সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ ও বিএনপির সমর্থক ছাত্রদলের মধ্যে যে সংঘর্ষ হলো, তাকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতারা আদর্শের লড়াই বলে আত্মপ্রসাদ নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ছাত্রদলকে পিটুনি দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নাকি ছাত্রলীগের সাহসের তারিফও করেছেন। যখন শিক্ষাঙ্গন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, সচিবালয় থেকে জাতীয় সংসদ—সবই আওয়ামী লীগের কবজায়, তখন ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি কিংবা ছাত্রদলকে নিয়ে সরকারের এত ভয় কেন?
ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সংঘাত নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ থাকলেও শিক্ষকেরা পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বিএনপির সমর্থক সাদা দলের শিক্ষকেরা ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন। এর এক দিন পরই আওয়ামী লীগের সমর্থক নীল দলের শিক্ষকেরা পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিচক্র নতুন করে সক্রিয় হয়েছে।’ কারও মতের সঙ্গে না মিললে আগে রাজনীতিকেরা একে অপরকে খুনি, ষড়যন্ত্রকারী বলে গালমন্দ করতেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও সেই ভূমিকায় নেমেছেন।
তর্কের খাতিরে যদি আমরা মেনেও নিই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের সংঘাতের পেছনে নীতি-আদর্শের একটা বিষয় আছে। কিন্তু গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মারামারি ও অবরোধের ঘটনা ঘটল, তার ব্যাখ্যা কী? গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধর করেছেন যুবলীগের স্থানীয় নেতা মো. হানিফ ও তাঁর অনুসারীরা। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে বুধবার মূল ফটকে তালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক দেয় ছাত্রলীগের ভিএক্স গ্রুপ। ওই দিন ক্যাম্পাস থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি শহরে। শহর থেকে ক্যাম্পাসে আসেনি কোনো শাটল ট্রেন। মারধরের শিকার ছাত্রলীগ নেতারা হলেন ভিএক্স গ্রুপের নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী ও সাবেক সহসভাপতি রাশেদ হোসাইন। অভিযুক্ত স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. হানিফ।
প্রদীপ চক্রবর্তীর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘রাত সাড়ে তিনটার দিকে আমরা মোটরবাইকে করে ১ নম্বর গেট থেকে ক্যাম্পাসের দিকে যাচ্ছিলাম। পথের মধ্যে স্থানীয় যুবলীগ নেতা হানিফ ও তাঁর অনুসারীরা আমাদের ওপর রামদা, লাঠিসোঁটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালান। আমরা দুজন দুই দিকে পালিয়ে যাই। এ সময় আমাদের দিকে গুলিও ছোড়া হয়, আর ভেঙে ফেলা হয় আমাদের মোটরবাইক।’
অতীতে আওয়ামী লীগ তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে একঘরে করে দু–দুবার আন্দোলনে সফল হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের সেই পুরোনো কৌশল নিয়ে কতটা সফল হবে, বলা কঠিন। প্রথমত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তারা ভাঙতে পারবে কি না। দ্বিতীয়ত ভাঙতে পারলেও তা শক্তির ভারসাম্য আনতে সক্ষম হবে কি না। রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই; রাজনীতিবহির্ভূত শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতিকে।
এখানে আদর্শের দ্বন্দ্ব কোথায়? উল্লেখ করা প্রয়োজন যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে ১১টি উপ-গ্রুপ আছে। এর মধ্যে ৯টি সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী এবং দুটি শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সমর্থক। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিরোধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সাধারণ শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনাও ঘটেছে।
কয়েক দিন আগে চট্টগ্রামে যুবলীগের সম্মেলনে যুবলীগ সভাপতির উপস্থিতিতে শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সাবেক মেয়রের পক্ষে থেমে থেমে স্লোগান ওঠে। চট্টগ্রামের এক নেতা বিরক্ত হয়ে বলেন, ব্যক্তিবিশেষের নামে কোনো স্লোগান দেওয়া যাবে না। এ স্লোগানের পেছনে নীতি ও আদর্শের দ্বন্দ্ব নেই। আছে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা।
তৃতীয় অঘটনটি ঘটেছে ঝিনাইদহের পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সেখানেও যুদ্ধটা মূলত নৌকা আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগের। আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ঝিনাইদহ পৌরসভার আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল খালেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, ‘মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল খালেকের শোভাযাত্রা থেকে গত ১৮ মে প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. কাইয়ুম শাহরিয়ারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর এবং তাঁর প্রচারাভিযানে বাধা দেওয়া হয়। আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ব্যাখ্যা চাওয়ার পর তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ভবিষ্যতে আচরণবিধি মেনে চলবেন বলে অঙ্গীকার করেন। এরপর ২৯ মে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খানের সামনে সব প্রার্থী আচরণবিধি মেনে চলার বিষয়ে মৌখিক অঙ্গীকার করেন। কিন্তু এরপরও আবদুল খালেকের সমর্থকেরা ১ জুন কাইয়ুম শাহরিয়ার ও তাঁর সমর্থকদের আক্রমণ করে আহত করেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। নির্বাচন কমিশন এ ঘটনা তদন্ত করে সত্যতা পায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা ২০১৫-এর বিধান লঙ্ঘনের দায়ে আবদুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করে।’
ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। অংশ নেয়নি জাতীয় পার্টিও। চার প্রার্থীর মধ্যে আবদুল খালেক নৌকা নিয়ে লড়ছিলেন। এর বাইরে হাতপাখা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইসলামী আন্দোলনের সিরাজুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুম শাহরিয়ার ও মিজানুর রহমান। স্বতন্ত্র প্রার্থী কাইয়ুম জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাসের শাহরিয়ার জেহাদীর ভাই। নাসেরের কর্মী-সমর্থকেরা কাইয়ুমের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী তাঁর সমর্থকদের নিয়ে মাঠে নামেন। অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী বা হাতপাখা প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখেননি নৌকার প্রার্থী। এ কারণেই কাইয়ুম হন নৌকা প্রার্থীর টার্গেট। নির্বাচন কমিশন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, একটি পৌরসভার বিষয়ে তঁারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনে সেটি নিতে পারবেন কি না?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নীতি–আদর্শের ফারাক খুবই কম। একদা নকশাল যেমন মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধা করেনি, তেমনি কট্টর আওয়ামী লীগ নেতার ঘোরতর বিএনপি হতেও বাধেনি। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কিংবা ওবায়দুর রহমান বাকশালের বিরোধিতা করেননি। বিরোধিতা করেছিলেন জাতীয় সংসদের দুজন সদস্য—এম এ জি ওসমানী ও মইনুল হোসেন।
স্বাধীনতার পর মুজিববাদ শব্দটি চালু করেছিলেন সিরাজুল আলম খানই। কিন্তু জাসদ করার পর ওই শব্দ তাঁরা আর ব্যবহার করেননি। পঁচাত্তরের আগে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাসদ। এখন সেই জাসদ কয়েক ভাগে বিভক্ত—কেউ আওয়ামী লীগ ও কেউ বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগ ছিল বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। জিয়ার সরকার আওয়ামী লীগ ভাঙারও চেষ্টা করেছে। বিরাশিতে বিএনপিকে হটিয়ে এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। বিএনপিকে কোণঠাসা করতে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের ওপর ভর করেন। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম, জামায়াতসহ সব দল এরশাদকে হটানোর আন্দোলনে নামে এবং সফল হয়। একানব্বইয়ের নির্বাচনে বিএনপির জয় ও আওয়ামী লীগের পরাজয় ছিল অভাবিত। বিএনপি সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে আওয়ামী লীগ শুরু থেকে সুযোগ খুঁজতে থাকে। মাগুরা উপনির্বাচন সেই সুযোগ এনেও দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে একঘরে করে ফেলে এবং দাবি আদায় করে ছাড়ে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত মিলে আন্দোলন করে। শেষ পর্যন্ত এরশাদ চারদলীয় জোটে না থাকলেও দলের একাংশ বিএনপির সঙ্গেই থেকে যায় এবং ২০০১ সালে তারা বিপুল ভোটে জয়ী হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঘটে এর উল্টো। আওয়ামী লীগ রেকর্ডসংখ্যক আসনে জয়ী হয়।
অতীতে আওয়ামী লীগ তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে একঘরে করে দু–দুবার আন্দোলনে সফল হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের সেই পুরোনো কৌশল নিয়ে কতটা সফল হবে, বলা কঠিন। প্রথমত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে তারা ভাঙতে পারবে কি না। দ্বিতীয়ত ভাঙতে পারলেও তা শক্তির ভারসাম্য আনতে সক্ষম হবে কি না। রাজনীতি এখন আর রাজনীতিকদের হাতে নেই; রাজনীতিবহির্ভূত শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতিকে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com