রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশ গম উৎপাদন করে। ইউক্রেন একা বিশ্বের ২০ শতাংশ ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ। সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে বিশ্বে ইউক্রেন শীর্ষে। রাশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার রপ্তানিকারক দেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, জ্বালানি ও সার সরবরাহের শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। পূর্ব ইউরোপের এ যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে চলেছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। এ সংকটের পেছনে নিজেদের কোনো দায় না থাকলেও দেশে দেশে খাদ্যশস্য ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি, খাদ্যপ্রাপ্তির সক্ষমতা হ্রাস, জীবনযাত্রার ব্যয় একধাপে বেড়ে যাওয়া ও জ্বালানিসংকটের মতো পরিস্থিতি তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ রীতিমতো খাদ্যসংকটের মুখে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। ইতিমধ্যেই অনেক দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি। জাতিসংঘ কৃষি ও খাদ্য সংস্থার গত ৮ এপ্রিলের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, যুদ্ধ শুরুর পর দেড় মাসের মধ্যে বিশ্বে গম ও ভুট্টার মতো প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছে, যা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করছে। এ ঝুঁকি নিশ্চিতভাবেই আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ইয়েমেন, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সাউথ সুদান, নাইজেরিয়া, কঙ্গো এবং আফগানিস্তানের মতো আগে থেকেই নাজুক অবস্থায় থাকা দেশগুলোর জন্য অনেক বেশি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে উদ্ভব হয়ে করোনা মহামারি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিশ্বে খাদ্যসংকটের বিষয়ে নানাভাবে সতর্ক করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে যেই বিশ্বে অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই ইউক্রেন যুদ্ধ এক ঘোরতর দুঃস্বপ্ন হয়ে হাজির হয়েছে। সরাসরি যুদ্ধে যে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি, তার চেয়ে যুদ্ধের নানামুখী অভিঘাতের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তুলনামূলক সুবিধা নীতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্যতম অ্যাজেন্ডা, এটা বাস্তবায়নের জন্য তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নানা পরামর্শ দেয়। প্রান্তীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের কৃষিজমি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ব্যবহারের বদলে বাজারে যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সেটি উৎপাদনে ব্যবহার করছে। এ কারণে প্রান্তীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে তাদের অনেক জমি ব্যবহার করছে।
এপ্রিলের শেষ ভাগে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জেরে বেড়ে চলা খাদ্যসংকট বিশ্বকে একটি ‘মানবিক বিপর্যয়’-এর মুখে ফেলে দিয়েছে। খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি কোটি কোটি মানুষকে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য এটি একটি রাজনৈতিক সংকটেও পরিণত হচ্ছে; যারা এই সংকট মোকাবিলায় কিছুই করতে পারছে না। এর জন্য তারা দায়ী নয়, অথচ তারা দেখছে দাম বেড়ে চলেছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে যুদ্ধের ফলাফলে খাদ্যপণ্যের দামে বড় ধরনের উল্লম্ফন হতে পারে (৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি), যা গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক বেশি। ওই সাক্ষাৎকারে ডেভিড ম্যালপাস বলেন, পৃথিবীর সবাইকে প্রতিদিন খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত খাবার এখন তাঁদের রয়েছে, বৈশ্বিক খাদ্য মজুতও এখন ঐতিহাসিক মানের বিচারে বড়। কিন্তু এই খাদ্যপণ্য বাঁটোয়ারা বা বিক্রির একটি প্রক্রিয়া থাকতে হবে, যাতে যেখানে খাদ্যের দরকার, সেখানে তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে অনেকে ধারণা করেছিলেন, যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে শেষ হবে। সেটি হয়নি, এ যুদ্ধ তৃতীয় মাসে পড়তে চলেছে। সরাসরি না হলেও বৃহৎ পরিসরে এ যুদ্ধ এখন ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিষেধাজ্ঞার যুদ্ধ (পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার তেল-জ্বালানির নিষেধাজ্ঞা)। এর অনিবার্য ফলাফল হিসেবেই অনেক দেশ নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে খাদ্যশস্য ও ভোজ্যতেলের ওপর রপ্তানি-নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপের দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার যুদ্ধ বাকি বিশ্বে অনেক অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, যার সরাসরি ভুক্তভোগী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কয়েক শ কোটি মানুষ।
যুদ্ধ ও যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংকটের মাত্রা বহুমুখী, কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বা কেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যতটা ব্যতিব্যস্ত, যুদ্ধ থামাতে কিংবা যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকট (খাদ্যসংকট, সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অসন্তোষ) প্রশমনে বাস্তবিক অর্থেই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। খোদ বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টই জানাচ্ছেন, বৈশ্বিক খাদ্য মজুত ঐতিহাসিক বিচারে বড়। তাহলে কেন আড়াই মাসের এক যুদ্ধে পৃথিবীর কয়েক শ কোটি মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা কমে এল? কেন তারা মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে চলেছে?
জরুরি এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ নীতির দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সেটি হলো কম্পারেটিভ অ্যাডভান্টেজ বা তুলনামূলক সুবিধা নীতি। মুক্ত বাণিজ্যের এ নীতির অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির চেয়ে দেশে উৎপাদন করে যেসব পণ্যে বেশি লাভবান হওয়া যায়, সেসব পণ্য দেশেই উৎপাদন করা এবং যেটি কম লাভ দেবে, সে পণ্য প্রতিযোগী দেশে উৎপাদনের জন্য ছেড়ে দেওয়া। তুলনামূলক সুবিধা নীতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্যতম অ্যাজেন্ডা, এটা বাস্তবায়নের জন্য তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে নানা পরামর্শ দেয়। প্রান্তীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো তাদের কৃষিজমি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে ব্যবহারের বদলে বাজারে যে পণ্যের চাহিদা বেশি, সেটি উৎপাদনে ব্যবহার করছে। এ কারণে প্রান্তীয় বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে তাদের অনেক জমি ব্যবহার করছে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো কেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী দেশগুলো সব সময় উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। প্রান্তীয় দেশগুলো খাদ্যশস্যের জন্য কেন্দ্রীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বর্তমান পুঁজিবাদীব্যবস্থা বৈশ্বিক উৎপাদন ও সরবরাহব্যবস্থার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার একটা বৃহৎ শৃঙ্খল। মহামারি ও যুদ্ধের মতো পরিস্থিতি যখন এ শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলে, তখন অনিবার্যভাবেই কোটি কোটি মানুষের জন্য খাদ্যসংকট ডেকে আনছে। ঐতিহাসিক বিচারে সবচেয়ে বড় খাদ্যের মজুত থাকা সত্ত্বেও সেটা ‘পরহস্তের ধনের মতো’ তৃতীয় বিশ্বের কোনো কাজেই আসছে না।
জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত তিন দশকে নাইজেরিয়ায় মাথাপিছু খাদ্যশস্যের উৎপাদন ২০ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে কেনিয়াতেও খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে মাথাপিছু ২০ শতাংশ। নাইজেরিয়া-আফ্রিকার মতো অনেক দেশ তাদের কৃষিজমির একটা বড় অংশে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য জৈব জ্বালানি উৎপাদনকারী ফসল ফলাচ্ছে। এভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের নীতির বিসর্জন যেকোনো দেশের জন্য আত্মহত্যার মতো ব্যাপার হতে পারে, সেটা করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে তুলনামূলক সুবিধা নীতি তৃতীয় বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এ সংকটের দায় কি তারা নিচ্ছে? চলমান সংকট থেকে নতুন কোনো শিক্ষা নেওয়া যাবে?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj.dey@prothomalo.com