১৬ বছর ধরে জার্মানির রাজনীতিতে আঙ্গেলা ম্যার্কেল ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি আসন্ন নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না, তা অনেক আগেই জানিয়েছেন। ২৬ সেপ্টেম্বরের ২০তম নির্বাচনে কারা জয়ী হবেন, তা নিয়ে আছে নানা জল্পনা।
জার্মানির নির্বাচনকে ঘিরে এখন প্রবল আলোচনা—কে হবেন ম্যার্কেলের উত্তরসূরি। দীর্ঘ সময় ধরে জার্মানির রাজনীতিতে ম্যার্কেলের যে ইমেজ তৈরি হয়েছে, এর ধারেকাছে আপাতত কোনো রাজনীতিক দৃশ্যমান নন। তবে ব্যক্তি বা ইমেজেই সব নয়, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, নতুন নেতৃত্ব ও রাষ্ট্র চালানোর দক্ষতা একসময় সবকিছুর পরিপূরক হয়ে উঠবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত ৭৫ বছরের বেশি সময় জার্মানির সমাজ ও রাজনীতিকেরা অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সর্বদাই ঐক্য, সংহতি ও গণতন্ত্রের পথে হেঁটেছেন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজেছেন। এভাবেই একসময়ের নাৎসি জার্মান নামে পরিচিত জাতি প্রতিবেশী ও বিশ্বের মানুষের কাছে নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে।
সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই জার্মানিতে মূলত দুটি রাজনৈতিক দল—সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ঘুরেফিরে দেশ শাসন করে আসছে। তবে সরকার গঠনে ছোট দলগুলো, যেমন: লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি, বাম দল বা ব্যাভেরিয়া প্রদেশের ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়নের মতো দলের সহায়তা বেশির ভাগ সময়ই প্রয়োজন হয়েছে। জার্মানির ২০তম সাধারণ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।
২৬ সেপ্টেম্বর আসন্ন নির্বাচনে ম্যার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে চ্যান্সেলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বর্তমানে দলটির সভাপতি ও জার্মানির বৃহত্তম জনসংখ্যাবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ভেস্টাফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী আরমিন ল্যাশেট। প্রথম জীবনে আইন ও সাংবাদিকতা পেশায় জড়িত ৬০ বছর বয়স্ক আরমিন ল্যাশেটকে অভিবাসীবান্ধব রাজনীতিক বলে গণ্য করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে তিনি নর্থ রাইন ভেস্টফালিয়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
জার্মানির দ্বিতীয় বৃহত্তম দল সোশ্যাল ডেমোক্রঅটিক পার্টি থেকে চ্যান্সেলর পদে মনোনয়ন লাভ করেছেন ৬২ বছর বয়স্ক বর্তমান জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী ওলাফ শলৎস। একসময় তিনি বন্দর শহর হামবুর্গের মেয়র ছিলেন। তিনি এর আগে ম্যার্কেলের জোট সরকারে শ্রম ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সাল থকে তিনি জোট সরকারর অর্থমন্ত্রী ও সহকারী চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন।
জার্মানির পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি এ মুহূর্তে দেশটিতে বেশ জনপ্রিয় দল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ দল থেকে চ্যান্সেলর পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ৪০ বছর বয়স্ক নারী আনালেনা বার্বককে। হ্যানোভারে জন্মগ্রহণকারী আনালেনা বার্বক রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পাবলিক ল বিষয়ে পড়েছেন হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পাবলিক ইন্টারন্যাশনাল ল বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি জার্মান পার্লামেন্টে সবুজ দলের সদস্য।
জার্মানির ২০তম নির্বাচনের ১০ দিন আগে বিভিন্ন নির্বাচনী জরিপে দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২৬ শতাংশ, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ২২ শতাংশ, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি ১৬ শতাংশ, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ১১ শতাংশ, বাম দল ৬ শতাংশ এবং কট্টরবাদী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দল ১১ শতাংশ ভোট পাবে।
আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সম্প্রতি দুটি টেলিভিশন বিতর্কে ও নানা সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ওলাফ শলৎস অন্য দুই চ্যান্সেলর প্রার্থীর তুলনায় এগিয়ে আছেন। বড় দুই দল জোটবদ্ধ হয়ে গত আট বছর ক্ষমতায় থাকলেও ভোটের আগে তাঁরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই নির্বাচনের আগে মধ্যবাম রাজনীতির ধারক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও কিছুটা রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন দলটির মধ্যে বড় বিতর্কের সুযোগ কম।
তবে দুই দল তাদের নীতি ও আদর্শের স্থান থেকে ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছে, ধনীদের ক্ষেত্রে আরও কর দায়, সম্পদের সুষম বণ্টন, শক্তিশালী অর্থনীতি, সার্বভৌম ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ, টেকসই চাকরি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই। আর ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন দলটি তাদের ইশতেহারে বলেছে, মাঝারি আয়ের শ্রমিক এবং পরিবারের জন্য আর্থিক সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন, জলবায়ু সুরক্ষা, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও ইউরোপীয় ঐক্যর প্রতি জোর দেবে।
এ মুহূর্তে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে থাকা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ওলাফ শলৎস সম্প্রতি বলেছেন, দীর্ঘ সময় থেকে ইউরোপে ঝিমিয়ে পড়া সামাজিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে তিনি আবারও সচল করবেন। সম্প্রতি এই সপ্তাহে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ নরওয়েতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জয়লাভ করেছে। বর্তমান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল প্রথম দিকে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নীরব থাকলেও এখন তিনি তাঁর দলের প্রার্থী আরমিন ল্যাশেটের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছেন।
ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানি বিগত ১৬ বছরে ম্যার্কেল যুগে আরও সুসংহত হয়েছে। অর্থনীতি, সংহত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মানবাধিকার ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্য সর্বোচ্চ শরণার্থী গ্রহণ, জলবায়ু ও পরিবেশসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রভৃতি বিষয়ে ম্যার্কেলের সাফল্য অপরিসীম। শুধু জার্মানি নয়, তিনি নানা বিষয়ে ইউরোপের ক্রান্তিকালে ত্রাতা হিসেবে সামনে এসেছেন।
২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানির ২০তম নির্বাচনে যাঁরাই জয়লাভ করুন না কেন, তাঁদের ম্যার্কেলের অতীত রাজনীতির অনেকটাই অনুসৃত করেই চলতে হবে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
Sharaf.ahmed@gmx.net