যুক্তরাষ্ট্রের মৌসুমি রাজনীতিতে চার বছর পর পর ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ সময় দুনিয়াজুড়ে মানুষের আগ্রহ থাকে প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেট নিয়ে, যেখানে প্রধান দুই প্রার্থী দ্বন্দ্বযুদ্ধে শামিল হন। বুধবার সকালে প্রথম দফার লড়াইটি দেখলাম এবং শুনলাম। আগের নির্বাচনগুলোর সময়ও এমন হয়েছে। কিন্তু কখনো লাইভ দেখিনি। এই প্রথমবার দেখা এবং কিছুটা হতাশ। আমাদের টিভি টক শোতে যেভাবে একজনের কথার মধ্যে আরেকজন জোর করে ঢুকে যান, অনেকটা সে রকম হলো। ওরা কি আমাদের কাছ থেকে শিখছে?
আমাদের দেশে নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের তর্কবিতর্ক হয় না। যা হয়, তা হলো একের অনুপস্থিতিতে অন্যকে গালাগাল। নিকট অতীতে কোনো কোনো নাগরিক সংগঠন ও টিভি চ্যানেলের সঞ্চালনায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এক মঞ্চে এনে কথা বলানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে এটি কখনো হয়নি। মনে আছে, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ শিরোনামে একটি টিভি অনুষ্ঠান হয়েছিল দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের নিয়ে। তাঁরা নির্বাচিত কয়েকজন প্রশ্নকর্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আলাদাভাবে। আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে সভাপতি শেখ হাসিনাও ছিলেন। বিএনপির পক্ষে খালেদা জিয়া আসেননি। এসেছিলেন বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ কয়েকজন। তারপরও বলব যে অনুষ্ঠানটি ভালো হয়েছিল।
দ্বিদলীয় রাজনীতিতে এ ধরনের তর্কবিতর্কের অনেক মূল্য আছে। সামনাসামনি বিতর্ক হলে রাজনীতির একটা সভ্যভব্য ধারা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে ফাঁস হওয়া হাসিনা-খালেদার টেলিফোন সংলাপ শোনার। এই সংলাপের ফলাফল আশানুরূপ না হলেও সরাসরি যে কথা হয়েছে, তা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে সব পক্ষের আগ্রহ না থাকলে এটা চালু রাখা সম্ভব হবে না।
দ্বিদলীয় রাজনীতির প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন তার বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক। আমরা মানি আর না-ই মানি; এ দেশের প্রধান দুটি দল হলো আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। বিএনপি এখন গাড্ডায় পড়ে গেছে। তারপরও তারা যে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা বোঝা যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাবার্তা শুনে। তাঁরা কেউ পাঁচ মিনিট কথা বললে তাতে বিএনপির প্রসঙ্গ থাকে তিন মিনিট।
দুই দলের দুজন আইকন আছেন। আওয়ামী লীগের আইকন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিএনপির আইকন হলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ চরম বেকায়দায় পড়েছিল। ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে শেখ হাসিনাকে এনে দলের সভাপতি করার পর দলটির পুনরুজ্জীবন ঘটে। এখন যে আওয়ামী লীগ দেখি, এটি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ।
বিএনপির গল্পটিও একই রকম। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তাঁর দলটিও বিপদে পড়েছিল। বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে সেনাপ্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর বিএনপির অগস্ত্যযাত্রা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়াকে চেয়ারপারসন বানানোর পর তিনি দলের পুনরুজ্জীবন ঘটান। এখন যে বিএনপি দেখা যায়, এটা খালেদা জিয়ার বিএনপি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটা জায়গায় মিল। শীর্ষ নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা এবং পারিবারিক উত্তরাধিকার এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা না থাকলে দলের কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার দরকার নেই। অবস্থাটি অনুমান করা যায়।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে খালেদা জিয়ার সাজা, গ্রেপ্তার ও প্যারোল ছিল বড় একটা সংবাদ শিরোনাম। তিনি আদালতের দেওয়া সাজা ভোগ করছেন। দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর ছেলে তারেক রহমানকে। পারিবারিক পরম্পরা বজায় রেখেই এটি করা হয়েছে। তবে এটা মানতেই হবে, খালেদা আর তারেক এক নন। খালেদার উত্থান ১৯৮০-এর দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি এখনো মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
দণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়া সক্রিয় রাজনীতি করতে পারছেন না। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর দল আন্দোলন করে তাঁকে মুক্ত করবে। ‘আমার নেত্রী আমার মা, বন্দী হতে দেব না’ স্লোগান যাঁরা একদিন আদালতপাড়ায় দিয়েছিলেন, আদালতের রায়ের পর তাঁদের কাউকে আর রাস্তায় দেখা যায়নি। খালেদাকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় মুক্ত করা যায়নি। আন্দোলন করে মুক্ত করার দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও খালেদার মুক্তির জন্য কোনো আন্দোলন হয়নি। এটা বুঝতে পেরেই বিএনপির নেতারা এবং খালেদার স্বজনেরা ‘মানবিক’ কারণে তাঁর মুক্তি চেয়েছেন। এখন তাঁর সাজা স্থগিত আছে। আওয়ামী লীগের লোকেরা বলতেই পারেন, শেখ হাসিনা মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে আপাতত তাঁর (খালেদা) বাসায় থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার সাজা, প্যারোল, চিকিৎসা, বিদেশে যাওয়া—এসব নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। এ নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্য কী, তা আমরা জানি না। তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান কি না, এটিও তাঁর কাছ থেকে জানা যাচ্ছে না। তাঁর হয়ে অন্যরা বলছেন।
প্যারোল বা শর্তাধীন জামিনের কারণে খালেদা জিয়া সক্রিয় রাজনীতিতে থাকতে পারছেন না। চিকিৎসার জন্য তাঁকে যদি বিদেশে যেতে দেওয়া হয়, তাহলে বিদেশে গিয়ে তিনি শুধু চিকিৎসাই নেবেন, রাজনীতি করতে পারবেন না। শর্ত ভেঙে রাজনীতি করলে তিনি অপরাধী বলে গণ্য হবেন। সে অবস্থায় তিনি যদি দেশে ফিরে না আসেন বা আসতে অস্বীকার করেন, তাহলে ‘পলাতক’ হয়ে বিদেশে বসে তিনি কী করবেন?
খালেদা জিয়া কি আসলেই বিদেশে যেতে চান? তিনি কি রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হতে চান? রাজনীতির ভারসাম্যে এমন কোনো পরিবর্তন কি নিকট ভবিষ্যতে হবে, যার ফলে তিনি আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারবেন? এ প্রশ্নগুলোর চটজলদি উত্তর নেই।
বাজারে অনেক গসিপ আছে। একটি হলো চাপে পড়েই তাঁর সাজা স্থগিত করা হয়েছে। কোভিড-১৯ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে—এমনটিও বলা হয়। জেলের ভেতরে থাকুন আর নিজের বাসায়, একজন নিষ্ক্রিয় খালেদা ক্ষমতাসীনদের জন্য বিপজ্জনক নন। আর তাঁর বিরুদ্ধে তো অনেক মামলা। খালেদাকে সরকার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রেখে দিতে পারে। দু-একটা বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া ছাড়া বিএনপির তেমন কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। বিএনপির নেতারা এখন যাঁর যাঁর সহায়সম্পদ সামলাতেই ব্যস্ত। তার ওপর আছে অগুনতি মামলা।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, এমনটিই কি চলতে থাকবে? এ প্রশ্নের কোনো সরল উত্তর নেই। বিএনপি মোটামুটি সব অপশন প্রয়োগ করে দেখেছে। আদালতে হেরেছে। আন্দোলন তৈরি করেত পারেনি, এখন হরতাল হয় না। বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো তারা কিছুই করেনি। গত সংসদ নির্বাচনে যা হলো এবং বিএনপির যে কজনকে জিততে দেওয়া হলো, তাঁরা সুড়সুড় করে সংসদে ঢুকে তাঁদের নৈতিক অবস্থানটিও হারিয়েছেন। এখন বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে হলে খালেদার ভবিষ্যৎ নিয়ে আগে ভাবতে হবে। দলটি খালেদার।
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক