খাদ্যরাজনীতিতে কার জয় কার পরাজয়

ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। সেই সংকট তৈরির পেছনেও রয়েছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর রাজনীতি
ছবি: রয়টার্স

গত এক দশকের মধ্যে চলতি মাসে বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের মূল্য সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাবমতে, এপ্রিলের তুলনায় এ মাসে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর গত বছরের মে মাসের তুলনায় এ বছরের মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত খাবারের দাম বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ। তেল, চিনি ও বিভিন্ন দানাদার–জাতীয় খাদ্যের দাম হু হু করে বাজছে। ঢাকার কাঁঠালবাগান বাজার থেকে বার্লিনের সুপারমার্কেট অথবা চিলির সান্তিয়াগোর বাজারগুলোতে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাহিদামতো পাওয়াও যাচ্ছে না। পণ্যের সংকট আছে বাজারে।

সারা বিশ্বেই খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটছে আশঙ্কাজনক হারে। চাইলেই এখন পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পরপরই সারা বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। ইউক্রেনকে বিশ্বের ‘রুটির ঝুড়ি’ বলা হয়। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গম ও সূর্যমুখী চাষ করা হয় ইউক্রেনে। ফলাফল কী হতে পারে, তা জেনেবুঝেই রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করেছে। এ হামলায় রাশিয়ার বেশ কয়েক জেনারেল নিহত হয়েছেন। বিধ্বস্ত রাশিয়ান সাঁজোয়া যান ইউক্রেনজুড়ে ছড়িয়ে আছে।

কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দান ছাড়াও রাশিয়া আরেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু করেছে। খাদ্যসংকট সৃষ্টি করে পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে আনতে চাইছে রাশিয়া। খাদ্যরাজনীতির প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা একেবারেই নতুন কোনো কৌশল নয়। ইতিহাসে অনেক ঘটনাই খাদ্যরাজনীতির উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। অটোমান সম্রাট ফাতিহ মোহাম্মদ দ্বিতীয় কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করে রেখেছিলেন দীর্ঘ সময়। তিনি যে কেবল সমরাস্ত্রের সরবরাহই বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, তা নয়, একই সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। সম্রাট ফাতিহ মোহাম্মদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। অবরোধের একপর্যায়ে তিনি কনস্টান্টিনোপল দখল করে নাম রাখেন ইস্তাম্বুল। আবার এই অটোমানদের পতনে আরেক অবরোধের ভূমিকা ছিল। ইস্তাম্বুল থেকে হিজাজের সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করে অবরোধ করে রেখেছিল আল সৌদরা। ফলে হিজাজে সহজেই অটোমান বাহিনী পরাজিত হয়। আরবে অটোমান শাসনের পতন ঘটে। ব্রিটিশ ও ফরাসিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আল সৌদসহ আরবরা যুদ্ধ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজিত করে।

ক্ষমতার পালাবদল, সাম্রাজ্যের পত্তন ও পতনে খাদ্যরাজনীতি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানেও আমরা খাদ্যরাজনীতি বা কূটনীতির প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি। যুদ্ধ হচ্ছে ইউক্রেনে। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করেছে। আর খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ছে সারা বিশ্বেই।

খাদ্য ও জ্বালানি রাজনীতিতে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যদের থেকে কৌশলগতভাবে এগিয়ে আছে। বিশ্বে সব থেকে বেশি গম উৎপাদিত হয় চীনে। এরপরই ভারত ও রাশিয়ার অবস্থান। বিশ্বের শীর্ষ তিন গম উৎপাদনকারী দেশই একদিকে ঝুঁকে মার্কিনদের বিপরীত অক্ষে অবস্থান করছে। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া থেকে কতটুকু গম রপ্তানি হচ্ছে, এ বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা নেই। এদিকে কোনো কারণ ছাড়াই ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করেছে। আর গম উৎপাদনে ইউক্রেনের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। যুদ্ধের কারণে সেখান থেকেও গম আসছে না। ফলে সারা বিশ্বেই খাদ্যসংকট সৃষ্টিতে রাশিয়া ও তার মিত্ররা সফল হয়েছে।

রাশিয়া ও তার মিত্রদেশ রপ্তানি বন্ধ করলে নিজস্ব আয় কমে যাবে তাদের। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া যুদ্ধাবস্থায় আছে। তাই রাশিয়ায় নানা ধরনের সংকট হবেই। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের চেয়ে অন্য দেশে সংকট সৃষ্টি করা কৌশলগতভাবে রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এতে রাশিয়ার নাক কাটা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা ভঙ্গ হতে পারে। তবে এ কৌশল রাশিয়ার জন্য বুমেরাংও হতে পারে।

আর গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নির্ভরতা সবাই জানেন। চীনের পরই জার্মানিতে ও নেদারল্যান্ডসে সব থেকে বেশি তেল রপ্তানি করে রাশিয়া। এনবিসি নিউজের তথ্যানুসারে যুক্তরাষ্ট্র মোট আমদানির ৮ শতাংশ তেল রাশিয়া থেকে কেনে, যা রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির ৪ শতাংশ। তবে যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষা রাশিয়ার ওপর ইউরোপের জ্বালানি নির্ভরতা বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হিসাবমতে, রাশিয়া থেকে ইউরোপ ৪৯ শতাংশ তেল ও ৭৪ শতাংশ গ্যাস আমদানি করে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক শক্তি খাদ্য ও জ্বালানি তেলের ওপর অনেকাংশেই রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়া ও তার মিত্ররা ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদের বেকায়দায় ফেলতে খাদ্য কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছে। হুট করেই ভারত গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণার পরপর বিভিন্ন দেশের গমের বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতির তথ্য আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখেছি। ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি বৈশ্বিক প্রভাব হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। কৃষ্ণসাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। জাহাজের নিরাপত্তাজনিত ব্যয় ও বিমা খরচ বাড়ছে। যে কারণে কৃষ্ণসাগর দিয়ে আমদানি করা খাদ্যপণ্যের দামও বেড়েছে। বলা যায়, সারা বিশ্বেই ইউক্রেন যুদ্ধের উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে। ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের হিসাবমতে, দেশের ৩৫টি দেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটেছে ১৫ শতাংশের বেশি। কিছু দেশে মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এসব দেশের নাগরিকেরা আয়ের ৫০ শতাংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করছেন।

কিন্তু রাশিয়া ও তার মিত্রদের খাদ্যরাজনীতি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বিপাকে ফেলবে বা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এর প্রভাব কী হবে, এটা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান হতে পারেন। খাদ্যরাজনীতির প্রভাব বুঝতে আমাদের আবার অটোমান সম্রাট ফাতিহ মোহাম্মদের কৌশলের কাছে ফিরে যেতে হবে। ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল ফাতিহ মোহাম্মদ দ্বিতীয় অবরোধ শুরু করেন। ৫৩ দিনের অবরোধকালে একাধিকবার হামলা করেও ফাতিহ মোহাম্মদ কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করতে পারেননি। দুর্ভেদ্য দেয়াল আর গ্রিক ফ্লেয়ার নামের আগুনে অস্ত্রের কারণে কাছেই ভিড়তে পারেনি অটোমানরা। একপর্যায়ে অটোমান সেনা কর্মকর্তারা সম্রাটকে বোঝাতে শুরু করলেন, এভাবে অযথা শক্তি ক্ষয় না করে বরং আরও শক্তি সঞ্চয় করে কিছুদিন পর পুনরায় আক্রমণ করা যেতে পারে। কিন্তু ফাতিহ মোহাম্মদ ছিলেন নাছোড়বান্দা। তিনি তাঁর কৌশলের সফলতা নিয়ে সন্দেহহীন ছিলেন। একপর্যায়ে বাইজান্টাইনরা দুর্বল হতে শুরু করে। তখন চতুর্দিক থেকে হামলা শুরু করেন ফাতিহ মোহাম্মদ। ফাতিহ মোহাম্মদ যখন কনস্টান্টিনোপলে প্রবেশ করেন, তখন বাইজান্টাইনদের বাধা দেওয়ার কোনো শক্তি ছিল। অবশ্যই সমরাস্ত্র ও কৌশলী যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রয়োগ করে ফাতিহ মোহাম্মদ সফল হয়েছিলেন। তাঁর রণ–পরিকল্পনার অন্যতম কৌশল ছিল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে স্বাভাবিক পণ্য সরবরাহ রুদ্ধ করে দেওয়া, যা ফাতিহ মোহাম্মদের কনস্টান্টিনোপলে জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইউক্রেন সংকটে রাশিয়া মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। কিন্তু এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব নয়। রাশিয়ার পক্ষে সব থেকে সহজ ও বাস্তব কৌশল হচ্ছে খাদ্য ও জ্বালানির কূটনীতির আশ্রয় নেওয়া। তেল ও গ্যাস রপ্তানি রাশিয়া বন্ধ করেনি এখনো। মনে হয় না রাশিয়া তেল ও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করবে। তবে রাশিয়া প্রথমেই খাদ্যপণ্য সরবরাহে সংকট তৈরি করেছে। ইউক্রেন থেকে রপ্তানি আটকে দিয়েছে অনেকটাই। ইউক্রেনের বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজে হামলা করে ভীতির সঞ্চার করছে। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার খাদ্য কূটনীতি সফল হয়েছে, যা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার খাদ্যমূল্য নিয়ে প্রতিবেদন দেখলেই বোঝা যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া ও তার মিত্রদেশ রপ্তানি বন্ধ করলে নিজস্ব আয় কমে যাবে তাদের। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া যুদ্ধাবস্থায় আছে। তাই রাশিয়ায় নানা ধরনের সংকট হবেই। কিন্তু রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের চেয়ে অন্য দেশে সংকট সৃষ্টি করা কৌশলগতভাবে রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এতে রাশিয়ার নাক কাটা গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা ভঙ্গ হতে পারে। তবে এ কৌশল রাশিয়ার জন্য বুমেরাংও হতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ তেল ও খাদ্যের মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রীলঙ্কায় তো সরকারই বদল হয়ে গেল। শ্রীলঙ্কার সরকার অনেকটাই রাশিয়া ও চীনের মিত্র বলে পরিচিত ছিল। তবে রাশিয়া যদি নানা ধরনের সংকট তৈরি করে মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য হুমকির মুখে পড়বে। খাদ্যরাজনীতি দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব হবে, যুক্তরাষ্ট্রের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক