কোটি কোটি প্লাস্টিক বোতল ও প্যাকেটের ঈদযাত্রা

এক কোটি মানুষের মাথাপিছু দুটি করে পলিথিন ধরা হলেও দুই কোটি ব্যাগের ব্যবহার হবে যাত্রাপথে
 ছবি: প্রথম আলো

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ছবি মাঝেমধ্যেই ফিরে আসে। শত শত গাছঘেরা পরিচ্ছন্ন এক পথের মধ্যে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন নারী। নীল রঙের শাড়ি পরা অশীতিপরকে স্পর্শ করছে সবুজের শীতল বাতাস। সন্দেহ নেই ওই পথে রোজ যাতায়াত করে শত শত মানুষ। ভারতের কর্ণাটকের হুলিকাল গ্রামের সে পথ স্যাটেলাইট থেকে দেখা ছবিতে এখন ঘন সবুজ রঙের এক দীর্ঘ রেখা।

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কত মানুষ ঢাকা ছাড়ছে, অনুপুঙ্খ বলা সম্ভব নয়। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না দীর্ঘ পথযাত্রায় মহাসড়ক বা ফেরিঘাটগুলোর দানবীয় জ্যামে আমরা দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকব। তিতিবিরক্ত হয়ে নিচে নামব কোমল পানীয়ের বোতল আর চিপসের প্যাকেট কিনতে। গোয়ালন্দ ঘাট বা যমুনা সেতুতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে শেষ হয়ে যাবে কেনা প্যাকেটের খাবার। এরপর চলন্ত বাস, ট্রেন বা গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস কেটে শাঁই করে বেরিয়ে যাবে শূন্য বোতলটি বা ঘুড়ির মতো উড়বে প্যাকেট। তাদের সলিলসমাধি হবে পদ্মা, যমুনা নদীতে। সে পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারলে আটকে থাকবে পথের পাশের ঝোপের ভেতর। লঞ্চ থেকে সেসব কী সহজে ছুড়ে ফেলা হয় নদীতেও।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, ঈদকে কেন্দ্র করে ১০ দিনে এক কোটির বেশি মানুষ ঢাকা ছেড়ে যাবে আবার ফিরে আসবে এবার। এ সময়ে আন্তজেলা যাতায়াত করতে পারে পাঁচ কোটির বেশি মানুষ। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণাকেন্দ্রের জরিপ বলছে, ঈদের আগে চার দিন প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে বের হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। এই বিপুলসংখ্যক মানুষ উৎসব উদ্‌যাপন করতে যাচ্ছে আপনজনের কাছে। তাদের ব্যাগের ভেতরেও আছে উপহার মুড়িয়ে রাখা পলিথিনের ব্যাগ। শুধু ঈদযাত্রা নয়, উৎসব মানেই একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধি এবং পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিবিধ ব্যবহার।

৮০টি প্লাস্টিকের ব্যাগ গিলে সমুদ্রে তিমির মৃত্যুর শোকের খবর কয়েক দিন মন খারাপ রাখলেও কয় দিন পরে ভুলে যাই আমরা। কিন্তু সম্প্রতি মানুষের রক্তে প্লাস্টিকের উপস্থিতির খবরটি ভুলে যাওয়া এত সহজ হচ্ছে না। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের এক প্রতিবেদন বলছে, মানুষের শরীরে প্লাস্টিক বাতাসের পাশাপাশি খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমেও ঢুকতে পারে। আমরা আসলে প্রতিদিনই নানা রকমভাবে প্লাস্টিক গিলে নিচ্ছি। সহজলভ্য হওয়ায় প্লাস্টিকের ব্যবহার থামানো যাচ্ছে না। কিন্তু পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ আর যেখানে-সেখানে বর্জ্য না ফেলার সুযোগটুকু তো নিজের হাতে।

যাত্রাপথে ময়লা ফেলার সুব্যবস্থা পরিবহন বা লঞ্চে থাকে না। যাত্রীকে সামনের সিটের পেছনে আটকে রাখা ছেঁড়া নেটটির মধ্যে গুঁজে রাখতে হয় পানির বোতল। অধিকাংশ সিটে তা–ও থাকে না। কিন্তু নিজের হাতের পলিথিন ব্যাগটি হতে পারে সে পাত্র। বারবার আলাদা করে জানালা দিয়ে না উড়িয়ে ব্যাগে জমিয়ে একবারে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেওয়ার কষ্টটুকু তো হাসিমুখেই করতে পারি। পানির বোতলটি পথ থেকে কিনে নেওয়ার কথা ভুলে ঘর থেকেই সঙ্গে নেওয়া যায়। শুধু উৎসবে যাত্রাপথে নয়, অন্য সময়েও খেয়াল করলে দেখা যায়, বিভিন্ন সভা বা অনুষ্ঠানে অতিথিদের সামনে একটি করে আধা লিটারের পানির বোতল। কোনোটির মুখ খুলে এক ঢোঁক খাওয়া। কোনোটি অর্ধেক অবস্থায় চলে যাচ্ছে ময়লার বালতিতে। যদি একটি ২ লিটারের বোতল আর কয়েকটি কাচের গ্লাস রাখা যায়? পানির অপচয় আর প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ দুই–ই হয়।

এবারের উৎসবে রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের অভিযোগ না এনে আমরাই দুটি কাজ করতে পারি। প্লাস্টিকের ব্যবহার ও বর্জ্য ফেলায় নিয়ন্ত্রণ এবং বাড়ির উঠানে একটি করে গাছের চারা রোপণ। সে গাছ বেঁচে থাকলে আসছে বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরে হয়তো সে–ও প্রায় আপনার সমান হয়ে যাবে। না হয় আগামী বছর বাড়ি গিয়ে মেপে দেখবেন ওর সঙ্গে নিজের উচ্চতা।

এক কোটি মানুষের মাথাপিছু দুটি করে পলিথিন ধরা হলেও দুই কোটি ব্যাগের ব্যবহার হবে যাত্রাপথে। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয়, এর ৫০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য কাপ, চামচ, প্লেট বা পলিথিন। একবার ব্যবহারযোগ্য চামচের বদলে কষ্ট করে স্টিলের একটি চামচ টিস্যুতে মুড়ে ব্যাগে রাখা কি খুব কঠিন? অনেক কিছুই তো সেখানে রাখি আমরা। সবকিছু শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে চোখ সরিয়ে রাখা যায় না। আমার অসুস্থতায় সুস্থ হওয়ার দায়ভার রাষ্ট্রকাঠামোর ব্যবস্থাপনায় আছে। কিন্তু হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে হয় নিজেকেই। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বও শুধু নীতিনির্ধারক আর পরিবেশবিদদের নয়; নিজেরাই একটু একটু আরাম ছাড় দিয়ে সচেতন হলে বদলে যেতে পারে অনেক কিছু। ভালো কাজ করার আনন্দটুকু হতে পারে উৎসব ঘিরে আপনার অর্জন।

অনেক কষ্ট সহ্য করে বাড়ি ফিরবেন। যে পথ, নদী আপনাকে নিয়ে যাবে, সে পথ তো আপনজনের উঠানের সঙ্গেই যুক্ত। তাকে এতটুকু যত্ন করলে নিশ্চিত থাকুন, সে পরিশোধ করবে অনেকখানি ফিরিয়ে দিয়ে। যদি ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে গিয়ে অনেক কাজের মধ্যে আপনি একটি গাছ লাগিয়ে আসেন, তাহলে কেমন হয়? নিশ্চিত থাকতে পারেন সে গাছ একদিন সুরক্ষা দেবে আপনার সন্তানকে। তার শরীরের রক্তে প্লাস্টিক কণার পরিবর্তে পাওয়া যাবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন।

ভারতের কর্ণাটকের সালুমারাদা থিম্মাকা ৪০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন নিঃসন্তান ছিলেন বলে। শুরু করেছিলেন নিজের প্রত্যন্ত অঞ্চলেই গাছ লাগাতে। প্রথম বছরে মাত্র ১০টি গাছ লাগাতে পেরেছিলেন। তারপর কয়েক দশক ধরে রোপণ করেছিলেন ৩৮৫টি অশ্বত্থসহ ১০ হাজারের বেশি গাছ। শুরুটা এভাবেই হয়। এবারের উৎসবে রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা, অনিয়মের অভিযোগ না এনে আমরাই দুটি কাজ করতে পারি। প্লাস্টিকের ব্যবহার ও বর্জ্য ফেলায় নিয়ন্ত্রণ এবং বাড়ির উঠানে একটি করে গাছের চারা রোপণ। সে গাছ বেঁচে থাকলে আসছে বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরে হয়তো সে–ও প্রায় আপনার সমান হয়ে যাবে। না হয় আগামী বছর বাড়ি গিয়ে মেপে দেখবেন ওর সঙ্গে নিজের উচ্চতা।

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, প্রথম আলো