বলপ্রয়োগ ছাড়াও রাজনীতি ও সরকার পরিচালনার আরও অনেক উপায় আছে। মধ্যযুগের রাজ্যশাসন থেকে আধুনিক রাষ্ট্রাচার সেখানেই কিছুটা আলাদা। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস যেন বলপ্রয়োগেরই ইতিহাস। বলপ্রয়োগ ছাড়া কোনো বিবাদ–বিতর্কের মীমাংসাই হয় না। শুধু রাষ্ট্রে নয়, জনগণের মধ্যেও এই বাতিক রয়ে গেছে। গায়ের জোরে কৃষকদের দমন করা যায়, শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ রাখা যায়, কিন্তু ছাত্রসমাজকে মেরে-কেটে মোকাবিলা করাটা একটু জটিলই বটে। কারণটা খুবই স্পষ্ট, অহিংস ছাত্রছাত্রীরা জাতির সন্তান। তাদের বিষয়ে জনগণের মনে ঐতিহাসিক আবেগ ও স্পর্শকাতরতা আছে। বলপ্রয়োগ ছাড়া মীমাংসার অন্য পথগুলো তাই খোলা রাখা দরকার।
গরিব-মেহনতি বা নিম্নমধ্যবিত্ত, যে শ্রেণি থেকেই ছাত্রছাত্রীরা আসুক, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়টা মধ্যবিত্তের। যত পেছন থেকেই রওনা করুক না কেন, শিক্ষার সিঁড়ি তরুণ-তরুণীদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাতারে নিয়ে আসে। মধ্যবিত্ত পুস্তকের প্রচ্ছদে সেই শ্রেণির তরুণদের ইমেজই ভাসে। আর মধ্যবিত্তই তো জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করার ঐতিহাসিক দাবিদার। সমাজের সব নড়াচড়ার যোগসূত্র ও মধ্যস্থতাকারী কিন্তু মধ্যবিত্তরাই। মধ্যে থাকার সুবাদে জনগণের আর সব অংশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ, মানুষ তাদের কথা শোনে। তারা কথা বলে, সামাজিক জমায়েতে তারা সক্রিয় আর তাদের আছে অসাধারণ নেটওয়ার্কিং বা কাছে টানার ক্ষমতা।
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে সাধারণত জাতির মিনি আদল হিসেবে দেখানো হয়। তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন তো আপনি আয়নামহলে বন্দী হয়ে পড়লেন। আয়নামহলের আয়নায় আপনি তখন নিজের ছবিই দেখবেন, আর কাউকে দেখতে পাবেন না। অনুগতরা যত বড় আয়নাই আপনার সামনে মেলে ধরুক, তা বাস্তবতার ছবি তুলে ধরবে না।
উঠতি মধ্যবিত্তের উত্থানবেদনা
মধ্যবিত্তের গতানুগতিক সেই ইমেজটা বদলে যাচ্ছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সামনের সারির কর্মীদের দিকে তাকিয়ে দেখুন, গ্রামের কৃষক, মফস্বলের চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী এবং মহানগরের নিম্নমধ্যবিত্তের সন্তানেরাই বেশি। এরা একা নয়। তাদের পেছনে রয়েছে তাদের পরিবার, শ্রেণি ও সমাজ। এরা আমাদের দেশের উঠতি মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি, যারা নাকি বিভিন্ন কারণে অসন্তুষ্ট।
এই মধ্যবিত্ত নতুন। নব্বই দশক শেষ হলে পর দেখা গেল বিশ্বায়ন-মুক্তবাজারের নাগরদোলায় মাথা ঘুরে পথ হারিয়ে ফেলছে পুরোনো মধ্যবিত্ত। তত দিনে তাদের ভেতর থেকে কোটিপতি শ্রেণির উদয় হয়েছে। আর ক্রমে তাদের মন-মর্জি-রুচি ও সম্পর্ক জনগণের বড় অংশের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অন্যদিকে লুটেরা, মাস্তান, মাফিয়াদের দাপটে পুরোনো মধ্যবিত্ত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সব জায়গা থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এভাবে পুরোনো মধ্যবিত্ত পরাস্ত, পলায়িত ও রূপান্তরিত হয়ে হয় বিদেশমুখী নয়তো আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গুটিয়ে যায়।
অন্যদিকে তলা থেকে উঠে আসছে আরেকটা শ্রেণি। প্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো টাকা, বাবার ধান বেচা আয়, নিম্নমধ্য পেশা বা ব্যবসার আয়ে এরা প্রতিপালিত। বিশেষ কোনো মতবাদের নেশায় এরা বুঁদ নয়। বহুল বন্দিত ‘মধ্যম আয়ের দেশ’ হওয়ার বিজ্ঞাপন দেখে তারা ভাবে, আমাদের উন্নতি কই গেল? দুর্নীতি করে সফল হওয়া মানুষের জীবন এদের বুকে জ্বালা ধরায়। এরা আর তলায় পড়ে থাকতে চায় না। ভ্যাটবিরোধী সামাজিক জোয়ারের পর কোটা সংস্কারের সামাজিক প্লাবন ওই নতুন মধ্যশ্রেণির উত্থানবার্তা জানিয়ে দিল। এদের সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখা যাবে, কিন্তু যে দলই সরকারে থাকুক, বৈষম্যের বিরুদ্ধে এরা নিজেদের দাবি নিয়ে বারবারই হাজির হবে।
জাতির ভেতর জাতি ও বৈষম্যের রাষ্ট্রাচার
যেকোনো আন্দোলনকে ক্ষমতার চোখে পুরোটা বোঝা যায় না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়া যাঁরা কিছু বোঝেন না, তাঁদের দেখাটাও আংশিক। তাকে বোঝার জন্য আমাদের সমাজতাত্ত্বিক নজরপাতও লাগতে পারে। এককথায়, এটা নিম্ন ও মধ্যশ্রেণির সন্তানদের জীবনের রাস্তা সহজ করার আন্দোলন। রাষ্ট্রের কর্মসংস্থানের ভান্ডারকে এরা সুষম করতে চায়। কোটার নামে জাতির মধ্যে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ‘গোষ্ঠী’ তৈরির বৈষম্যকে দেখিয়ে দিয়ে তারা সুষম রাষ্ট্রাচারের আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করেছে। তাদের মাধ্যমে বহুদিন ঠেসে রাখা স্প্রিং যেন হঠাৎ প্রসারিত হলো। একে সহসা আবার চেপে বাক্সে ভরা যাবে না।
আগে কোটা সংস্কারকামীদের সামনে ছিল যুক্তিতে জেতার চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রীর তরফে দাবি মানার ঘোষণায় তাদের যুক্তির নৈতিক জয়টাও দৃশ্যমান হয়। কিন্তু ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের পর প্রশ্নটা এখন মানবতার। এই মানবতা আন্তর্জাতিক না, এটা আমাদের নিরীহ গেরস্ত সমাজের পারিবারিক আর্তনাদ। এই আর্তনাদই প্রকাশ করেছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরুল হক নুরুর বাবা ইদ্রিস হাওলাদার। ৬ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি বলেন, ‘কষ্টে আমি কথা বলতে পারছি না। আমার হৃদয় ফেটে যাচ্ছে। আমি বলতে চাই, যারা অতর্কিত হামলায় আহত হয়েছে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করুন। আর যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদেরকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দিন।’ এটাই মানবতার কথা, যে মানবতা একজন দরিদ্র কৃষক পিতার মনের গভীরেও খোদাই করা আছে। যেটুকু মানবতা না থাকলে দেশ আর বসবাসযোগ্য থাকে না, সেটুকু মানবতা রক্ষার দায় সবাই বোধ করে। সুবোধেরা পড়ে পড়ে মার খাবে, আর জাতির আত্মা কেঁপে উঠবে না, এতটা জড় পদার্থ এখনো হয়নি দেশের মানুষ।
বৈষম্যবিরোধী এই আন্দোলন আরও দুটি জাতীয় আন্দোলনের উত্তরাধিকার: তিরিশের দশকে শেরেবাংলা ফজলুল হক নেতৃত্বে কৃষক-প্রজা পার্টির জমিদারি-মহাজনি শোষণের বিরুদ্ধে জাগরণ ঘটান আর ষাটের দশকে মধ্যবিত্তকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন পর্যন্ত দেশকে নিয়ে যান। এ দুটি আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশের ভ্রূণের জন্ম, বিকাশ ও পরিণতি। কৃষকসমাজ থেকে আসা ছাত্ররাই ছিল ওই দুটি জাতীয় জাগরণের অগ্রসৈনিক। এবারেও দেখা যাচ্ছে, জাতির প্রকৃত ভিত্তি কৃষক-নিম্নবিত্ত শ্রেণির তরুণেরাই আবারও মানবতার দাবি নিয়ে সামনে এসেছে।
কেননা জাতির মধ্যে গড়ে উঠেছে এক সুবিধাপ্রাপ্ত জাতি। জমিদার-মহাজন সরানো গেলেও, পাকিস্তানি জাতিগত শোষণ হটানো গেলেও বাংলাদেশ পুনরায় বৈষম্যের জাঁতাকলে পড়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষাবিস্তার হয়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে, একধরনের উন্নয়নও হয়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে বিপুল মাত্রায় বৈষম্য। চাকরি, ক্ষমতা ও মর্যাদার বৈষম্য সমাজের ভেতরে ক্ষোভের বাষ্প জমাচ্ছিল। উচ্চশিক্ষায় বাড়তি ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে সেই ক্ষোভ প্রথম মুখ দেখায়। সেটাই ছিল উঠতি মধ্যশ্রেণির ছাত্র প্রতিনিধিদের প্রথম আত্মপ্রকাশ। তারপরে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে তারা হাজির হয় রাষ্ট্রের দরবারে। মার্কিন সমাজতাত্ত্বিক সেই মুর মার্টিন লিপসেটের একটি তত্ত্ব এখানে প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার থেকে ৬ হাজার ডলারের মধ্যে হলে সাবধান! এ রকম মধ্যবিত্ত অবস্থার মানুষ আঘাতের মুখে বিদ্রোহ করে। অতি দারিদ্র্য পরিবর্তনের শক্তি ও চাহিদা শুষে নেয়, আবার অতি সচ্ছলতা বিপ্লব-বিদ্রোহকে দূরে সরায়। প্রতিক্রিয়া করে মধ্যবিত্তরাই।
বার্তাবাহককে মেরো না
ডান-বামের মতবাদিক বিকারগ্রস্ততা পেছনে ফেলে এই নতুন মধ্যবিত্তের দিকে ভালো করে তাকালে দেখতে পাবেন, আয়-পেশা-অধিকার নিয়ে তারা অসন্তুষ্ট। তাদের সন্তানদের উজ্জীবিত সরল মুখগুলো দেখুন, দেখবেন সমাজসংস্কারের আগুন তাদের বুকে ধিকিধিকি জ্বলছে। ছাত্র-তরুণ বয়সটাই এমন, যখন কায়েমি স্বার্থের চেয়ে মনে বেশি বাজে শুভচেতনা, কল্যাণের আবেগ। সরকার চাইলে এদের সুচেতনা ও সৃষ্টির তাড়নাকে দেশগঠনে কাজে লাগাতে পারত। আফসোস! লালন ফকির তো গেয়েই রেখেছেন, ‘ক্যামন কেশের আড়ে পাহাড় লুকায় দ্যাখ না’।
জমিদারি-ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পরের প্রায় পৌনে এক শ বছরে কোনো সমাজসংস্কার আমাদের দেশে হয়নি। ইংরেজের ফেলে যাওয়া রাষ্ট্রকে পাকিস্তানিদের গণবিরোধী আইন ও রাষ্ট্রাচারকেই আরও গণবিরোধী করে চালানো হচ্ছে। কোটা সংস্কারের দাবির মধ্যে রাষ্ট্র ও সমাজের মানবিক সংস্কারের প্রয়োজনীয় বার্তাটাই ধ্বনিত হচ্ছে। কথায় আছে, বার্তাবাহককে মেরো না।
আগামী দিনের সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতির পালাবদলের ঘটনায় এই উঠতি মধ্যবিত্তকে আর অস্বীকার করা যাবে না। তাদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বঞ্চিত জনগণ সহমর্মিতা যে বোধ করছে, এটাই তাদের সম্ভাবনার জায়গা। তিরিশের দশকে শেরে বাংলাকে শেরে বাংলা করেছিল সে সময়ের মধ্যবিত্ত, ষাটের দশকে আরও বিকশিত মধ্যবিত্তকে পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, একুশ শতকের বাংলাদেশে নতুন মধ্যশ্রেণির এই উত্থানবেদনা যিনি বা যাঁরা ধারণ ও লালন করবেন, দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার নেতৃত্ব তাঁদের হাতেই যাবে।
সব ধরনের বৈষম্য ও ক্ষমতাহীনতার বিরুদ্ধে এই মধ্যবিত্তের ধিকিধিকি আগুন তাই শিগগিরই নিভবে বলে মনে হয় না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info