২৪ জুলাই, ২০২০। শুক্রবার। ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক স্থাপনা হায়া সোফিয়ায় হাজির হয়েছেন লক্ষাধিক মুসল্লি। মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুতবা দিচ্ছেন তুরস্কের ধর্মমন্ত্রী অধ্যাপক ড. আলী এরবাস। তাঁর হাতে একটা তরবারি। তরবারির ফলা মেঝেতে আর বাঁটটি এরবাসের বাঁ হাতের তালুতে ঠেকানো। খুতবা শেষে ইমাম জমকালো মেহরাবে দাঁড়ালেন। পেছনে মুসল্লি হয়ে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। নামাজ শেষ হলো। এর মধ্য দিয়ে ৮৬ বছর পর আবার হায়া সোফিয়া মসজিদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেল।
১৪৩৫ সালে কনস্ট্যান্টিনোপলের পতনের পর (৫৩৭ সালে ক্যাথিড্রাল হিসেবে বানানো) হায়া সোফিয়াকে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে কিনে মসজিদে রূপান্তরিত করেছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত। সেই থেকে উসমানীয় শাসকেরা তাঁদের আজিমুশ্বান নিশানা হিসেবে হায়া সোফিয়াকে দেখে এসেছেন। এর প্রায় ৫০০ বছর পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে হায়া সোফিয়া কামাল আতাতুর্কের আদেশে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল।
সেই হায়া সোফিয়াকে ফের মসজিদে রূপান্তরিত করার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এক সঙ্গে অনেকগুলো বার্তা দিয়েছেন। তুর্কিদের তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, একসময় তাঁদের এক মহাপরাক্রমশালী সালতানাত ছিল এবং সেই হৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন তাঁদের দেখতেই হবে। হায়া সোফিয়ায় ধর্মমন্ত্রী এরবাসের হাতে থাকা উসমানীয় খেলাফতের তরবারি এরদোয়ানের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার অভিলাষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে।
তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় ছিল হায়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে উন্মুক্ত করে দেওয়ার দিন হিসেবে ২৪ জুলাই তারিখটিকে বেছে নেওয়া। প্রশ্ন হতেই পারে, আরও তো কত তারিখ ছিল, বেছে বেছে ২৪ জুলাইকে কেন বেছে নেওয়া হলো?
এই দিনকে বেছে নেওয়া হলো, কারণ আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী আগের এক ২৪ জুলাইয়ে লুজান চুক্তি নামের একটি দাসখত তুর্কি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর মাত্র দুই বছর পরে, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ওই দিন পশ্চিমাদের সব শর্তের শিকল ছিঁড়ে যাবে। সেই শিকল ছেঁড়ার মুক্তিকে প্রতীকীভাবে উদ্যাপন করতেই এই তারিখটাকে বেছে নেন এরদোয়ান। তিনি জানেন, লুজান চুক্তির নাগপাশ থেকে মুক্তির পর তুর্কিরা ফের উসমানীয় সাম্রাজ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে না, কিন্তু তুরস্ক এমন এক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে, যা হারানো গৌরবের কথা গোটা দুনিয়াকে মনে করিয়ে দেবে।
লুজান চুক্তি কী? কী ছিল তাতে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সমাপ্তকারী চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে এই চুক্তি সই হয়েছিল। চুক্তিতে একদিকে ছিলেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা ছিলেন। সাত মাস ধরে আলোচনার পর ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই চুক্তিটিতে সই হয়।
চুক্তিটির উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হচ্ছে;
প্রথমত, চুক্তিতে তুরস্কের আগের সীমানা ছেঁটে একেবারে ছোট করে আধুনিক তুরস্কের সীমানা ঠিক করে দেওয়া হয়। ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দে উসমানীয় সালতানাতের আয়তন ছিল সর্বোচ্চ। তখন এর আয়তন ছিল ৩৪ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি। কখনো কখনো এই আয়তন কমেছে। বিভিন্ন সময় কমবেশি হওয়া সাম্রাজ্যের গড় আয়তন ছিল ১৮ লাখ বর্গকিলোমিটার। আর লুজান চুক্তিতে ৭ লাখ ৮৩ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তুরস্ককে দেওয়া হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যভুক্ত এলাকাগুলোকে পশ্চিমা মিত্র জোট ভেঙে টুকরা টুকরা করে অন্তত ৪০টি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করে।
চুক্তিতে বলা হয়, তুরস্ক তার আগের আরব প্রদেশগুলোর ওপর কোনো দাবি জানাতে পারবে না। সাইপ্রাসে ব্রিটিশদের দখল এবং ডডেকানিজের ওপর ইতালীয় অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। অন্যদিকে মিত্ররা তাদের তুরস্কের কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে। এর বদলে তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বত্ব ত্যাগ করবে।
দ্বিতীয়ত, আগামী এক শ বছরে তুরস্ক যাতে উঠে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য শর্ত দেওয়া হলো, তুরস্ক জীবাশ্ম জ্বালানি বা খনিজ তেল উৎপাদন করতে পারবে না। না নিজের দেশে, না অন্য দেশে। আধুনিক বিশ্বের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই জ্বালানি খাতের আধিপত্য চলে। সৌদি আরব, কাতার কুয়েতসহ উপসাগরীয় দেশগুলো শুধু তেলের জোরেই যেখানে প্রভাবশালী দেশ হিসেবে টিকে আছে, সেখানে তুরস্ককে নিজের খনিতে তেল থাকার পরও তুলতে দেওয়া হলো না।
তৃতীয়ত, ইজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে যে বসফরাস প্রণালি, সেটি তুরস্কের বুকের ওপর দিয়ে গেছে। ওই প্রণালি দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। লুজান চুক্তিতে বলা হলো, এখান দিয়ে চলাচল করা জাহাজ থেকে তুরস্ক একটা কানাকড়িও টোল আদায় করতে পারবে না।
বসফরাস প্রণালি হলো দুই সাগরের মধ্যকার শর্টকাট নৌপথ। কয়েক হাজার কিলোমিটার না ঘুরে এশিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার সহজ রাস্তা এটি। এখন ভাবুন, ইউরোপ ও এশিয়ায় কী পরিমাণ ব্যবসা হয় এবং কী পরিমাণ মালবোঝাই জাহাজ বসফরাস দিয়ে চলাচল করে? এই সব জাহাজ থেকে যদি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী টোল তোলা হয়, তাহলে কী পরিমাণ অর্থ পাওয়া যাবে চিন্তা করুন। ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদ ফুরালে শুধু বসফরাস প্রণালি থেকেই তুরস্কের জিডিপির একটি বড় অংশ যুক্ত হবে।
চতুর্থত, মক্কা ও মদিনার নিয়ন্ত্রণ তুর্কিদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। ৪০০ বছর মক্কা এবং মদিনাকে নিয়ন্ত্রণ করা তুর্কি সুলতানরা নিজেদের ‘দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম’ বলে অভিহিত করতেন। লুজান চুক্তির ধারাবাহিকতায় হেজাজের (বর্তমান সৌদি আরব) দখল ১৯৩২ সালে আমেরিকার মদদপুষ্ট সাউদ পরিবারের হাতে চলে যায়। তুরস্কের বাসিন্দারা এখনো হজে গেলে ‘আল্লাহ, আমাদের আবার মক্কা–মদিনার খাদেমের মর্যাদা ফিরিয়ে দাও’ বলে মোনাজাত করেন।
২০২৩ সালের পর কী হবে?
