বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। ফলে জনমিতির বিচারে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। সমাজের মূল চালিকা শক্তি তরুণেরা কেবল কর্মক্ষমই নয়, তারা নতুন প্রযুক্তি ও নিত্যনতুন পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার ক্ষমতা রাখে। আমরা কি আমাদের তরুণদের আগামী পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সঠিকভাবে প্রস্তুত করছি? তা ছাড়া কত দিনই বা আমরা এই জনমিতির সুবিধা ভোগ করতে পারব?
ইউনিসেফ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘শিশুদের জন্য বিনিয়োগই বয়স্কদের অগ্রিম সহায়তা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক (২৭ জুন ২০২১) থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জনমিতির সুযোগ পরিসরের ৭৫ শতাংশ অতিক্রম করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের সংখ্যা হবে সর্বাধিক। এখনই তরুণদের জন্য সঠিক বিনিয়োগ করতে না পারলে, পরবর্তী সময়ে তারাই ‘পরনির্ভরশীল’ প্রবীণ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হবে, যা হয়ে উঠতে পারে দেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা।
৬৫-ঊর্ধ্ব বয়সী প্রবীণদের নির্ভরশীল নাগরিক ধরা হয়। দেশে এ বয়সের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ বা তার বেশি হলে তাকে বয়োবৃদ্ধ সমাজ বলে। এ সংখ্যা ১৪ শতাংশ বা তার বেশি হলে প্রবীণ সমাজ বলা হয়। ২০২৯ সালে বাংলাদেশ বয়োবৃদ্ধ সমাজ হবে। প্রবীণ সমাজ হবে ২০৪৭ সালে। এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ সময় নেবে প্রায় ১৮ বছর! জাপানের ক্ষেত্রে একই পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছর সময় লেগেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের এ পরিবর্তন জাপানের চেয়ে দ্রুত হবে। ফ্রান্স বয়োবৃদ্ধ থেকে প্রবীণ সমাজে যেতে ১১৫ বছর নিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো সাউথ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও চীনে এ পরিবর্তন খুবই দ্রুত হবে। তবে এসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধ। তাহলে কি এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে?
ওপরের তথ্য বিবেচনায় রেখে এখন থেকেই দেশের তরুণদের কারিগরি ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরও বেশি হারে কর্মমুখী করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি হলো প্রযুক্তি। অদূর ভবিষ্যতে শিল্পকারখানাগুলোর বেশির ভাগই চলবে যন্ত্রনির্ভর ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে, যাকে বলা হচ্ছে অটোমেশন। অটোমেশনের কারণে যন্ত্র পরিচালনার মতো দক্ষ জনবল তখন অপরিহার্য হয়ে পড়বে। তাই অটোমেশনের এ চ্যালেঞ্জ নিতে হলে দেশের তরুণ জনশক্তিকে প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পাঠ্যসূচি, শিক্ষা ও শিক্ষণ প্রক্রিয়া আধুনিকায়ন করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা পাঠক্রমে তার কোনো ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। আমরা এখনো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। এ কারণে প্রতিবছর লাখো তরুণ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তারা কর্মবাজারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না, ‘বেকার-ব্যাংক’ সমৃদ্ধ করছে মাত্র।
একটি তথ্য চমকে দেওয়ার মতো! দেশের কর্মক্ষম তরুণদের ২৯ শতাংশ শিক্ষা বা চাকরির কোনোটাতেই যুক্ত নেই। অর্থাৎ দেশের তরুণদের একটা বড় অংশই কোনো কাজে লাগছে না। জনশক্তির এই অপচয় রোধ করে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার জন্য যথাযথ ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
করোনা অতিমারির সময়ে দেশের অনেক অর্জন হুমকির মুখে পড়েছে। একই কারণে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন অদূর ভবিষ্যতে ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শ্রমবাজারে যদি ভারসাম্য ও বাড়তি গতি যোগ করা যায়, তাহলে এই ঝুঁকি প্রতিরোধ করে বিকল্প পথের সন্ধান করা সহজ হবে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩৬ শতাংশ। নারীদের অংশগ্রহণের এই হার বাড়ানো গেলে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার মতো দক্ষ করে তুলতে পারলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিশ্চিতভাবেই আরও গতিশীল হবে।
দেশের সব তরুণকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। তার দরকারও নেই। বরং তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়াতে মনোযোগী হতে হবে, যেন তারা নিজেরাই অন্যদের চাকরি দিতে পারে। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে তরুণদের প্রশিক্ষিত করে তুলতে পারলে এ খাতে উৎপাদনশীল উদ্যোগ যেমন বাড়বে, তেমনি পাওয়া যাবে প্রযুক্তির সুফল।
জনমিতির সুবিধার পরিসর ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তরুণদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। তরুণদের মধ্যে প্রযুক্তির শিক্ষা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে নারীদের বহুমুখী কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতা একটি বড় সহায়ক হতে পারে। এ জন্য শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং এখন থেকেই তাদের প্রযুক্তিবান্ধব ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে ওঠার মতো দক্ষ করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে।
আগামী দিনের পৃথিবী নিশ্চিতভাবেই প্রযুক্তিবান্ধব হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের শ্রমবাজার ক্রমান্বয়ে আরও প্রযুক্তিনির্ভর হবে। তাই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার জন্য এখন থেকেই প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। এ জন্য শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের আওতা বাড়ানো খুবই জরুরি। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয়ে জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশকে যদি প্রযুক্তিবান্ধব ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তোলা যায়, তাহলে কেবল কর্মসংস্থানই বাড়বে না, তা হয়ে উঠবে প্রবীণদের আগামী দিনের সহায়।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। অঙ্কের হিসাবে গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি কমছে তরুণদের সংখ্যাও। তাই জনমিতির সুবিধার এই পরিসর থাকাকালেই এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার এখনই সময়।
ফিরোজ চৌধুরী প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
firoz. choudhury@prothomalo. com