বাড়িতে থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংসার সামলানো ও সন্তানদের অনলাইন ক্লাসে সহায়তাদানের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারীরা অপরিসীম শক্তি, সাহস, ধৈর্যের সঙ্গে কোভিড সংকট মোকাবিলা করছেন। মহামারি মোকাবিলায় সাধারণ নারীদের পাশাপাশি নারী নেতৃত্বও অসাধারণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েই বলা হচ্ছে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি ও স্লোভাকিয়ার মতো দেশগুলো কোভিড নিয়ন্ত্রণে তুলনামূলকভাবে বেশি সফল। এই প্রতিটি দেশেই রাষ্ট্র পরিচালনায় আছেন নারীরা। কোভিড মোকাবিলায় তাঁদের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল বাস্তবসম্মত। জনগণ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সে বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তাঁরা, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি এড়িয়েছেন, সাধারণ মানুষকে এক করতে পেরেছেন এবং কোভিড-১৯–এর হুমকিকে খাটো করে দেখেননি।
নারীদের সাফল্য মিডিয়ায় গুরুত্ব পেয়েছে, যাঁরা নেতৃত্ব নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরাও বিষয়টি নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের তথ্য-প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রশংসিত হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নের সহানুভূতির সঙ্গে যৌক্তিক আচরণ এবং জনসাধারণের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের দক্ষতাকে বলা হচ্ছে ‘সংকটকালীন সময়ে নেতৃত্বের মাস্টারক্লাস’। নারীরা মহামারি কতটা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন, তা সঠিকভাবে বুঝতে আরও সময় লাগবে। তবে সাধারণভাবে নারী নেতৃত্ব নিয়ে একটি আলোচনা তৈরি হয়েছে।
‘উইল দ্য পেনডেমিক রিশেপ দ্য নোশন অব ফিমেল লিডারশিপ’-এ (হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, জুন ২০২০) টমাস চামোরো-প্রেমুজিক এবং আভিভা উইটেনবার্গ-কক্স লিখেছেন, ‘প্রতিভাবান নেতাদের এই দল পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে, তৈরি হতে পারে নেতৃত্বের নতুন সংজ্ঞা। এই সংকটের সময় নারী নেতৃত্বের সাফল্যের গল্পগুলো একজন শক্তিশালী নেতার কেমন হওয়া উচিত, সেই ধারণায় পরিবর্তন আনতে পারে। এরপর সমাজ হয়তো দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, বিনয়, সহানুভূতি, সততা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নেতাদের বেশি গ্রহণ করবে।’
বিশ্বব্যাপী মাত্র ১৮টি দেশে নেতৃত্বে আছেন নারীরা, যেখানে সাড়ে ৫৪ কোটি মানুষ বাস করে (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ)। কেয়ার-এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট জানাচ্ছে, কোভিড মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পর্যায়ের কমিটিতে মাত্র ২৪ শতাংশ পদে নারীরা রয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা পেশার শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছাতে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হন নারীরা। পুরুষ ও নারী নেতাদের কাছ থেকে সমাজের প্রত্যাশা ভিন্ন। গবেষণায় জানা যায় যে পুরুষেরা সফল হলে সমাজ তাঁদের বেশি পছন্দ করে। কিন্তু সফল নারীদের কম পছন্দ করা হয়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুসান ফিসকে, হার্ভার্ডের এমি কাডি এবং অন্য মনোবিজ্ঞানীদের কয়েক দশকের গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে সফল নারীদের একধরনের সামাজিক শাস্তি পেতে হয়।
চলমান বৈশ্বিক মহামারি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে যে মহামারির কারণে বন্ধ স্কুল, অর্থনৈতিক চাপ, মা-বাবার মৃত্যু অনেক মেয়ের বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্তমান দশক শেষ হওয়ার আগেই এক কোটি অতিরিক্ত বাল্যবিবাহ হতে পারে। আমরা যদি আগের গতিতেই কাজ করি, তাহলে কোভিড-১৯–এর কারণে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবিকাসহ মানব উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।
কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থা সব মানুষের অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করেনি, প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে এ পরিমাণে বিনষ্ট করেছে যে আমাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। যদি একটি নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করতে হয়, তাহলে ভিন্ন ধরনের নেতার প্রয়োজন, যাঁরা দূরদৃষ্টি, দায়িত্বশীলতা, সততা, সহানুভূতি ও সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করবেন। কোভিডকালে নারী নেতৃত্বের মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি
মহামারির আগেও আমরা ইতিহাসের এক অনন্য সময়ে বাস করছিলাম। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান বিশ্ব অনেক ধনী। কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, কৃচ্ছ্র, অভিবাসন ও সহিংস চরমপন্থার ফলে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটছে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা হারিয়েছে সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ ও সংঘাতে শরণার্থী হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মানবাধিকার সংকুচিত হচ্ছে। জলবায়ুসংক্রান্ত জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে অনেক দেশে শিশুরা বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে ধর্মঘট করেছে। তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি কাজ, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বিনোদনে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, তেমনি আবার তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের ঝুঁকিও।
বর্তমান মহামারি বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়েছে। একটি সবুজ ও ন্যায়সংগত বিশ্বের গুরুত্ব অনেকেই আগের চেয়ে বেশি করে বুঝতে পারছেন। কীভাবে আমরা সব গোষ্ঠীর জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারি, যাতে কেউ পিছিয়ে না থাকে? কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করব, যাতে রক্ষা পায় আমাদের সম্মিলিত ভবিষ্যৎ? কী পদক্ষেপ নেওয়া হলে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি ক্ষতির কারণ না হয়ে মানবকল্যাণে কাজে লাগবে?—কোভিড-১৯ পরবর্তী পর্যায়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে এমন নেতৃত্ব প্রয়োজন, যাঁরা নতুন এক বিশ্ব কল্পনা করার সাহস রাখেন। ‘স্বাভাবিক’-এ ফিরে যাওয়া যথেষ্ট নয়, কারণ কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী অবস্থা সব মানুষের অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষা করেনি, প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে এই পরিমাণে বিনষ্ট করেছে যে আমাদের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। যদি একটি নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করতে হয়, তাহলে ভিন্ন ধরনের নেতার প্রয়োজন, যাঁরা দূরদৃষ্টি, দায়িত্বশীলতা, সততা, সহানুভূতি ও সৃজনশীলতা নিয়ে কাজ করবেন। কোভিডকালে নারী নেতৃত্বের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি।
এই মহামারির অভিজ্ঞতা কি আমাদের আরও বেশিসংখ্যক নারীকে ক্ষমতায় নির্বাচিত করার এবং সর্বস্তরে নারী নেতৃত্বকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে? এটি কি সাধারণভাবে নেতৃত্বের মান উন্নত করবে?
● লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী