বিচার প্রভাবিত হতে পারে অথবা আদালতকে কলঙ্কিত করা হয়—এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুমোদন করে না। বাংলাদেশে অস্বাভাবিক দ্রুততায় সংবাদমাধ্যম নাটকীয় বিকাশ লাভ করায় অনেক বার্তাকক্ষেই যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে এসব নীতিমালার বিষয়ে যত্নশীল না হওয়ার ঝুঁকি অনেক বার্তাকক্ষেই রয়ে গেছে। বিচারাধীন মামলার খবর প্রচারের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও অভিযোগকারী—উভয়েরই যে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সমান, সেটি বিবেচনায় না নিয়ে খবর প্রচারের মতো দায়িত্বহীনতার ঘটনা যে একেবারে ঘটে না, সে কথা বলা যাবে না।
এ রকম পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট ১৬ মে বিচারাধীন মামলার বিষয়ে নির্দেশনা জারির যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু বিভ্রাট ঘটেছে জারি করা নির্দেশনায় অস্পষ্টতার কারণে। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানীর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে কোনো কোনো ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের চ্যানেলে এবং কোনো কোনো প্রিন্ট মিডিয়া তাদের পত্রিকায় বিচারাধীন মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন/স্ক্রল করছে, যা একেবারেই অনভিপ্রেত। এমতাবস্থায় বিচারাধীন কোনো বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন/স্ক্রল করা হতে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এই বিজ্ঞপ্তিতে ধারণা তৈরি হয় যে কোনো বিচারাধীন মামলার বিষয়েই সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। তা সে খাদ্যে ভেজাল, ওয়াসার পানির বিশুদ্ধতা বা ঢাকার বাতাসের মান–সম্পর্কিত বিষয়ের জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাই হোক, কিংবা দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিক বা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের শুনানিই হোক। সোজা কথায় মনে হতে পারে যে আদালতের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অন্য কোনো খবর প্রচার করা যাবে না।
যেকোনো মামলার বিচারিক কার্যক্রম দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত উন্মুক্ত আদালতেই হয়ে থাকে। যুগের পর যুগ ধরে উন্মুক্ত আদালতের কার্যবিবরণী সংবাদপত্রে ছাপা হয়ে আসছে।
আমি পুরাতন জেলখানার ভেতরে স্থাপিত আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আমার অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারি, যেখানে খবর পরিবেশনে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সামরিক আদালত উন্মুক্ত না হলেও সে ধরনের আদালতে অনুষ্ঠিত বিচারের খবরও আইনজীবীদের বরাতে প্রকাশিত হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথাও এখানে স্মরণ করা যায়। একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচারে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের কথাও উল্লেখ করা যায়। এসব মামলায় বিপুল জন-আগ্রহ পূরণে সংবাদমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আমাদের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন কিছুদিন আগেই সাংবাদিকদের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘মানুষ এখন কোর্টের সংবাদ জানতে চায়, দিনে দিনে তাদের আগ্রহ বাড়ছে।’ ২৬ সেপ্টেম্বর ‘লিগ্যাল এইড ও আইন সাংবাদিকতা’বিষয়ক এক কর্মশালায় তিনি আশ্বাস দেন যে সাংবাদিকেরা যাতে হাইকোর্টের সব বেঞ্চে প্রবেশ করতে পারেন, সে বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ নেবেন। এরপর গত ৫ ফেব্রুয়ারি আইনে তারুণ্য শীর্ষক এক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আইন-আদালত, আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার ও আইনি সেবাসংক্রান্ত তথ্য সাংবাদিকতার মাধ্যমে উঠে আসে। সাংবাদিকেরা সাধারণ জনগণ তথা বিচারপ্রার্থী জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ফলে আইন অঙ্গনের সঙ্গে সাংবাদিকতার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিষ্ট।’
উন্মুক্ত বিচারব্যবস্থার প্রতি প্রধান বিচারপতির এই অঙ্গীকারের মর্যাদার স্বার্থেই ১৬ মে সুপ্রিম কোর্টের জারি করা বিজ্ঞপ্তির অস্পষ্টতা দূর করা প্রয়োজন। আশা করি, আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সেই ব্যাখ্যা দেবেন। বিকল্প হিসেবে অবশ্য ল রিপোর্টার্স ফোরাম, সাংবাদিক ইউনিয়ন কিংবা সম্পাদক পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠানও উদ্যোগী হয়ে আদালতের কাছে এই আদেশের অস্পষ্টতা দূর করার আবেদন জানাতে পারে। ইতিমধ্যে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিজ্ঞপ্তিটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বিবৃতিই শেষ কথা নয়। আদালতের রীতি অনুযায়ী আইনজীবীদের সহায়তা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যাতে করে অবাধে আদালতের কার্যক্রম ও বিভিন্ন মামলার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ ও দায়িত্বশীলভাবে সংবাদ প্রকাশের অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন না হয়।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি আরও বলেছিলেন যে ‘একটি গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে সংবাদমাধ্যমের অনুপস্থিতির কথা ভাবাই যায় না।’ এই সর্বসাম্প্রতিক বিজ্ঞপ্তিতে বিচারাধীন মামলার সংবাদ প্রকাশের ওপর ঢালাও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে যে ধারণা তৈরি হয়, তা জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। মাত্র ৩ মে সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন রিপোর্টাস স্য ফ্রঁতিয়ে, আরএসএফ-এর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের লক্ষণীয় অবনতির কথা বলা হয়েছে। দেশে গণতন্ত্রের যেসব ঘাটতি প্রকট হয়ে উঠেছে, তাতে বিভ্রম সৃষ্টি হতে পারে যে আদালতের খবরাখবর প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপেও সরকারের ভূমিকা থাকতে পারে। সম্প্রতি জনস্বার্থবিষয়ক বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালতের বিভিন্ন আদেশে সুশাসনের যেসব ঘাটতির বিষয় উঠে এসেছে, তার পটভূমিতে জনমনে এমন ধারণা তৈরি হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এই আদেশ তাই আদালতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষুণ্ন করবে বলেই আমাদের আশঙ্কা।
আমরা জানি, সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে আদালত অবমাননার আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর থেকে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে আছে। তার ওপর এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে সাধারণ মানুষ আদালতের খবর থেকে বঞ্চিত হবে। আমরা আশাবাদী হতে চাই যে আদালত বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে অচিরেই তা নিরসনের উদ্যোগ নেবেন। কোনো মামলার অস্বাভাবিক রায়, অথবা কোনো প্রকাশ্য আদালতের কার্যক্রমের বিবরণ প্রকাশে আদালতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে—এমন বিবেচনায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তা আনুপাতিকভাবে সংগতিপূর্ণ হওয়ার কথা। যদিও অতীতে তার অনেক ব্যত্যয় ঘটেছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অনাকাঙ্ক্ষিত বিদায়কালের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। অবশ্য এ কথাও অনস্বীকার্য যে স্বচ্ছতা এবং খোলামেলা কার্যক্রমই বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে সমুজ্জ্বল করে থাকে। ভারতের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা সেই সাক্ষ্যই বহন করে। দেশটির প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠায় সুপ্রিম কোর্টে যে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম হয়, তার সংবাদ প্রচারে দেশটির আদালত কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেননি। আমাদের আদালত বিচারিক নজির হিসেবে ভারতীয় আদালতের ভূরি ভূরি সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে থাকেন। আশা করি, সংবাদমাধ্যমের অধিকারের প্রশ্নেও তাঁরা সেই নজির অনুসরণ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখে পড়বেন না।