মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন জো বাইডেন, কিন্তু এর মধ্যেই দুনিয়া বিষয়ে তাঁর মূল ভাবনাগুলো পরিষ্কার: স্বদেশে পুনর্গঠন, মিত্রদের সঙ্গে কাজ, কূটনীতিকে আলিঙ্গন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে অংশগ্রহণ আর গণতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি। আর এই সবই তাঁকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ধারায় নিয়ে গেছে, তাঁর পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প যেটাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন।
৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রথম বক্তৃতায় বাইডেন ঘোষণা করেন, জার্মানি থেকে যেকোনো ধরনের মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার তিনি বন্ধ করবেন, যেমনটা করার নির্দেশ ট্রাম্প দিয়েছিলেন। ন্যাটো সদস্যদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সংকেত দিতেই সম্ভবত এ ঘোষণা দিলেন তিনি। সৌদি আরব বিষয়ে দুকূলই রেখেছেন বাইডেন। ইয়েমেনের যুদ্ধে সামরিক ও গোয়েন্দা সহায়তা দেওয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সরিয়ে নিয়েছেন। এখন থেকে মার্কিন সংশ্লিষ্টতা হবে কূটনীতিক ও মানবিক। একই সঙ্গে এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে ইরানকে মোকাবিলায় সৌদিরা একা নয়।
বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি একটা আকার পেয়েছে। এটার দ্বিপক্ষীয় হওয়াটা জরুরি, যখন সম্ভব হবে কংগ্রেসকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। বোধগম্য কারণেই মার্কিন মিত্ররা ভীত, চার বছর পর মানুষটা যদি–বা না–ও ফেরে, আমেরিকানরা ট্রাম্পবাদে ফিরে যেতে পারে। ভয় ট্রাম্প কোনো বিকার নয়, বরং আমেরিকা যা হয়ে উঠেছে তারই প্রতিরূপ। নির্বাহী কাজের মাধ্যমে শাসন করার প্রলোভনটা বোধগম্য
দুনিয়ায় বাইডেনের সাফল্য কয়েকটি ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করবে, যার অনেকগুলোই আবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। তবে ক্যাপিটল হিলে ৬ জানুয়ারির হামলা, রাজনৈতিক মেরুকরণ, জাতিগত বর্ণবাদ, ট্রাম্পের অদক্ষ মহামারি মোকাবিলা গণতন্ত্রের পক্ষে মার্কিন মোড়লির কার্যকারিতা অনেকটাই খর্ব করেছে। বাইডেন বলতে বড় পছন্দ করেন, নিজের দৃষ্টান্তের জোরেই আমেরিকা পথ দেখাবে। তবে দুনিয়া আবার তারিফ করবে, তেমন একটা দৃষ্টান্তের জন্য হয়তো দুনিয়াকে আরও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে।
আরও অধিকসংখ্যক উদ্বাস্তুর জন্য দেশের দরজা খুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন বাইডেন। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টিকার ডোজ বানিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য সহজলভ্য করা হবে। শুধু নৈতিকভাবেই যে কাজটা ঠিক তা নয়, নিজের স্বার্থেই বরং আমেরিকার এটা করা উচিত। কারণ, এটা কোভিডের অভিযোজনকে মন্থর করবে, বিদ্যমান টিকার কার্যকারিতাকে বর্তমানে যা হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে।
আইনের শাসন লঙ্ঘনের দায়ে রাশিয়া আর চীনের সমালোচনা করে বাইডেন ঠিকই করেছেন, তবে তাদের তিনি বাধ্য করতে পারবেন না। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞার দাম দিতে পুতিন আর চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্র এ দুই দেশের যেকোনো একটার সঙ্গে তার সার্বিক সম্পর্ক মানবাধিকারের জন্য জিম্মি করতে পারে না। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থও তাকে বিবেচনা করতে হবে। রাশিয়ার সঙ্গে আরও পাঁচ বছরের জন্য নিউ স্টার্ট পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরের পেছনে এ বাস্তবতার ওপরই জোর দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
একই বাস্তবতা হংকং বা জিনজিয়াংয়ের সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণ ইস্যুতে চীনকে চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রকেও সীমিত করবে। এমনকি বাইডেন যেখানে আইনের শাসনকেই কেন্দ্রীয় মার্কিন নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, ধরা যাক মিয়ানমার, সেখানেও হয়তো তিনি প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে পারেন, বিশেষ করে তাদের যদি বাইরের সমর্থন থাকে।
রচনা করার চেয়ে প্রয়োগ যে কঠিন, চীনা নীতি এটাই প্রমাণ করবে। চীনা আচরণের কড়া সমালোচনা করেছেন বাইডেন। তবে আমেরিকার স্বার্থে সি সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহও ব্যক্ত করেছেন। এখন মার্কিন সমালোচনা, নিষেধাজ্ঞা, স্পর্শকাতর প্রযুক্তি রপ্তানিতে বিধিনিষেধ সত্ত্বেও তারা লেনদেনে প্রস্তুত আছে কি না, চীনকেই তা ঠিক করতে হবে।
সংক্রামক ব্যাধি ও জলবায়ু পরিবর্তন থেকে পরমাণু বিস্তার ও সাইবার স্পেসে আচরণ, বৈশ্বিক এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দুনিয়াকে সংঘবদ্ধ করার লক্ষ্য বাস্তবায়নেও একইভাবে বাধার মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো ঐকমত্য নেই, নেই কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর যুক্তরাষ্ট্র তার চাহিদামতো অন্যকে বাধ্য করতে পারে না, একা নিজেও সফল হতে পারবে না।
আরও অনেক জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার বাকি আছে। ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিষয়েও বাইডেন প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আছে এক বছর আগে তালেবানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সনদ নিয়ে কী করা যায়, সেই প্রশ্ন। আছে উত্তর কোরিয়ার সরকারের প্রশ্ন, যারা পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্রভান্ডার বাড়িয়েই চলেছে।
তবে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি একটা আকার পেয়েছে। এটার দ্বিপক্ষীয় হওয়াটা জরুরি, যখন সম্ভব হবে কংগ্রেসকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। বোধগম্য কারণেই মার্কিন মিত্ররা ভীত, চার বছর পর মানুষটা যদি–বা না–ও ফেরে, আমেরিকানরা ট্রাম্পবাদে ফিরে যেতে পারে। ভয় ট্রাম্প কোনো বিকার নয়, বরং আমেরিকা যা হয়ে উঠেছে তারই প্রতিরূপ। নির্বাহী কাজের মাধ্যমে শাসন করার প্রলোভনটা বোধগম্য। তবে পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বাইডেনের উচিত গার্হস্থ্য রাজনীতি স্বদেশেই সীমাবদ্ধ থাকবে, এ নীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● রিচার্ড হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট ও দ্য ওয়ার্ল্ড: আ ব্রিফ ইন্ট্রোডাকশন বইয়ের লেখক