উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুর দিকে পশ্চিমে জন্ম নেওয়া আধুনিক নগর-পরিকল্পনাবিষয়ক যত দর্শন এবং তাত্ত্বিক আলোচনা রয়েছে, সেগুলো মোটা দাগে বিশ্বের নগরগুলোকে ভাগ করে দিয়েছিল প্রধানত দুইটি ভাগে—আধুনিক ও অনাধুনিক। যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে একটি নগরকে ‘আধুনিক’ বলা যাবে, সেগুলো সংজ্ঞায়িত করাই হলো ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ধনাঢ্য নগরগুলোকে সামনে রেখে। সেই বৈশিষ্ট্যগুলোর সমন্বয়ে নগর আধুনিকায়নের মডেল তৈরি হলে এবং বেশ জোরালোভাবেই ধারণা করে নেওয়া হলো, এই মডেল পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় খাটবে।
অর্থাৎ, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের যেকোনো নগর যদি ‘আধুনিক’ হতে চায়, তবে পশ্চিমের তৈরি করা এই মডেল অনুসরণ করলেই চলবে। শিগগিরই বিশ্বায়নের চাপে সেই মডেল অনুসরণ করে ‘আধুনিক’ হওয়ার দায় এসে পড়ল পশ্চিমের বাইরের দেশগুলোর ওপর। এশিয়া ও আফ্রিকার নগরগুলোর জন্য এই ‘আধুনিক’ হওয়ার মাপকাঠি যুক্ত হলো ‘উন্নয়নের’ মাপকাঠির সঙ্গে। কারণ, পাল্লা দিতে হবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। এই নগরগুলো নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে পুঁজি করে নিজেদের মতো করে ‘আধুনিক’ হওয়ার ক্ষমতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলল। কারণ, তাদের সামনে ঝুলছে পশ্চিমের আধুনিকতার মডেল। এর বাইরে এসে আধুনিক নগরকে কল্পনা করা ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ে।
যেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে পশ্চিমে আধুনিক নগরের ভাবকাঠামো হিসেবে ধরা হয়, তার মধ্যে একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা (সেক্যুলারিজম)। সব ধর্মের মানুষের সমান সহাবস্থান একই নগরে হোক—এই চমৎকার ধারণাটি হতে পারত ধর্মনিরপেক্ষতার কেন্দ্রবিন্দু। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, ধর্ম আর নগর দুটি ভিন্ন এবং বিচ্ছিন্ন ধারণা হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করল। ধর্ম, ধর্মীয় কর্মকাণ্ড, উৎসব ইত্যাদিকে ব্যক্তিগত বা ছোট সমষ্টিগত পরিমণ্ডলে আবদ্ধ করে পশ্চিমা জ্ঞানকে কেন্দ্রে রেখে ‘আধুনিক’ নগরের যেই মডেল তৈরি হলো, সেটা হয়তো পশ্চিমে বেশ কিছুটা কাজ করেছে বলে ধরে নেওয়া হলো। তবে ধর্মকে এ রকম সীমাবদ্ধ করে রক্ষণশীল দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নগর-কল্পনা করা সম্ভব কি না, সেটা একটা বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল উত্তরাধুনিক নগর-পরিকল্পনার তাত্ত্বিক আলোচনায়। জন্ম নিল নতুন তাত্ত্বিক জঁনরা ‘পোস্টসেক্যুলারিজম’।
আমাদের দেশের কথাই ভাবুন। আজানের শব্দে যেখানে গানবাজনা থামিয়ে দেওয়া হয়। শাঁখের আওয়াজ ঢাকের বোল যেখানে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে, মহররম কিংবা দোলযাত্রা যেখানে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শহরের আর সবকিছু ছাপিয়ে নিজস্বতার জানান দেয়, সেখানে ধর্মকে বাইরে রেখে এখানে নগর আধুনিকায়ন কতটুকু সাফল্যের সঙ্গে সম্ভব? অথচ আমাদের দেশেও বিভিন্নভাবে ধর্মকে মূল বিবেচনার বাইরে রেখে ‘আধুনিক’ শহর বা নগর-পরিকল্পনাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক ক্ষেত্রেই খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম তাই আটকে গেছে মসজিদ বা মন্দিরের স্থানাঙ্কে। এর বাইরের যে শহর, রাস্তাঘাট, বাজার, পরিবহন আর বিনোদনকেন্দ্র, সেখানে ধর্মের উপস্থিতি সীমিত এবং প্রায়শই নিগৃহীত।
যেমন ধরুন, মসজিদগুলোকে আমরা ভাবা শুরু করেছি শুধু নামাজ আদায়সহ অন্যান্য ইসলামিক কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরি ‘বিল্ডিং’ হিসেবে। শহরের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে মসজিদের স্থানিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছে বা এখনো কাজ করছে, সেটা খুব কম ক্ষেত্রেই বিবেচিত হয়। একজন রিকশাওয়ালা কোথায় তাঁর রিকশাটি সুরক্ষিত রেখে আসরের নামাজ আদায় করবেন, অনেক সময়ই শহর সেটা জানে না বা জানায় না। শহরের কোন প্রান্ত থেকে একজন বিক্রেতা এসে মসজিদের সামনে টুপি, আতর বা ধর্মীয় বই বিক্রি করে আবার ফিরে যান এবং তাঁর মতোহাজারও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অর্থনৈতিক জালগুলো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী করে নগরের বিভিন্ন জায়গার সংযোগ ঘটায়, খুব কম সময়েই তা নগরের নকশার ভাবনায় স্থান পায়। মসজিদের দানবাক্সের সঙ্গে নগরের স্থানিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোর সম্পর্ক কী, তা নিয়েও আলোচনা খুব একটা হয় না।
শুধু মসজিদের উদাহরণ দিলাম। অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়, প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় কার্যকলাপের ক্ষেত্রেও এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে ‘আধুনিক’ নগরের মডেল নগর এবং ধর্মের সংযোগকে গুরুত্ব দেয় না। এর ফলে ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিশাল জনগোষ্ঠী নিজেদের নগরীর অংশ হিসেবে ভাবতে পারে না, বরং ধরেই নেয়, নগরীতে তারা উপেক্ষিত। তারা তখন তাদের মতো করে, নগর-পরিকল্পনার ফাঁকফোকর গলে নগরীতে তাদের ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-ব্যবস্থা পালনের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করে।
ধর্মকে বাইরে রেখে শহর বা নগর-পরিকল্পনার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়। রমজান মাসে জাকাত সংগ্রহ করতে গ্রাম থেকে দলে দলে আসা মানুষ কিংবা বিশ্ব ইজতেমার সময় অবর্ণনীয় ট্রাফিক জ্যাম—আমরা সিস্টেমকে গালি দিই, কখনো কখনো ধর্মপ্রাণ মানুষদের নিয়ে কটাক্ষ করি। অথচ কখনো এটা ভাবি না, ধর্মীয় এই ব্যাপারগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যদি শহরটাকে কল্পনা করতাম, তখন ঘটনা অন্য রকমও হতে পারত। শহরটা দেখতেও হয়তো ভিন্ন হতো, আমাদের মতো করে ‘আধুনিক’ হতো। অথচ একদিকে স্থানিকভাবে আমরা একটা বিশাল জনগোষ্ঠীকে ‘আধুনিক’ নয় বলে আলাদা করেছি, তাদের সঙ্গে নগরকেন্দ্রিক আলাপচারিতায় যাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দিয়েছি। অন্যদিকে নগর-পরিকল্পনায় ধর্মকে বিবেচনায় না এনে নগরের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ তৈরি করেছি।
আর এই পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ছে এখন, এই করোনায় আক্রান্ত সময়ে। নগর ও ধর্মের সংযোগ যখন সংকীর্ণ, তখন ধর্মপ্রাণ নাগরিক, নগরের প্রয়োজনে তৈরি সাময়িকভাবে দরকারি একটা সিস্টেম ‘সোশ্যাল ডিসটেন্স’-এ সাড়া দেবে, সেটা ধরে নেওয়াটা অবান্তর। এখনো তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, আগের মতোই নানা উপায়ে তারা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করছে, ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে জমায়েত হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে।
করোনা মোকাবিলায় এখন গুরুত্ব পাচ্ছে অল্প অল্প করে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার চিন্তাভাবনা। ব্যাংক, কাঁচাবাজার, কলকারখানা কীভাবে চালু করা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে, সেটা নিয়ে স্থাপত্য এবং অন্যান্য ডিজাইন ডিসিপ্লিন থেকে উঠে আসছে চমৎকার সব আইডিয়া। অথচ এখনো আমরা ভাবছি না, যখন এই প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হবে, তখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো যুক্তিতেই আটকে রাখা যাবে না। আর সেখানে যদি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা না যায়, তাহলে বাকি সব জায়গায় কঠোর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও লাভ নেই।
আমাদের এখন দরকার পাড়ার ইমামের সঙ্গে বসার, মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে বসার। তাঁদেরকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজে বের করতে হবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সামাজিক দূরত্বের স্বরূপ কেমন হবে। মসজিদে জায়গা না হলে, মানুষ বাড়ির ছাদে চলে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কী করে সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে? ছাদের জন্য আমরা নতুন ফ্রেমওয়ার্ক দিতে পারি কি না, যাতে সামাজিক দূরত্ব মানুষ মেনে চলে। বাড়িতে নামাজ পড়তে সমস্যা কোথায়, আমরা খুব সহজেই এই প্রশ্ন করছি। এটা ভাবছি না, সারা জীবন মসজিদে যিনি নামাজ পড়েন, মসজিদের পরিবেশে প্রার্থনায় মনোযোগ দিয়ে অভ্যস্ত যিনি, তিনি বাড়িতে মনোযোগ দিতে না পেরে ভাবছেন তাঁর নামাজ হচ্ছে না। ছুটে যাচ্ছেন মসজিদে। তাঁকে কী করে বাড়ির ভেতরে মসজিদের মতো আমেজ দেওয়া যেতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। মোদ্দা কথা বাড়ির ভেতর থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, কোন এলাকা ও স্থানকে কীভাবে ব্যবহার করে ধর্মপ্রাণ মানুষকে জায়গা করে দেওয়া যাবে, যার যার ধর্ম পালনের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় ‘ইনক্লুসিভ’ ডিজাইন প্রয়োজন। আমাদের নিজেদের দেশের জন্য, নিজের শহরের জন্য, নিজেদের মতো করে টেকসই ডিজাইন বের করে আনতে হবে এবং সেটা সবাইকে সঙ্গে নিয়েই করতে হবে।
নূসরাত জাহান: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইনের ডক্টর অব ডিজাইন প্রোগ্রামের স্থাপত্য ও নগর-পরিকল্পনা গবেষক