ক্ষত যত ক্ষতি যত

এই কথা প্রকাশ থাকুক যে এবারের পয়লা বৈশাখে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে শুধু নারীরা নন, লাঞ্ছিত হয়েছে এই দেশ, লাঞ্ছিত হয়েছে পুরুষ প্রজাতি। মনে পড়ছে, ২০০০ সালে নতুন শতাব্দী উদ্যাপনের সেই রাতে এমন এক ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছিলাম, লিখেছিলেন আরও অনেকে, বন্ধুবর চিত্রকর ঢালী আল মামুন এঁকেছিল মর্মস্পর্শী এক পেইন্টিং। কিন্তু শিল্পীর তুলি, লেখকের কলম আর কতটুকু ঠেকাতে পারে পতন? এবার সে ঘটনা ঘটেছে আরও বহুগুণ মাত্রায়। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না বহিরাগত, তারা কি একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য? এসব তর্ক চলছে। তবে একটা বিষয় তর্কাতীত যে যারা ব্যাপারটা ঘটিয়েছে তারা সবাই পুরুষ। এক বিশেষ ধরনের পুরুষ। বিষয় নেহাত শ্লীলতা, অশ্লীলতার নয়, বিষয় আরও গভীর।
সমাজবিজ্ঞানে একটা ধারণা আছে ‘সেক্সুয়াল ইন্টারঅ্যাকশন কম্পিটেন্সি’ বলে। এই ধারণায় ঠিক যৌন আচরণ অর্থে নয়, বৃহত্তর অর্থে বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে সুস্থ আচরণের ক্ষমতাকে বোঝানো হয়। বলা হয়, যেভাবে অক্ষরজ্ঞান শিখতে হয়, কম্পিউটার শিখতে হয় সেভাবে, কোনো বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মোকাবিলারও একটা শিক্ষা আছে। সে শিক্ষা পরোক্ষভাবে পরিবার থেকে আসে, পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া রুচিবোধ, নীতিবোধ থেকে আসে, আসে ধর্মবোধ থেকেও। অনেক ক্ষেত্রে এই বিষয়ের ওপর প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও তা অর্জন করার ব্যবস্থা করা হয়। যেসব পুরুষের কোনো সূত্র থেকেই সেই শিক্ষাটা আসে না, তারা পরিণত হয় প্রবৃত্তিসর্বস্ব, লিঙ্গসর্বস্ব এক একটা বেকুব জন্তুতে। পয়লা বৈশাখে টিএসসির মোড়ে জড়ো হয়েছিল তেমন কিছু বেকুব জন্তু। নানা ভিড়ভাট্টায় এই সব জন্তু যে চোরাগোপ্তা থাকে, তা সুবিদিত। জন্তুরা সচরাচর ভীত থাকে, আড়ালে থাকে কিন্তু এবারের পয়লা বৈশাখের ঘটনায় যা অভিনব তা হচ্ছে সেই সব বীভৎস জীব তাদের গুহা থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্যে বাদ্য বাজিয়ে, বিপুল জনসমাগমে তাদের পশুত্বের প্রদর্শনী করেছে।
এ ঘটনা আমাদের আরও বড় প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়। এই যে এরা প্রায় ঘণ্টাজুড়ে জনসমক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যেতে পারল, সেই পারার সাহস এবং আস্থার উৎসটা কোথায়? সাহসের উৎস কি এই বিশ্বাস যে জনসমক্ষে যত বর্বরতাই ঘটুক সাধারণ মানুষ তাতে বাধা দিতে আসবে না? তার প্রমাণ তো আছে কিছুকাল আগে ঘটে যাওয়া অভিজিৎ হত্যার সময়েই। সাধারণ মানুষ শুধু নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও থাকবে নিষ্ক্রিয়, এই আস্থাও কি ছিল তাদের? যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা যদি এলাকায় বহিরাগত হয়ে থাকে তাহলে এসব বিশ্বাস, আস্থা তাদের এমন ঘৃণ্য কাজ করার সাহস জোগানোর কথা।
আর তারা যদি ক্যাম্পাসের ভেতরেরই হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে সেই সাহসের জোরটা তো হওয়ার কথা আরও বেশি। কিংবা ব্যাপারটা কি এমন যে কোনো এক গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এই পাশবিকতা ঘটিয়েছে পয়লা বৈশাখের প্রেরণাকে ধ্বংস করার জন্য? সেটা অসম্ভব নয়, কারণ বৈশাখী মেলায় বোমা ফাটিয়ে মানুষ হত্যার মতো বীভৎস নৃশংসতার মাধ্যমে এমন চেষ্টা অতীতে হয়েছে। আমরা এও লক্ষ করছি যে দেশের ভেতর একটা সাংস্কৃতিক মেরুকরণ চলছে কিছুকাল। মেয়েরা তাদের পোশাক, আচরণ ইত্যাদি দিয়ে পুরুষদের বর্বর আচরণে প্ররোচিত করে—এমন কুযুক্তি দেওয়ার মানুষও এ দেশে কম নেই। ফলে নারীর ওপর এই আক্রমণ একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির বার্তা পৌঁছানোর উদ্যোগও হতে পারে। এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের পেতে হবে। লিঙ্গ রাজনীতি কী করে আরও বৃহত্তর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।
মনস্তাত্ত্বিকেরা এও দেখিয়েছেন সংঘবদ্ধভাবে নারীর ওপর পুরুষের এই ধরনের আক্রমণের পেছনে যৌন তৃপ্তি নয়, বরং আছে শক্তি প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা। একজনকে দুর্বল অবস্থানে কোণঠাসা করে এ ধরনের শক্তি প্রদর্শনের ভেতর আছে সীমাহীন দেউলিয়াপনা, কাঙালপনা, হীনম্মন্যতা। ভাবনার ব্যাপার এই যে আমাদের এই সমাজ, পরিবার এমন হীন দেউলিয়া, জঘন্য পুরুষদের বেড়ে উঠতে সুযোগ দিয়েছে আর সেই সঙ্গে বেদনার এই যে, আমাদের রাষ্ট্র এই জন্তু পুরুষদের হাত থেকে নারীদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি।
কিন্তু পয়লা বৈশাখের এই বর্বরতা এই অনুষ্ঠানের প্রেরণাকে বন্ধ করবে, নারীদের শঙ্কাহীন চলাচলকে রুদ্ধ করবে—এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বৈশাখী মেলায় বোমা বিস্ফোরণও মানুষের ঢলকে কিছুমাত্র কমায়নি। লিঙ্গান্ধ জান্তব পুরুষদের হাত থেকে বিপন্ন নারীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে মানবিক পুরুষই। লেখিকা পুরবী বসু তাঁর এক লেখায় প্রত্যাশা করেছেন যে তরুণ তাঁর পাঞ্জাবিতে ঢেকে দিয়েছেন নারীর অপমান, সেই পাঞ্জাবি হয়ে উঠুক অন্তহীন। সেই সঙ্গে আমি বরং সেই সমাজ প্রত্যাশা করব, যেখানে কোনো পুরুষ রক্ষাকর্তার পাঞ্জাবির মুখাপেক্ষী না হয়ে নারী নিজেই তার আত্মমর্যাদা রক্ষা করার অধিকারী হবে। পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য আমাদের সবার। সবাই মিলে এর মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।
সেই কত কাল আগে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘পুরুষেরা, যাহারা নানা প্রকার দুষ্টামি করে বা করিতে সক্ষম, তাহারা দিব্য স্বাধীনতা ভোগ করে, আর নিরীহ কোমলাঙ্গী অবলারা বন্দী থাকে। অশিক্ষিত, অমার্জিত রুচি পুরুষেরা বিনা শৃঙ্খলে থাকিবার উপযুক্ত নহে। আপনারা কিরূপে তাহাদিগকে মুক্তি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন?’
এই অশিক্ষিত, অমার্জিত রুচি পুরুষদের অতিসত্বর বন্দী করবার গণদাবির প্রতি জানাই নিরঙ্কুশ সমর্থন।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com