যদি বলি কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের চাবিকাঠি, তাহলে অনেকেই অবাক হবেন। কৈশোরের সঙ্গে উন্নয়নের যোগাযোগটা সহজে চোখে পড়ে না। অথচ আমরা ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের’ কথা বলি। এবং এটাও জানি যে আমাদের বিশাল জনসংখ্যা অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদ। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে এটাও মানতে হবে, এই জনমানুষ যেন সুন্দর ও সুষ্ঠু, প্রতিশ্রুতিময় জীবন নিয়ে গড়ে ওঠে, সেদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। আর সে জন্যই কথাটা আসছে। আমাদের কৈশোর জীবনটা যেন সুন্দর, রুচিশীল, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এবং বিশেষভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আদর্শস্থানীয় হয়। কারণ, কৈশোরের পরই ওরা ধীরে ধীরে শিক্ষা ও কর্মজীবনে ঢুকবে। সমাজে অবদান রাখবে।
আমরা অনেক সময় খেয়াল রাখি না যে দেশের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগের বেশি কৈশোর বয়স অতিক্রম করছে। এই বয়সটা দারুণ। কোনো কিছুকে ওরা পরোয়া করে না। কিছু একটা করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতে চায়। এই বয়সে আবার জীবনে শারীরিক-মানসিক পরিবর্তন আসছে। নতুন প্রাণশক্তি তাদের উজ্জীবিত করছে। নতুন কিছু সমাজকে দিতে চায়। সমাজ ও মানুষের জন্য কিছু করতে চায়। অবশ্য তাদের এই ইচ্ছা পূরণের অনেকটাই নির্ভর করে আমাদের সমাজ তাদের জন্য ভালো কিছু দিতে পারছে কি না, তার ওপর।
যেমন, ধরা যাক স্বাস্থ্যসেবার কথা। এর গুরুত্ব সম্পর্কে সেদিন আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে বিস্তৃত আলোচনা হয়। সহযোগিতায় ছিল ইউনিসেফ ও এমবাসি অব দ্য কিংডম অব নেদারল্যান্ডস। ওরা অনেক দিন ধরে এ বিষয়ে কাজ করছে। সাধারণত ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সটাই কৈশোর বলে ধরা হয়। এই সময় দরকার স্বাস্থ্য ও মনের গঠনে বিশেষ যত্ন। সরকারের কিছু ব্যবস্থা আছে। স্কুল হেলথ ক্লিনিক কাজ করে। তবে এর সুষ্ঠু তদারকি দরকার।
কিশোরদের যখন উঠতি বয়সে পরিবর্তন আসে, তখন সে ‘স্বপ্নদোষ’ কথাটা প্রথম শোনে। একদম ভুল কথা। এটা সেই কিশোরের কোনো ‘দোষ’ নয়। জীবনের স্বাভাবিক পরিবর্তন মাত্র। এর স্বাস্থ্যগত দিকটি তাকে কিশোর বয়স থেকেই বুঝিয়ে দিলে তার অনেক ভুল ভাঙবে এবং সমাজে একজন সুস্থ মনের তরুণ, যুবক হিসেবে গড়ে উঠবে।
মেয়েদের মাসিক হলে স্কুলে দু-তিন দিন যেতে পারে না, বলে ‘শরীর খারাপ’। একদম ভুল কথা। এটা তো একটা বয়সের স্বাভাবিক পরিবর্তন। এ সম্পর্কে বাসায় এবং স্কুলে খোলামেলা আলোচনা করলে অনেক বিষয়ে কিশোরীরা সচেতন হয়। ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য এসব বিষয়ে শিক্ষামূলক আলোচনা দরকার।
আমরা সাধারণত এসব বিষয়ে মনোযোগ দিই না। অভিভাবক বা শিক্ষকেরা এড়িয়ে যান। ধরে নিই বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছ থেকে সব বুঝে নেবে। এখানে আমাদের, বড়দের ইতস্তত ভাব কাটাতে না পারলে কৈশোর বয়স থেকেই ভালোমন্দ মেশানো কিছু বিষয় ওরা শিখবে, যা তাদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে।
অনেক সময় কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা মানসিক অশান্তিতে ভোগে। তাদের কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়। স্কুলগুলোতে কোনো রকম শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন যেন না করা হয়, তা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত সরকারের যে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলো রয়েছে, সেগুলো কৈশোরবান্ধব করতে হবে। যেন যেকোনো সমস্যা নিয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তার বা সহকারীদের সঙ্গে বিশেষভাবে কিশোরীরা নিশ্চিন্ত পরিবেশে কথা বলতে পারে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ জন্য আলাদা নিরিবিলি ঘর থাকবে। অভিভাবকেরাও বুঝতে পারবেন যে সেখানে তাঁদের মেয়েদের কোনো ভয় নেই। আমরা বলব কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়া আগামী প্রজন্মের সুন্দর মন ও সুস্থ চিন্তার মানুষ আমরা খুব বেশি পাব না।
কৈশোর বয়সে অনেকে কারখানায় কাজ করে। যদিও অন্তত ১৬ বছর, সাধারণভাবে ১৮ বছরের কম বয়সে ভারী কাজে শিশুদের নিয়োগ করার নিয়ম নেই। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয় না। এখন তৈরি পোশাক কারখানায় কম বয়সীদের নিয়োগ করা হয় না। কিন্তু অনিবন্ধিত কারখানায় শিশুশ্রম চলে। তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনের প্রতিও নজর দেওয়া দরকার। বিশেষত কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার বিশেষ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এসব ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের নিয়মভঙ্গের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সরকার কৈশোরকালীন স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সেবার জন্য ‘জাতীয় কৌশলপত্র ২০১৭-৩০’ প্রণয়ন করেছে। এর কাজের ধারাবাহিকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যদি গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে জাতি নিশ্চয়ই একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার পাবে।
কেন আমরা কৈশোর নিয়ে এত কথা বলছি? কারণ, আমাদের সমাজ ও অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। আমরা চাই, ওদের জীবন ও চিন্তাধারা যেন আধুনিক, উন্নত ও সুস্থভাবে গড়ে ওঠে। এর ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
আজকের কিশোর-কিশোরী আগামী দিনের বাংলাদেশ। ওরা সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠুক। এর প্রতি যত বেশি গুরুত্ব দেব, তত বেশি আমাদের দেশ আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উন্নত হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com