জাতীয়করণকৃত কলেজের শিক্ষকদের শেষমেশ ক্যাডার মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না, ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ স্লোগানে আন্দোলনকারীদের জয় হলো! এমনিতেই আমরা জানি, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মানে শিক্ষকেরা নানাভাবে প্রশাসন ক্যাডারের হাতে নাজেহাল হন, এমনকি একজন কলেজশিক্ষককে কয়েক বছর আগে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্যও করা হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের এভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে যাওয়াটা কাম্য নয়। তাঁদের কি শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার নয়? তার সঙ্গে আন্ত-ক্যাডার পার্থক্য ঘোচানোর?
ব্যাপারটা হলো শিক্ষকেরা আমাদের সমাজে এখনো এক অবহেলিত সম্প্রদায়। একসময় সমাজে তাঁদের কিছু সম্মান থাকলেও বর্তমানে নানা কারণে সেটাও খুব একটা অবশিষ্ট নেই। আর এটা এমন এক দেশ, যেখানে শিক্ষকদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়নে রাস্তায় নামতে হয়। শুধু তা-ই নয়, এই পোড়া দেশে আন্দোলনরত শিক্ষকদের চোখেমুখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়। অথচ যে পুলিশ সদস্য এ কাজ করেছেন, তাঁর মতো অনেককেই এই শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন।
দেশের এই অবহেলিত শিক্ষকসমাজের মধ্যেও সরকারি-বেসরকারি ভাগ রয়েছে। এখন তো আমরা আবার ক্যাডার-নন ক্যাডার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। তার মানে বোঝা যায়, আমাদের সরকারি শিক্ষকসমাজ নিজেদের বৃহত্তর অর্থে শিক্ষক মনে করার চেয়ে মর্যাদাবান ক্যাডার সার্ভিসের চাকুরে মনে করেন। তবে এটা ঠিক, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে যাঁরা সরকারি কলেজে চাকরি পান, তাঁদের অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আসতে হয়। কিন্তু সবাই তো আর সরকারি কলেজে চাকরির সুযোগ পাবেন না। সরকারি কলেজে যাঁরা চাকরি পান, তাঁদের সমান মেধার অনেকেই সে সুযোগ পান না। সবার কথা বলছি না, অনেকের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য। আর জাতীয়করণ করা হলে তো তাদের সময়-সময় বিভাগীয় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। তাই এমন বিধি করা যেতে পারে যে ওই সব পরীক্ষায় নির্দিষ্ট ফলাফল অর্জন করতে না পারলে সেই শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্ত করা হবে না। কিন্তু যাঁরা সেটা অর্জন করতে পারবেন, তাঁদের ক্যাডারভুক্তকরণের সমস্যা কোথায়? তবে তাঁদের এভাবে ‘নো বিসিএস, নো ক্যাডার’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়াটা শোভন হয় না। ব্যাপারটা কি অন্য কোনোভাবে সমাধান করা যেত না?
কয়েকজন ক্যাডার শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা মনে করেন, প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়া ক্যাডারভুক্ত হওয়ার দাবি করাটা অন্যায্য। আবার এঁরা বলছেন, এটা নাকি সংবিধান, পিএসসির নিয়োগসংক্রান্ত প্রচলিত আইন, চাকরি বিধি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। তার মানে কি আমরা ধরে নেব ক্যাডারভুক্ত হওয়ার এগুলোই প্রধান শর্ত? অন্যদিকে আরও অনেকে বলছেন, বেসরকারি কলেজের নিয়োগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয় না। এ অভিযোগের সত্যতা আছে, কিন্তু বিসিএসেও কি এখন দুর্নীতি হচ্ছে না? আমাদের ক্যাডার শিক্ষকেরা যদি বিসিএসের গর্বে বুক ফুলিয়ে রাখেন, তাহলে সেই যুক্তিতে কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্বও জায়েজ হয়ে যায়। কারণ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এঁরা শিক্ষকদের ওপরে। এ ছাড়া তাঁদের পরিশ্রমও করতে হয় অনেক বেশি। ফলে এই মনোভাব ক্যাডার-শিক্ষকদের জন্য আত্মঘাতী হবে।
শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ভয়, যে ১৮ হাজার বেসরকারি শিক্ষককে শিক্ষা ক্যাডারে আত্তীকরণ করা হবে, তাঁদের পদোন্নতি না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের পদোন্নতি হবে না। বর্তমান বিধিমালায় ও প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ ও চাকরিজীবন সন্তোষজনক(!) কি না, তার বিবেচনায় পদোন্নতি দিতে হবে। কিন্তু এই সন্তোষজনকের সংজ্ঞা কী, এটা সবারই অজানা। ফলে এটা নিয়ে সবারই সচেতন হওয়া উচিত। তবে মেধা ও যোগ্যতাই পদোন্নতির প্রধান শর্ত হওয়া উচিত। এ দুটি জিনিসের ঘাটতি থাকলে তা টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড দিয়ে পূরণ করা যেতে পারে। তাই এ দুটি জিনিস একেবারে উঠিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
সবচেয়ে বড় কথা, দেশে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আইন পেশায় কিন্তু উকিল ও ব্যারিস্টারদের মধ্যে ভাগ নেই, তাঁরা সবাই দাপ্তরিকভাবে আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃত। আর শিক্ষা খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই, যার প্রথম ধাপ জাতীয়করণ। শিক্ষার প্রসার যেমন ঘটছে, তেমনি মানসম্মত শিক্ষার প্রসার নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি কলেজগুলো আত্তীকরণ করার পর মানোন্নয়নে সরকারকে নজর দিতে হবে। শিক্ষকদের কনটিনিউয়াস প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট বা নিরন্তর পেশাদারি উন্নতির ধারায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রতীক বর্ধন: সাংবাদিক ও অনুবাদক।
bardhanprotik@gmail.com