কোরবানিতে চাই বিষমুক্ত গরু

কোরবানির ঈদে চাহিদা থাকে এক কোটিরও বেশি পশুর, যার মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) টাকা। এসব পশুর চামড়ার মূল্য ৪০০ কোটি টাকা। গরু জবাই ও কাটার জন্য মজুরি বাবদ শ্রমিকদের আয় ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। পশুর হাট ইজারা দিয়ে সরকারের রাজস্ব ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। চামড়া বিক্রির দান–অনুদানে দরিদ্র ব্যক্তিদের আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। জৈব সার হিসেবে কোরবানির বর্জ্য কৃষিজমিকে করে সমৃদ্ধ, উৎকৃষ্ট।
কোরবানিকেন্দ্রিক এ বিশাল অর্জন জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক ‘ইতিবাচক কম্পন’ (Vibration)। কিন্তু ভেজাল গরুর ফাঁদে পড়ে কোরবানির মহৎ উদ্দেশ্য যেন ম্লান না হয়। কোরবানির ঈদে সবার লক্ষ্য সুদর্শন, দৃষ্টিনন্দন গরু কেনা। কিন্তু একশ্রেণির গরুর ব্যাপারীর মগজে ঘুরছে গরু মোটাতাজা করে অতিমুনাফা অর্জনের নেশা। বিক্রীত গরুর কোনো ওয়ারেন্টি নেই বিধায় রোগাক্রান্ত কিংবা ওষুধযুক্ত গরু পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ নেই। কারণ, কেনার স্বল্প সময়ের মধ্যে গরু জবাই করে ফেলা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৮৮ সালে স্টেরয়েডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। গ্রোথ হরমোন হিসেবে স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকের প্রয়োজনীয় জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ নেই। এ ক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা ও দিকনির্দেশনা অপরিহার্য। স্টেরয়েড ব্যবহারকারীদের ধারণা নেই, কী মাত্রায় এগুলো ব্যবহারযোগ্য। ফলে এর মাত্রাধিক প্রয়োগে গরুর অকালমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এমনকি গবাদিপশুর প্রতিষেধক মেয়াদোত্তীর্ণ কি না, যথাযথভাবে সংরক্ষিত কি না, তা-ও গুরুত্বপূর্ণ। গরুকে মূলত স্টেরয়েড নামে যা খাওয়ানো হয়, তা হিউম্যান ড্রাগ। এ ড্রাগটি ডেক্সামিথাসন গ্রুপের, যা দুর্বল ও শয্যাশায়ী মানুষকে সক্রিয় করতে খাওয়ানো হয়। কোনটি অপরাধ, কোনটি অপরাধ নয়, তা উপলব্ধির জন্য জ্ঞান ও শিক্ষা অনেক বড় ফ্যাক্টর। জ্ঞান ও শিক্ষার অভাব সৃষ্টি করে সততার অভাব। কোরবানিকে কেন্দ্র করে স্টেরয়েড গ্রুপের ওষুধ যেমন ডাইক্লোফেনাক, ওরাডেক্সন, স্টেরন, ডেক্সাসন, এডাম, কোরটান, কোরটিজল, হাইড্রো কোরটিজল ইত্যাদি। এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া খাইয়ে গরুকে রাতারাতি মোটাতাজা করে ফেলা হয়। ইউরোপে ইউরিয়া বিপজ্জনক খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেও অনুন্নত দেশে সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত। যদিও ইউরিয়া নাইট্রোজেনের শক্তিশালী উৎস, কিন্তু অতিরিক্ত নাইট্রোজেন গরু ও মানুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। স্টেরয়েডের সরাসরি প্রতিক্রিয়ায় গরুর পরিপাকতন্ত্র ‘হাইপার অ্যাকটিভ’ হয়ে যায়। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ক্ষুধা ও পিপাসা অনুভূত হওয়ার ফলে অতিরিক্ত মাত্রায় খাদ্য গ্রহণের প্রভাবে পরিপাকতন্ত্রের ওপর পড়ে অসহনীয় চাপ। পরিপাকতন্ত্র অতিরিক্ত খাদ্য হজমে ব্যর্থ হওয়ায় শরীরে অতিরিক্ত সঞ্চিত খাবার গরুর কিডনিতে সৃষ্টি করে বাড়তি চাপ। শরীরে সঞ্চিত অতিরিক্ত পানি ও মূত্র অনিষ্কাশিত থাকায় গরুর শরীর ফুলে যায়। কোরবানির ঈদের তিন থেকে ছয় মাস আগে গরু কিনে খামারে ও বাড়িতে চলে এ মেকানিজম। বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় স্টেরয়েড বা ওষুধযুক্ত গরু নিরাময়যোগ্য নয়।
গরুর ওপর মানুষের এ অত্যাচার বিজ্ঞানের এক ধরনের অপব্যবহার। পশুর পশুত্বকেও হার মানায় মানুষের এ লোভ। পশুতে বিষক্রিয়ার এ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় ফুডচেইনের মাধ্যমে বিষযুক্ত মাংস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। কিডনি, লিভার, হার্টসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মানবদেহে, এমনকি গর্ভবতী মহিলার হরমোন ভারসাম্যও নষ্ট হয়। রান্নার মাধ্যমেও এ ক্ষতির মাত্রা কমে না।
অপরাধ দমনে প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইনের কঠোর অনুশাসন, মসজিদে জুমার খুতবায় ধর্মীয় মোটিভেশনের মাধ্যমে মানুষের ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধ জাগ্রতকরণ ও প্রশাসনের মাধ্যমে ক্রেতাসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিকরণ। এ ত্রিমাত্রিক পদক্ষেপে কমাতে হবে এই প্রাণঘাতী অপরাধ। মানুষকে বোঝাতে হবে, যে পশুটি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা হচ্ছে, সেটি পাপাচারের সাক্ষী হিসেবে আল্লাহর দরবারে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে, যে অপরাধের পরকালীন পরিণতি ভয়াবহ।
নির্ভেজাল পশুখাদ্য নিরাপত্তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে এর নির্দেশনা আছে। এ অপরাধ বন্ধে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের অব্যাহত মনিটরিংয়ের সমান্তরালে জেলা প্রশাসনের আওতায় মোবাইল কোর্টের অভিযান অপরিহার্য। মোবাইল কোর্ট ফরমালিনবিরোধী ও ভেজালবিরোধী বহু অপরাধ দমনে এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে অনন্য সফলতা এনেছে। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ১০২ নম্বর তফসিলে ‘মৎস্য খাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এ আইনের ১২(১)(ক) ধারামতে, মৎস্য বা পশুখাদ্যে মানুষ, পশু, মৎস্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে এবং একই আইনের ১২(১)(খ) ধারা অনুযায়ী, ওই খাদ্যমান আদর্শ মানের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ ছাড়া একই আইনের ১৪(১) ধারার মৎস্য ও পশুখাদ্য হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড, কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে বিধায় এ অপরাধ মোবাইল কোর্টে বিচার্য। সুতরাং গরুতে বিষাক্ত পদার্থ বা ওষুধের উপস্থিতি প্রমাণিত হলে মোবাইল কোর্টের আওতায় তাৎক্ষণিক জেল-জরিমানা প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিকর এসব গরু ফৌজদারি কার্যবিধি (১৮৯৮)-এর ৫১৬এ থেকে ৫২৫ ধারার আলোকে জব্দ করে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক জবাই করে মৃত গরুটি মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। নতুবা এ আইন প্রয়োগের সার্থকতা থাকবে না।
এ ছাড়া জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন ১৯২০ অনুযায়ী, নিরাময়যোগ্য না হলে অযোগ্য, রোগাক্রান্ত পশু ধ্বংসের ক্ষমতাও ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়া হয়েছে। বার্ড ফ্লু সংক্রমিত মুরগি ধ্বংসযোগ্য হলে বিষযুক্ত গরু কেন ধ্বংসযোগ্য হবে না? একজন কৃষক বা খামারি যদি দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম ও অর্থে লালিত পশুটিকে অতিমুনাফার লোভে বিষাক্ত ওষুধ খাওয়ান, তবে এ অপরাধে ওই পশু ধ্বংস করা হলে ভবিষ্যতে তা অপরাধ বন্ধের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে।
যুক্তরাজ্যে ১৯৮৮ সালে ‘ম্যাডকাউ’ ডিজিজ উদ্ঘাটিত হওয়ার পর বিপুলসংখ্যক গরু ধ্বংস করে ফেলা হয়। এসব গরু বাজারে বিক্রির কোনো সুযোগই ছিল না। কত শক্তিশালী সেখানে আইনের শাসন! বাংলাদেশে বহু রোগাক্রান্ত গরু বাজারে ক্রেতাদের অগোচরে বিক্রি হয়। এমনকি রোগাক্রান্ত গরু জবাই করে সুস্থ গরু দেখিয়ে বাজারে বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে।
সুতরাং এ ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধে জেল-জরিমানা ও পশু ধ্বংসের মাধ্যমে বিক্রেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে এ সেক্টরে শুদ্ধি আনতে হবে। সরকার গবাদিপশু, মাছ ও হঁাস-মুরগিসহ পাঁচ ধরনের পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করতে আমদানি শুল্ক হ্রাস করেছে। সুতরাং অপরিহার্যভাবে এসব খাবারের দাম কমে গেলে ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। তবে লাইসেন্সকৃত ফার্মেসি ছাড়া স্টেরয়েড–জাতীয় ওষুধ বিক্রিযোগ্য নয়। প্রেসক্রিপশন ছাড়া এটির বিক্রয় বন্ধে ড্রাগ আইনে মোবাইল কোর্ট তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। গরুর জেনেটিক গুণাবলি একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। জেনেটিক্যালি গরুকে উন্নত করতে হবে এবং গোখাদ্য উৎপাদন ও গোখাদ্যের মান বাড়াতে হবে। বিদেশ থেকে উৎকৃষ্ট মানের সিমেন আমদানি নিশ্চিত করতে হবে।
ভারতে সমবায় পদ্ধতিতে প্রতিবছর ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন গোখাদ্য উৎপাদন হয়, এ ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে। কোরবানির আর অল্প দিন বাকি। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে সব সক্ষমতা নিয়ে মাঠে নামতে হবে। পশুর হাটে কোরবানির গরু নামানোর আগেই খামারে খামারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে গরুর রক্ত পরীক্ষা শুরু করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে, কোরবানির সার্থকতা শুধু মোটা বা তাজা গরুকে নয়, বরং ধর্মীয় বিধান হলো নিখুঁত ও স্বাস্থ্যবান গরু কেনা।

মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড।
mmunirc@gmail.com