শহীদ বুদ্ধিজীবী, হিসাবরক্ষক, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম
কবি ও সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়া। সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ স্কুলজীবন থেকেই।
ভালো গিটারবাদকও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ও তাঁর কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘কালচক্র’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন।
১৯৬৯ সালে এই সংগঠনের একটি সাহিত্য আসরে অতিথি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফ।
ওই বছর একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কালচক্র সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি সাহিত্য সংকলন বের করা হয়। এ সংকলনের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই সমাজসচেতন কবি ও সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়া পরিচিতি পান।
সক্রিয়ভাবে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন আন্দোলনে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়া একাত্তরে কর্মরত ছিলেন তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (পরে শেরাটন ও রূপসী বাংলা হোটেল) কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস পদে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য এপ্রিলে ভারতে যান। পরে আগরতলার ইন্দ্রনগরে প্রশিক্ষণ নেন।
প্রশিক্ষণ শেষে যুক্ত হন মুক্তিবাহিনীর ৪ নম্বর সেক্টরের জালালপুর সাবসেক্টরে।
কিছুদিন পর তাঁকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এই দলের অধীনে ছিলেন ৪৮ জন মুক্তিযোদ্ধা। সিলেটের জালালপুর নামক স্থানে ছিল তাঁদের ঘাঁটি।
৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর মুক্তিযোদ্ধা দলের একটানা কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ হয়।
সেদিন তাঁরা প্রথমে আটগ্রাম সড়কের একটি সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেন। এ সময় সেতুর কাছাকাছি অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দল তাঁদের আক্রমণ করে।
তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। থেমে থেমে দুই পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে।
১০ ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধা দলের গোলাবারুদ নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন তিনি তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসারণের নির্দেশ দেন।
খাজা নিজামউদ্দীন সহযোদ্ধাদের পশ্চাদপসারণের নির্দেশ দিয়ে একাই শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসারণ নিরাপদ করার জন্যই তিনি একা রয়ে যান তাঁর অবস্থানে। একটু পর তাঁর হাতে গুলি লাগে।
গুলিবিদ্ধ হয়েও তিনি তাঁর অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারেননি।
এ সময় তাঁর বুকে ও মাথায় গুলি লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
সেদিন সম্মুখসমরে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়া। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদলেরও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
পরে সেনাদলটি ওই এলাকা থেকে চলে যায়। তখন সহযোদ্ধারা এলাকাবাসীর সহায়তায় তাঁর মরদেহ উদ্ধার করেন।
ঘটনাস্থলের কাছেই তিনজন পীর হজরত পাতা শাহ (রা.), গুলশাহ (রা.) ও নীল শাহ (রা.)-এর কবর রয়েছে।
তাঁদের কবরের পাশেই খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়াকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর সমাধি সংরক্ষিত।
শহীদ হওয়ার আগে খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়া মস্তানগঞ্জ, ভরাসইদ, নজিপাড়া, মণিপুর বাজারসহ আরও কয়েক স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তাঁর সাহসিকতায় সহযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হতেন।
খাজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়ার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লায়। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া থানার মালোপাড়া গ্রামে।
বাবা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া, মা তাবেন্দা বেগম। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুমিল্লা শহরের গিরিধারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
বাবার সরকারি চাকরি সূত্রে তাঁকে দেশের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করতে হয়েছে।
১৯৬৪ সালে চট্টগ্রামের জে এম সেন ইনস্টিটিউট থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক; ১৯৬৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক (বাণিজ্য) পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এখান থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সম্মান (১৯৬৯) ও স্নাতকোত্তর (১৯৭০) শিক্ষা সম্পন্ন করে একাত্তরের জানুয়ারিতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চাকরি নেন।
খাঁজা নিজামউদ্দীন ভূঁইয়ার স্মরণে স্বাধীনতার পর কানাইঘাট এলাকাবাসী কয়েকটি স্থানের নাম নিজামনগর নামকরণ করেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের কান্দিরপাড় থেকে পুলিশ লাইন পর্যন্ত সড়কটি তাঁর নামে নামাঙ্কিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের স্মৃতিস্তম্ভে তাঁর নাম ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের মূল ভবনের সামনে তাঁর স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে।
তিনি অবিবাহিত ছিলেন।
সূত্র: একাত্তরের বীরযোদ্ধা, প্রথম খণ্ড, সম্পাদনা মতিউর রহমান, প্রকাশ ২০১৩ ও
স্মৃতি: ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা রশীদ হায়দার, প্রকাশ ১৯৮৯। প্রতিকৃতি: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট (ষষ্ঠ পর্যায়) প্রকাশ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা (১৯৯৭) থেকে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান।
rashedtr@prothom-alo.info