপ্রিলের আগেই খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে পারেন। তবে তার আগে বিএনপির ছয়জন সাংসদকে শপথ নিতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেছেন, খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে সরকার বিবেচনা করে দেখবে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, প্যারোলে মুক্তি চাইতে হয়, না চাইলে সরকার কাউকে জোর করে প্যারোল দিতে পারে না । কিন্তু তাঁদের কেউ বলেননি খালেদা জিয়া এ রকম আবেদন করলে সেটি মঞ্জুর হবে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ বলেছেন, আইনি লড়াই ছাড়া খালেদা জিয়াকে মুক্তি পেতে হলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতাদের মন্তব্য এবং সংবাদমাধ্যমের খবর সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে জেলখানায় তাঁদের কথা হয়েছে। প্যারোলের বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। তবে এর আগে মহাসচিব বলেছিলেন, প্যারোলে মুক্তি চাওয়া দলের বিষয় নয়, পরিবার থেকে কেউ চাইলে সেটি ভিন্ন কথা।
খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি চাওয়া নিয়ে বিএনপির মধ্যে দুটি মত আছে। একপক্ষ মনে করে, যেহেতু আন্দোলন করে খালেদাকে মুক্ত করা যাচ্ছে না, সেহেতু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে হলেও তাঁর সুচিকিৎসা হওয়া উচিত। অপরপক্ষের দাবি, প্যারোলে মুক্তির আলোচনা হলো ক্ষমতাসীনদের একটি ফাঁদ। খালেদা জিয়া সরকারের কাছে প্যারোলে মুক্তির আবেদন করার পর সেটি গৃহীত হলে সরকারের উদারতা প্রকাশ পাবে। আর গৃহীত না হলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোবল আরও ভেঙে যাবে।
এদিকে খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তাঁর অন্যতম আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী সমিতির এই সাবেক সভাপতি বলেন, দণ্ডিত খালেদা জিয়াও প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন। তবে সে ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে এবং তাঁকেও প্যারোলে মুক্তির জন্য আবেদন করতে হবে। তাঁদের নেত্রীর প্যারোলে মুক্তির চিন্তা করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে একটি সংবাদ সংস্থার কাছে তিনি বলেন, ‘সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখানে আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমরা তাঁর মামলা করি, মামলা নিয়ে বলতে পারি। প্যারোলটা মামলাসংক্রান্ত ব্যাপার না। এটা একটা বিশেষ বিধান।’
প্যারোলে খালেদার মুক্তি নিয়ে আইনি তর্কও আছে। সরকার সমর্থক আইনজীবীরা মনে করেন, বিচারাধীন আসামিরাই প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন, দণ্ডিত বন্দীরা নন। তবে এই মতের বিরোধিতা করে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘২০১৬ সালের নীতিমালা অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত আসামি, হাজতি আসামি যাঁরা সাজাপ্রাপ্ত না হয়েও কারাভোগ করছেন, উভয়ই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্যারোলে মুক্তি পেতে পারেন।’
কোনো বন্দীর প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি বন্দীর পক্ষ থেকেও আসতে পারে, আবার সরকারের পক্ষ থেকেও। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি ছিলেন। আন্দোলনকারী জনগণের দাবি ছিল, তাঁর নিঃশর্ত মুক্তি। কিন্তু সরকার প্রথমে তাঁকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেয়। আওয়ামী লীগের একাংশ সেই প্রস্তাবে নিমরাজিও হয়েছিল। তবে বেগম মুজিবের অনমনীয় ভূমিকার জন্য সেটি হয়নি। পরে সরকার বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির তৎকালীন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানও চিকিৎসার জন্য প্যারোলে বিদেশে গিয়েছিলেন। এর আগে সরকার শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে বাধা দিলে ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকার নতি স্বীকার করে। আর বিদেশে যাওয়ার আগে দেশবাসীর কাছে লেখা এক চিঠিতে তারেক নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং আর রাজনীতি করবেন না বলে ওয়াদা করেন।
এবারে খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী হবে? বিএনপি কি তাঁর মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে? যদি না পারে তাহলে কি তিনি প্যারোলের জন্য আবেদন করবেন?
আর আবেদন করলেই কি সরকার সেটি মঞ্জুর করবে? এ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎই দিতে পারে।