২০২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ বিধি অনুযায়ী, তুরস্ক ওই দিনের পরই তার আগের সীমানা দাবি করতে পারবে। বসফরাস প্রণালি দিয়ে যত জাহাজ প্রতিদিন যাওয়া–আসা করে তা থেকে কোটি কোটি ডলার টোল আদায় করতে পারবে। নিজ ভূখণ্ড থেকে তেল, গ্যাস উত্তোলন করতে পারবে।
২০২৩–এর পর তুরস্ক কী পদক্ষেপ নেবে, তা নিয়ে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক ও ভূকৌশলবিদদের মধ্যে রীতিমতো গবেষণা চলছে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছিলেন, তুরস্ক এখন নতুন বিজয় ও সাফল্যের দোরগোড়ায়। ২০২৩ সালের পর বিপ্লবী কিছু ঘটতে চলেছে।
এরদোয়ান ইরাক ও সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি এমনভাবে রেখেছেন, যা দেখে মনে হচ্ছে, এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেই ইরাকের মসুল এবং সিরিয়ার রাক্কা ও আফরিনকে তুরস্কের সঙ্গে যুক্ত করবেন। কারণ, লুজান চুক্তির আগে এই এলাকা সব সময় তুরস্কের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল।
এমনকি মসুল, ইদলিব, আফরিন, রাক্কার মতো তুর্কি ঐতিহ্যের শহরকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। লুজান চুক্তির অবসানের পর এসব এলাকাকে তুরস্ক তার মানচিত্রভুক্ত করতে পারে বলেও অনেকে ধারণা করছেন। ইজিয়ান সাগরের তুর্কি দ্বীপ যেগুলো গ্রিসকে স্থানান্তর করা হয়েছে, সেগুলো আবার তুরস্ক নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে বলে মনে করা হয়। সাইপ্রাসের ব্যাপারে তুরস্ক আবার আগ্রাসী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও মনে করা হয়।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুরস্ক নিজেই জ্বালানি অনুসন্ধানের জন্য ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করবে বলে মনে হচ্ছে। এরদোয়ান ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেল সরবরাহকারী জাহাজগুলো কৃষ্ণসাগর এবং মর্মর সাগরের মধ্যে পারাপারে তুরস্ক একটি নতুন চ্যানেল খনন করবে। এখান থেকে আদায় করা টোল তুরস্কের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলবে।
ইতিমধ্যেই নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের পথে তুরস্ক অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। তুরস্ক অটোমান সাম্রাজ্যের ভাবধারায় ফিরতে পারে এমন আন্দাজ করেই মিসর, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মিলে একটি অক্ষ তৈরি করেছে। এদের সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে।
তুরস্ক হয়তো আবার ফেরাতে পারবে না ওসমানী সালতানাতের সেই সোনালি দিন। তবে সেদিকে যাওয়ার জন্য এরদোয়ান তাঁর জনগণকে মানসিকভাবে তৈরি করছেন। উসমানীয় সালতানাতের গৌরবময় ঘটনা নিয়ে ড্রামা সিরিজ ও ছবি বানানো হচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিলাষ থেকেই ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার যুদ্ধে তুরস্ককে যুক্ত করছেন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এরদোয়ান সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত হয়েছেন। সম্প্রতি আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজারবাইজানের যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য ভারতের মোদি সরকারের সমালোচনা করেছেন এরদোয়ান। এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তিনি মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে তাঁর আন্তর্জাতিক নেতা হওয়ার আকাংখা ফুটে উঠছে।
এটি প্রায় নিশ্চিত লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরদোয়ান তেল ওঠাবেন। তেল ব্যবসার পাশাপাশি নতুন শক্তি হিসেবে তিনি তুরস্কের উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করবেন। এরপর বসফরাস প্রণালি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ইউরোপ-এশিয়ার বাণিজ্য চলাচলে প্রধান নিয়ামক বানাবেন তুরস্ককে।
এ ক্ষেত্রে বাধা এলে তা প্রতিহত করতেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে তুরস্ক। ইতিমধ্যে তাদের বানানো ড্রোন প্রযুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাটোর সদস্যদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাতিক বাহিনী তুরস্কের দখলে। সব ঠিক থাকলে ২০২৩ সালে এরদোয়ানের হাত ধরে তুরস্ক এমন এক ধাপ অতিক্রম করবে, যা তুর্কিদের ফের উসমানীয় খেলাফতকালের দিকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com