ঢাকার উত্তরা মডেল টাউনের ১২ নম্বর সেক্টরে ঢোকার মুখের ময়লার মোড় পেরিয়ে দিয়াবাড়ির দিকে যেতে একটি বহুতল ভবনের নিচতলার গ্যারেজ বড় করে একটি পাটপণ্যের কারখানায় রূপান্তর করা হয়েছে। এর উদ্যোক্তা ইশরাত জাহান চৌধুরী কয়েক বছর ধরে নিজের ডিজাইনের পাটপণ্য রপ্তানি করছেন দেশের বাইরে। ‘তুলিকা’ নামে প্রতিষ্ঠানটির পণ্য ইতালি, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইডেনে রপ্তানি হয়েছে। করোনাকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরাত জাহানের বিদেশের অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়। দেশের বাজারের জন্য পণ্য তৈরির চেষ্টা করছেন তিনি। ব্যয় সংকোচনের জন্য কারখানা আরও ভেতরের দিকে, কম ভাড়ায় স্থানান্তরের কথা ভাবতে হচ্ছে তাঁকে।
আরিফুল ইসলাম প্রায় এক যুগ কাজ করেছেন রিয়েল এস্টেট শিল্পে। দীর্ঘদিনের প্রস্তুতির পর উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন গত বছরের শেষে। কিন্তু বিধি বাম হলো করোনায়। বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা বদল করে ভেবেছেন, কীভাবে করোনাকালে মানুষের সেবা ও ব্যবসা—দুটোই করা যায়। দেখলেন, মাস্কের ফিতা দুটো চেপে বসে কানের ওপর। যঁারা চশমা পরেন, তঁাদের জন্য বাড়তি চাপ। চিন্তাভাবনা করে উদ্ভাবন করলেন ইয়ার সেভার, মানে কান বাঁচানোর উপায়। চামড়া কিংবা ইলাস্টিকের ছোট একটি টুকরা চমৎকার করে আপনার মাস্ককে ধরে রাখবে, কানকে বাঁচিয়ে। মাত্র শুরু করেছেন বলে ব্যাংক তাঁকে উদ্যোক্তা হিসেবে চেনে না। পুঁজির অভাবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা বড় করতে পারছেন না আরিফুল।
নরসিংদীতে নিজস্ব ফুড-গ্রেইন প্লাস্টিক সামগ্রীর কারখানা ২০১৮ সালের জাতীয় এসএমই পুরস্কার বিজয়ী মুহম্মদ গাজী তৌহিদুর রহমানের। করোনাকালের শুরুতে উদ্যোগ নিয়ে কারখানার একটি অংশকে সার্জিক্যাল ও মাল্টিলেয়ার মাস্ক বানানোর কারখানায় রূপান্তর করেছেন। তবে সবটুকু নিজে না করে লুপিং, ফিটিংয়ের কাজটা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন, যাতে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও এই সময়ে টিকে থাকতে পারেন। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই এ জন্য প্রয়োজনীয় সামান্য মূলধনও জোগাড় করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন গাজী তৌহিদুর রহমান।
ইশরাত, আরিফুল কিংবা গাজী তৌহিদুরের মতো প্রায় ৭৬ লাখ কুটিরশিল্প, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) শিল্পোদ্যোক্তা নিজেদের উদ্যোক্তাকালের সবচেয়ে কঠিন সময়টি পার করছেন। গত ২৬ জুলাই উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্প ও প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিবি) সভাপতি মির্জা নূরুল গণি শোভন জানান, এগুলোর মধ্যে ৬০ শতাংশ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দেড় কোটি থেকে দুই কোটি লোক বেকার হয়ে পড়েছেন এবং তঁাদের জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসছে।
অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দফায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এসএমই খাতের জন্য স্বল্প সুদে ২০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দও এতে রয়েছে। তবে এই প্রণোদনা ঋণ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যাংকিং নিয়মকানুন মেনেই এই ঋণ বিতরণে বিশ্বাসী। কিন্তু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকেই নগদ লেনদেনে অভ্যস্ত এবং এদের বেশির ভাগই অতীতে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেননি। তাদের প্রতি বাড়তি কোনো মনোযোগ ব্যাংকের নেই বললেই চলে, যার ছাপ পড়েছে ঋণ বিতরণে। ওই একই ওয়েবিনারে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এই খাতে মাত্র ১০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে (বরাদ্দের ১ শতাংশের কম)। এই ঋণ বিতরণ হয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই জটিল সময়ে টিকিয়ে রাখতে কতটা কার্যকর হবে, সেটা বলা মুশকিল। যদিও অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক সিএমএসএমইদের ঋণসহায়তা সহজ করতে একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করেছে। ব্যাংক কিংবা ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিতরণকৃত ঋণের লোকসানের আংশিক দায়ভার বহন করবে এই স্কিম। এই স্কিমও শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হয়ে উঠবে, সেটা সময়েই বলবে।
কিন্তু এই করোনাকালে আমাদের অর্থনীতির এই বড় শক্তি সিএমএসএমইকে টিকিয়ে রাখার জন্য আরও অনেক উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ৪ আগস্ট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এনজেল ও ভেঞ্চার বিনিয়োগকারীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এসবিকে টেক ভেঞ্চারসের উদ্যোক্তা সোনিয়া বশির কবীর। কমবেশি ৪০টি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জানান, তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ রয়েছে এবং তারা নানাভাবে চেষ্টা করছে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগে তাদের আগ্রহ অনেক। কিন্তু ধারণা পর্যায়ে এবং বেড়ে ওঠার সময়ে তাদের জন্য যত সহায়তা দেওয়া দরকার, তার সামান্যই মাত্র দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি মনে করেন এই সময়ে সব উদ্যোক্তাকে টিকে থাকার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে স্বাচ্ছন্দ্য ও দক্ষ হয়ে ওঠার প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বর্তমান অতিমারিকাল অতিক্রম করার জন্য তাই কেবল ঋণসহায়তা যথেষ্ট নয়। তাদের আসলে দরকার অনুদান এবং তা প্রাপ্তির সহজ নিয়ম।
বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার এই খাতে
২ কোটি পাউন্ডের (২০০ কোটি টাকার বেশি) একটি তহবিল গঠন করেছেন। এ থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ১ হাজার থেকে ৫ হাজার পাউন্ড (১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার বেশি) পর্যন্ত অনুদান পাবেন, যা দিয়ে তঁারা নিজেদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিস্থিতি সামাল দেওয়া এবং প্রয়োজনে পরামর্শক নিয়োগ করতে পারবেন। একই ধরনের ছোট একটি তহবিল (১০০ কোটি টাকা দিয়ে শুরু করা যায়) আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যাবে। এসএমই ফাউন্ডেশন, কর্মসংস্থান ব্যাংক এই কাজে নেতৃত্ব দিতে পারে। তবে সারা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার তালিকায় থাকতে হবে।
এই অনুদান তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অতিমারিকালে টিকে থাকার সত্যিকারের প্রেরণা হয়ে উঠবে।
মুনির হাসান: প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও ইভেন্টপ্রধান