বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বেশ দীর্ঘ সময় ধরেই অসুস্থ। গত এক বছরে একাধিকবার হাসপাতাল-বাসা-হাসপাতাল করেই সময় কাটছে তাঁর। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি আবারও একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ আর্থরাইটিস, কিডনি, ফুসফুস, ডায়াবেটিস ও চোখের নানা জটিলতায় ভুগছেন। সম্ভবত করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে তাঁর নানা শারীরিক জটিলতা তীব্র হয়েছে।
বিভিন্ন সময় খালেদা জিয়ার পরিবার ও দল বিএনপির পক্ষ থেকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার দাবি করা হলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যুক্তি দেখিয়েছে, খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাঁর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজি সেলিম বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। হাজি সেলিম কেন বা কীভাবে গেলেন, আর খালেদা জিয়া কেন বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে পারছেন না, তা এখন পরিষ্কার। অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিক কারণেই খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা, মুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করছে। ঠাট্টা-তামাশাও কম করছে না। আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে আনতে এই ইস্যু আওয়ামী লীগ ব্যবহার করতে পারে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপিকে সংলাপে আনতে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও মুক্তির বিষয়টি আওয়ামী লীগ ব্যবহার করেছিল। আওয়ামী লীগের রাজনীতি আওয়ামী লীগ করুক; কিন্তু আওয়ামী লীগের এই রাজনীতির জুতসই জবাব বিএনপি দিতে পারছে না। দেবেই-বা কী করে; বরং বিএনপিরও কেউ কেউ সম্ভবত খালেদা জিয়ার মুক্তির ‘মুলা’ দেখিয়ে রাজনীতি করছেন।
শুক্রবার রাতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সময় তিনি চিকিৎসকদের বুকের ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের কথা জানান। বারবার হাসপাতালে যাওয়ার হয়রানি ও খানিকটা অভিমান থেকেই কি তিনি অসুস্থতার কথা চেপে রেখেছিলেন? বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি কি খালেদা জিয়ার বুকের কোথাও অভিমান জমা হয়েছে?
গত বছরের শেষার্ধে খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই সময় অনেকেই তাঁকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর দাবি তুলেছিলেন। এমনকি বিএনপির সংসদ সদস্যরা হুমকিও দিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার সুবিধা না পেলে তাঁরা পদত্যাগ করবেন। এরপর খালেদা জিয়া কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আবারও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সংসদ সদস্যরা হয়তো পদত্যাগের মতো কঠিন পদক্ষেপ নিতে পারেননি কিন্তু খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে জোরদার কিছু করতেও ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরাই ২০১৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁরা সংসদে গিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
আগামী নির্বাচনকে ঘিরে নতুন কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগ বা সরকারের সঙ্গে সংলাপ করে এবং আওয়ামী লীগের অধীন নির্বাচনে অংশ নেয়, তবে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হবে— এমন কথা বাজারে চালু আছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবি করা হলেও একটি অংশের ভিন্ন তৎপরতার কানাঘুষা আছে। এই অংশ সম্ভবত প্রচেষ্টা চালাবে বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অধীন নির্বাচনে নেওয়ার জন্য। বিনিময়ে এই অংশের কয়েকজন নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসতে পারেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ও বিএনপির একাংশের রাজনীতি একই বিন্দুতে মিলে যাচ্ছে।
স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিএনপির অনেকেই রাজনীতি করে নিজের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। খালেদা জিয়ার জেলজীবন, নাজিম উদ্দিন রোডের স্যাঁতসেঁতে পরিত্যক্ত কারাগারে জেলবাসের জন্য আওয়ামী লীগের বিদ্বেষপ্রসূত রাজনীতির পাশাপাশি বিএনপির একাংশের আঁতাতও কাজ করে থাকতে পারে। যে কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হাজি সেলিমকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়। আর খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়। এ জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে কঠিন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি আওয়ামী লীগকে।
অথচ দলটির জন্য খালেদা জিয়া জীবনের পুরোটাই দিয়ে দিলেন। তিনি একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী, দুবার সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, এবং সর্বোপরি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী। একজন সাধারণ গৃহবধূর বৃত্ত ভেঙে তাঁকে রাজনীতির হাল ধরতে হয়েছে। দলের ভাঙন, নানা প্রলোভন তাঁকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা হলেও এই দলকে ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে বিস্তৃত করেন খালেদা জিয়া। রাষ্ট্র পরিচালনায় খালেদা জিয়ার নানা সমালোচনা আছে; কিন্তু দলের প্রতি তাঁর অবদান ও নিবেদন শতভাগ ছিল। দল বা দলের নেতা-কর্মীদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি কখনো পালিয়েও যাননি।
২০১৭ সালে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। চাইলে ওই সময় তিনি লন্ডনে থেকে যেতে পারতেন। এমন প্রচারও করা হয়েছিল, তিনি আর ফিরবেন না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে আর ফিরে না আসার ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। কিন্তু জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েই তিনি দেশে ফিরেছিলেন। ২০০৭ সালে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাঁকে একাধিকবার বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দেশে অবস্থানের বিষয়ে তিনি অনড় ছিলেন। তখন বিএনপিরও অনেকেই তাঁকে বুঝিয়েছিলেন বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য। তিনি এসব প্রস্তাব আমলে নেননি। ফলে ওই সময়ও তাঁকে কারাগারে যেতে হয়েছিল।
২০০৭ সালে বিদেশ যেতে রাজি না হওয়া বা ২০১৭ সালে সব জল্পনা-কল্পনাকে উড়িয়ে দিলে দেশে ফিরে এসে জেলবন্দী হওয়া দলের জন্যই তাঁর আত্মত্যাগের প্রতিফলন। তিনি হয়তো অনুধাবন করেছিলেন, বিদেশে বসে দল পরিচালনার চেয়ে দেশে জেলে থাকা দলের জন্য ইতিবাচক হবে। দেশেই অবস্থান করলে তার নিজেরও শক্তিশালী ভাবমূর্তি তৈরি হবে। তাই জেলে যাওয়ার শঙ্কা থাকার পরও নিঃশঙ্ক চিত্তে দেশে ফিরে এসেছেন। অথচ বিএনপির রাজনীতি পুরোই খালেদা জিয়ার নীতি ও কৌশলের বিপরীতমুখী।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া তাঁরা নির্বাচনে যাবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি। একধরনের নেতৃত্বহীন, ভারসাম্যহীন জগাখিচুড়ি মার্কা জোট করে তাঁরা সরকারের সঙ্গে সংলাপে গেলেন। নির্বাচনেও গেলেন। বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মীই মনে করেন, দলের একটি অংশ সরকারের আঁতাত করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে দলকে উৎসাহিত করছে। এতে দলের কোনো লাভ হয়নি; বরং খালেদা জিয়ার জেলজীবন দীর্ঘায়িত হয়েছে। বিএনপির কেউ কেউ হয়তো খালেদা জিয়ার জীবনের বিনিময়ে আপস চান! তাই তাঁরা খালেদা জিয়ার মতো আপসহীন থাকতে পারছেন না।
এ ছাড়া বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়ার জেলবাসকে আন্তর্জাতিক পরিসরে সঠিকভাবে তুলে ধরতেই পারেননি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দায়িত্বে থাকা নেতা-কর্মীরা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পাদকদের কাজ বিভিন্ন দেশে দলের কমিটি করা না। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে খালেদা জিয়ার প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টি তুলে ধরা। কিন্তু সরষের মধ্যেই সমস্যা থাকলে ভূত তাড়ানো কঠিন। বিএনপি সরষের মধ্যেই ভূত নিয়ে বসে আছে।
খালেদা জিয়ার সর্বশেষ অসুস্থতা নিয়ে তাঁর দলের বিভিন্ন সূত্রে যতটুকু জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি তিনি কাউকে তেমন বলেননি।
শুক্রবার রাতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের সময় তিনি চিকিৎসকদের বুকের ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের কথা জানান। বারবার হাসপাতালে যাওয়ার হয়রানি ও খানিকটা অভিমান থেকেই কি তিনি অসুস্থতার কথা চেপে রেখেছিলেন? বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি কি খালেদা জিয়ার বুকের কোথাও অভিমান জমা হয়েছে? খালেদা জিয়ার নাম বলার আগে তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা বিশাল লম্বা স্তুতিগাথা ও হরেক রকমের বিশেষণ জুড়ে দেন। কিন্তু কই, কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না। খালেদা জিয়া কার্যত এখনো জেলেই আছেন। তাঁকে জেলে রেখেই তো বিএনপির সদস্যরা সংসদে যাচ্ছেন নিয়ম করে। দলের মধ্যেও কোন্দল নেহাত কম নয়। কে কাকে তুলবে, ডোবাবে এসব নিয়েই সবাই ব্যস্ত। পদপদবির জন্য হুলুস্থুল কাণ্ড চলে বিএনপির মধ্যে সব সময়। সবাই তো দিব্যি করে কম্মে খাচ্ছে। কেবল খালেদা জিয়ার মুক্তির আওয়াজই দিন দিন স্তিমিত হয়ে আসছে।
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক