মতামত

কোয়াড কি চীনকে ঠেকানোর লক্ষ্য থেকে সরে যাচ্ছে?

ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় চার গণতন্ত্রের কৌশলগত জোট হিসেবে যখন কোয়াডের কথা বলা হচ্ছিল, তখন অনেকেই এর সম্ভাব্য ব্যাপ্তি ও সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এটিকে একটি ‘সংবাদপত্রের শিরোনামসর্বস্ব ধারণা’ বলে উপহাস করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই জোট ‘প্রশান্ত মহাসাগর বা ভারত মহাসাগরের সামুদ্রিক ফেনার মতো’ বিলীন হয়ে যাবে।

কিন্তু অবিরতভাবে চীনা সম্প্রসারণবাদ অব্যাহত থাকা এবং সেই সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্পে শেষ পর্যন্ত কোয়াড নামের আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়েছিল। এখন তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারকরণে একটি বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

একটি নিশ্চিত বিষয় হলো: ২০১৬ সালে জাপানের প্রবর্তন করা এবং ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসমর্থন করা ‘মুক্ত এবং উন্মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের’ রূপকল্পকে কোয়াডের চার সদস্য দেশ অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অপরিহার্যভাবে উপলব্ধি করতে হবে।

যাত্রা শুরু করতে কোয়াড খানিকটা সময় নিয়েছিল এবং সংগঠনটি বেশ কিছুদিন মৃতবৎ ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এই জোটের ‘পুনরুত্থান’ হয়। অবশ্য জো বাইডেন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে কোয়াডের নেতারা কোনো সম্মেলনে মিলিত হননি। জোটটির সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর তা বেশ গতি পায়। এর সদস্যরা গত বছর থেকে এ পর্যন্ত তিনটি শীর্ষ সম্মেলন করেছে (এর মধ্যে দুটি ভার্চুয়াল) এবং আগামী ২৪ মে টোকিওতে সশরীরে সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিদের বৈঠক করার কথা রয়েছে।

সব মিলিয়ে কোয়াডের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাকে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। নিদেনপক্ষে চীনকে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে বাধা দেওয়ার জন্য হলেও এটিকে এগিয়ে নিতে হবে। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে আলাদা করা যেতে পারে বলে চীন যে তত্ত্ব প্রচার করে থাকে, তাতে চারটি দেশই বিশ্বাস করতে নিজেদের প্রলুব্ধ হতে দিচ্ছে।

চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত গত বছর রেকর্ড ৬৭৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এটি এখন তার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। যেহেতু প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছেন, সেহেতু এই প্রবৃদ্ধির ধারা স্থবির হয়ে পড়তে পারে। আর সেটি হলে ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এবং তার বাইরেও বেইজিংয়ের সামরিক খাতে বিনিয়োগ এবং আক্রমণাত্মক কৌশলে অর্থায়ন করার ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হবে।

এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্তে প্রধান অবদান রাখছে। ২০২১ সালে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ২৫ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ৩৯৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এখন চীনের মোট উদ্বৃত্ত ৫৮ শতাংশেরও বেশি।
চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এই মার্চের মধ্যে ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে যা ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে।
২০২০ সালে ভারতের কিছু সীমান্ত এলাকায় চীনের আগ্রাসন মারাত্মক সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়। চীন সীমান্তে সামরিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে থাকে যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

এটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য জেগে ওঠার হুঁশিয়ারি ছিল। কিন্তু তিনি চীনকে তুষ্ট করতে এতটাই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, তিনি চীনের আগ্রাসনেও অন্ধ হয়েছিলেন। চীনের সঙ্গে ভারতের এই বিরাট এবং ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি ইঙ্গিত দেয় যে, মোদি এখনো ঘুমিয়েই আছেন।

অস্ট্রেলিয়া এবং জাপান একইভাবে চীনা বাণিজ্যের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীন অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দখল করেছে। তারা জাপানের বৃহত্তম রপ্তানি বাজারও দখলে নিয়েছে।
তা ছাড়া উভয় দেশই চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক বিশদ অর্থনৈতিক অংশীদারির (রিজিওনাল কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে আরসিইপি) সদস্য। তাদের জন্য, ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে বাণিজ্য নিয়ম তৈরি করতে বাধা দেওয়া সহজ হবে না।

চীনের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করার পরিবর্তে কোয়াডের উচিত নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং বাণিজ্য বাড়ানো। এটি কোয়াডের মূল এজেন্ডাগুলোর অন্যতম বিষয়।
জো বাইডেন অবকাঠামো থেকে শুরু করে ডিজিটাল অর্থনীতি পর্যন্ত সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করবে এমন একটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক’ উন্মোচন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর প্রশাসনের এই অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ করতে বা আঞ্চলিক অংশীদারদের মার্কিন বাজারে আরও সহজ শর্তে প্রবেশাধিকার দিতে অনাগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এটি ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক’ উদ্যোগের সম্ভাবনাকে মারাত্মকভাবে সীমিত করে ফেলেছে। তার ওপরে আবার বাইডেন কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার মতো বিষয় সংবলিত একটি বিশদ এজেন্ডা কোয়াডের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, যে বিষয়গুলোর সঙ্গে কোয়াডের মূল উদ্দেশ্যগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান প্রক্সিযুদ্ধ কোয়াডের কৌশলগত অবস্থাকে আরও মলিন করে ফেলেছে। বাইডেন হলেন তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি আমেরিকার প্রাথমিক কৌশলগত ফোকাস এশিয়া এবং বৃহত্তর ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে স্থানান্তরিত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ তাঁকে সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি অবিচল থাকতে দেবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে।
যুদ্ধটি বাইডেনকে চীনের প্রতি আরও সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিতে উৎসাহিত করতে পারে। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসনের আগেই চীনের ওপর চাপ কমাতে শুরু করেছিলেন বাইডেন। তিনি কার্যকরভাবে চীনকে কোভিড-১৯ এর উত্সকে অস্পষ্ট করার জন্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০২০ সালের ‘প্রথম পর্যায়ের’ বাণিজ্য চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তিরস্কার করা বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়ের প্রতিষ্ঠাতার কন্যার বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগও বাদ দিয়েছেন। চীনের মুসলিম নিপীড়নের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও মূলত প্রতীকী অবস্থায় রয়ে গেছে।

এ অবস্থায় কোয়াড যত ইচ্ছা তত নেতার শীর্ষ সম্মেলন করতে পারে, কিন্তু একটি পরিষ্কার কৌশলগত লক্ষ্য ও এজেন্ডা না নিয়ে এগোলে এটি খুব কমই প্রভাব ফেলতে পারবে। এই গ্রুপের উদ্দেশ্য হলো চীনা সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে একটি বাঁধা হিসেবে কাজ করা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করা। আগামী ২৪ মে শীর্ষ সম্মেলনে এই বিষয়টিকেই সামনে আনা দরকার।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক